উপন্যাস

আখ্যানের খোঁজ (একাদশ পর্ব)

বিবস্বান July 14, 2024 at 4:59 am উপন্যাস

দশম পর্বের পর

........................

২৩

এটা আসলে মৃতদেহের রাস্তা। আগে নামই ছিল বারিয়াল গ্রাউন্ড রোড। সাহেবদের মৃতদেহ এই পথে কবরখানায় যেত। এখন শহরে সাহেব নেই। তাদের মৃতদেহ কেউ টেনে নিয়েছে অন্য শহরে। কবরগুলো পড়ে আছে। আর আছে সেই কবরে যাওয়ার প্রচণ্ড আলো ঝলমলে এক রাস্তা। পার্ক স্ট্রিট। 

সেইখানেই মেট্রো থেকে নামেন যযাতি। এশিয়াটিক সোসাইটির পাশ দিয়ে হাঁটতে থাকেন। তিনি বুঝে পারছেন তাঁর জীবনে অবশেষে ঢুকে পড়েছে গোধূলির আলো। বড় দীর্ঘ দিন ছিল। সময় ছুটে গেছিল ভীষণ তেজি ঘোড়ার মতো। এইবার রাতের অপেক্ষা।

যযাতি ভাবেন মরে যাওয়ার সময় ঠিক কেমন লাগবে? খুব কষ্ট হবে কি ওই দরজাটুকু পেরোতে? নাকি বিষয়টা ঘুমিয়ে পড়ার মতই। যে ঘুম কখনও ভাঙে না। শরীর তো নেইই। মনও নেই। স্মৃতি নেই। চিন্তা নেই। কেমন হবে সেই সান্দ্র আঁধার? 

নিজের শিরায় শিরায় ডাক শুনতে পেয়েছেন যযাতি। এই ডাকের জন্য অপেক্ষা করেছিলেন অনেক দিন। অনেক অনেক দিন আগের কথা মনে পড়ে তাঁর। পথের পাঁচালীর সেই বিখ্যাত দৃশ্যের মত একটা ফাঁকা মাঠে রেললাইন। চারদিকে দিগন্ত বৃত্ত এঁকে দিয়েছে। সেইখানে কতিপয় ছেলেদের খেলা। রেল তো আসে না বেশি। কিন্তু রেলের অপেক্ষায় খেলা বুনে ওঠে। ছোটো ছোটো মাথাগুলো রেললাইনের ওপরে। কান চেপে শোনার চেষ্টায়। হ্যাঁ। শুনতে পাওয়া যেত। আসন্ন রেলগাড়ির খবর অনেক আগেই ভেসে আসত ধাতব লাইনে। দৃশ্যপথে তখন শুধুই শূন্য। ফাঁকা। 

তেমনই খবর এসেছে যযাতির কানে। এসেছেও ভারী আশ্চর্য ভাবে। গালিব স্ট্রিটের বাড়িটাকে ফ্ল্যাট করার জন্য চাপ আসছিল অনেক দিন থেকেই। জমি এখন সোনা। সোনারও বেশি। একটা বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট করলে লাভ তো সবার। নেতা থেকে শুরু করে পৌরসভা। বিল্ডিং উঁচু হয়। কাগজে আটকায় না। প্ল্যান পাশ হয়। চলে আসে সিসি। জমি মানে ঘর। ঘর মানে স্বপ্ন। স্বপ্নবেচা টাকা ওড়ে কলকাতার হাওয়ায়।  ভাঙা পড়ে পিঁপড়েদের পরিবার। শ্যাওলা জমা পুরোনো বাড়ি, বটের দেওয়ালভেদী চারা, কিছুই থাকে না। একটা গোটা বাস্তুতন্ত্র উবে যায় সন্ধের অন্ধকারে। যযাতি এতদিন সেইসব ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু কলকাতা শহরের পুরোনো বাড়িগুলোর চারপাশে প্রচুর শকুন ঘোরে।  তাদের ডানার ছায়া দেখে গা শিরশির করে যযতির। তাঁর অ্যান্টিকের দোকানের সামনে দিয়ে উড়ে যায় সেসব ছায়া। 

একদিন কীভাবে যেন একটা ছায়া ঢুকে পড়ল তাঁর দোকানে। আসলে শকুনের নয়। মানুষের। লোকটার সঙ্গে যযাতির দেখা হয়েছিল বেশ কিছু দশক আগে। একটা মেট্রো স্টেশনে। 

