আখ্যানের খোঁজ (নবম পর্ব)
অষ্টম পর্বের পর
.....................
১৯
শুধু যযাতি নয়। দুই শহরের মধ্যে আটকে আছে আরও কিছু জিনিস। শরীর নেই তাদের। নেই কোনও অবয়ব। খুব মন খারাপের সন্ধেয় তারা ছাতিম ফুলের গন্ধ। অকথ্য নর্দমার বুকে ভেসে যাওয়া স্নিগ্ধ জুঁই। শেষ বিকেলের আলোমেঘ। সে মেঘের বুকে লাল পাখি আর হলুদ পাখির একত্র উড়ান। ছেড়ে যাওয়ার আগে ঠান্ডা জলের চোখ। কোথাও পৌঁছোবে না যে ভালোবাসা তার হাতেই সঁপে দিয়ে যাওয়া হলুদ গোলাপ। এদের কিছুতেই টেনে নেওয়া যাচ্ছে না সেই অন্য শহরে। তাই অন্য শহরের সব ফুল শুকনো। সব শরীরে শ্যাওলা।
চিলাপাতার জঙ্গলে উঠে এসেছিল এই অন্য শহরের খবর। আসলে ওপরের শহরের মাটি সেই নীচের শহরের আকাশ। ওপরের ঘাস নীচের মেঘ। জঙ্গলে মিশে যেতে যেতে মাধবী দেখতে পেয়েছিল অন্য শহরের ছায়া। জানতে পেরেছিল সেই ঘরের কথা, আখ্যান যেটা খুঁজছে। যে ঘরে মাধবীর বাবার স