 কলকাতার বুক খোঁড়া হচ্ছিল অনেক দিন ধরেই। মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। অফিস টাইমে ভাঙা সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ পেরিয়ে যেতে সময় লাগছিল অনেক। ওদিকে খুলে যাচ্ছে পাতাল রাজ্যের দরজা। অবশেষে একদিন শহর কলকাতায় মেট্রো চলল। ধর্মতলা থেকে ভবানীপুর। কলকাতার মানুষ দেখতে যাচ্ছে পাতালযান। যযাতিও গেছিলেন। মাটির নীচের টান তিনি টের পাচ্ছিলেন অনেকদিন ধরেই। সেই ভূগর্ভ সাম্রাজ্যে ঢুকে পড়ছে ওপরের কলকাতা। নাকি এ এক অন্য চক্রান্ত। মাটির নীচের পৃথিবীই আস্তে আস্তে অধিকার বিস্তার করছে ওপরের কলকাতায়!  যযাতি ভয় পেয়েছিলেন। যযাতি দেখতে গিয়েছিলেন। 

সেইখানেই তিনি দেখা পান এই লোকের। কলোনিগুলো ততদিনে উপচে পড়ছে বাস্তু হারা মানুষে। কলকাতায় শিকড় জমিয়ে বসেছে ভাড়া বাড়ির ধারণা। কিন্তু সেই ভাড়া বাড়ির খোঁজ মিলবে কীভাবে? জন্ম নিচ্ছে এক বিশেষ সম্প্রদায়। যাদের কাছে এসে জমা হয় বাড়ির খবর। তাদের এক হাতে ভাড়া দিতে চাওয়া মানুষ। আর অন্য হাতে ভাড়া নিতে চাওয়া লোক। এই সম্প্রদায়ের মানুষজন আসলে দুই পাহাড়ের মাঝখানে অনন্ত খাদের বুকে এঁকে রাখা কাঠের সেতু। ভঙ্গুর। এবং দুর্ঘটনাপ্রবণ।

সেই কাজই করত লোকটা। কিন্তু যযাতির সঙ্গে পরিচয় যে তার ঘন হয়ে উঠবে তার কারণ বাড়ি নয়। বাঁশি। এলোমেলো চাকরির সন্ধানে ঘুরে না বেরিয়ে লোকটা সাড়া শহর ঘুরে বাঁশি বাজাত। আর সংগ্রহ করত বাড়ির খবর। তখন সেই সময় যখন ব্রোকারদের বলা হত দালাল। আর তাঁদের সামাজিক সম্মান খুব একটা ছিল না। 

দুজন মানুষের আলাপ আসলে গঙ্গায় ভেসে আসা দুটো পাতা। যে স্রোত তাদের এনেছিল পাশাপাশি, সেই স্রোতই তাদের ভাসিয়ে নিয়ে যাবে দূরে। বাঁশিওয়ালা একদিন হারিয়ে গেলেন যযাতির পৃথিবী থেকে। আলাপের আলো কমতে কমতে নিভে এল। তার অনেক দশক পর সেই বাঁশিওয়ালা আবার এসেছে যযাতির কাছে। সময়ের তারে সুর বেজে উঠেছে। 

 

২৪

 যযাতি বসে আছেন ফেলে আসা সময়ের সিংহাসনে। এই সিংহাসন শেষ ব্যবহার হয়েছিল সাদা কালো যুগের কোনও একটা বাংলা সিনেমার সেটে। সেখানে এখন বসে আছেন হৃতসাম্রাজ্য রাজা যযাতি। 

আর তার সামনে দাঁড়িয়ে যে লোকটা, তাকে যযাতি শেষ দেখেছিলেন অনেক দশক আগে। 

লোকটার চোখে সূর্যাস্ত। পরনে সাদা ঢোলা পায়জামা আর হাফহাতা ফতুয়া। কাঁচাপাকা গোঁফ। ব্যাকব্রাশ করা চুল নেমে এসেছে কাঁধের ওপর পর্যন্ত। দীর্ঘদিনের সেই ব্যাকব্রাশের টানেই মনে হয় লোকটার মাথার সামনেটা একদম ফাঁকা হয়ে গেছে। কপাল থেকে মাথার দুপাশ দিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে টাক। বাদামি মানুষ। কাঁধে একটা ঝোলা। ঝোলায় নানান সাইজের নানান বাঁশি। 

-বাঁশি কিনবেন নাকি?

লোকটা প্রশ্ন করে। এত বছর পর। পুরনো আলাপীর সঙ্গে দেখা। কুশল নেই। অন্য কোনও প্রশ্ন নেই। বাঁশি। 

-তুমি এখন আর বাজাও না?

যযাতি জিজ্ঞেস করেন। লোকটা প্রায় মরে আসা রোদের গলায় বলে ওঠে, 

-বাজাই। বিক্রিও করি। তবে দালালি করা ছেড়ে দিয়েছি অনেক দিন। তবে সত্যি বলতে, আজ আপনার কাছে এসেছি বাঁশি বিক্রি করতে নয়।  

 -তাহলে?

- ময়দানে বাজাচ্ছিলাম কদিন আগে। এখন তো শুধুই সুর। আহির ভৈরবে ভোর। কলকাতায় পাখি জেগে ওঠে। তারপর রোদের তেজ বাড়ে। একটু বিলাবল বাজাতে ইচ্ছে করে। তারপর ধরুন সন্ধের দিকে ইমন। রাত বাড়লে কানাড়া। তো সেইদিন দুপুর শেষ হচ্ছে। হাম্বীর ধরে হেঁটে আসছি ছায়ার দিকে। এমন সময় এক ছেলের সঙ্গে দেখা। সে একটা ঘর খুঁজছে। 

চমকে উঠলেন যযাতি! অন্য পৃথিবীর ঠান্ডা নিশ্বাস যে ঘরে ঘুরে বেড়ায়, সেখানে বসেও তাঁর কপালে দেখা দিল কয়েক ফোঁটা ঘাম। তবুও তিনি শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি না দালালি ছেড়ে দিয়েছ?

-  ছেড়েছি ঠিকই। তবে খবর আমার কাছে আসা বন্ধ করল কই? সেই ছেলের চোখ দেখে আপনার চোখের কথা মনে পড়ল। কেউ নেই। কিছু নেই। কারও কাছে যাওয়ার নেই। একটা রাগ শেষ করে যখন বাঁশি নামিয়ে রাখি, তখন চারপাশে যে শূন্য থাকে, তেমনই এক চোখ। ডুবে আছে। তাকিয়ে আছে। কিন্তু কিছু দেখছে না। বেঁচে আছে কি না বোঝা যায় না। বা বেঁচে থাকলেও সেই মানুষ কোথাও একটা মরে গেছে। 

-সে তোমায় ঘরের কথা বলল?

-বলল। আর যে ঘরের কথা বলল সে বড় আশ্চর্য। আমি তো ভুলি না কিছু। আমার মনে পড়ে গেল ঠিক অমন একটা ঘর কলকাতায় আমি দেখেছি বটে। অনেক অনেক দিন আগে। তখন সূর্যের রং খানিক অন্যরকম ছিল। বৃষ্টির ফোঁটা পড়ত বুকের ওপর। তখন, ওইরকম ঘরের একটা ছবি, গাঁথা হয়ে গিয়েছিল আমার মনের ভিতরে। হয়তো এই দিনটার জন্যই। 

কিন্তু মনে পড়ল না তখন। মনে পড়ল না কিছুতেই। কোথায় দেখেছি সেই ঘর। কোথায় আছে যেন… ছেলেটাকে ফিরিয়ে দিলাম। 

তারপর কাল রাতে দেশ বাজাচ্ছি। দূর কোনও শহর থেকে ভেসে আসছে বৃষ্টির শব্দ। এইসব রাতে কিছু মানুষ মৃত্যুর এত কাছে চলে যায়, যেন দাবা খেলবে মৃত্যুর সঙ্গে। জীবনের শেষে তো আর কিছু নেই। শুধু সুর। শুধু সা। সেই সা-তে এসে দাঁড়াতেই দেখতে পেলাম, একটা অন্ধকার ঘর। আর ওই ছেলেটা। পাতাল রেলের সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে জীবনের নীচে। তারপর হঠাৎ সেই অন্ধ ঘরে আলো জ্বলে উঠল। মনে পড়ল এত আপনার ঘর। এই ঠিকানা মনের মধ্যে বুনে আছে কয়েক দশক। তাই তো এলাম। আপনার কাছে। 

বেচবেন নাকি? 

 

........................ 

(ক্রমশ)

...........................

[অলংকরণ : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র] 

আগের পর্ব পড়ুন : আখ্যানের খোঁজ (দশম পর্ব)

আখ্যানের খোঁজ (নবম পর্ব)

আখ্যানের খোঁজ (অষ্টম পর্ব)

আখ্যানের খোঁজ (সপ্তম পর্ব)

 আখ্যানের খোঁজ (ষষ্ঠ পর্ব)

আখ্যানের খোঁজ (পঞ্চম পর্ব )

আখ্যানের খোঁজ (চতুর্থ পর্ব)

আখ্যানের খোঁজ (তৃতীয় পর্ব) 

আখ্যানের খোঁজ (দ্বিতীয় পর্ব)

আখ্যানের খোঁজ (প্রথম পর্ব)


##বাংলা উপন্যাস ##ধারাবাহিক উপন্যাস # #আখ্যানের খোঁজ

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

70

Unique Visitors

212736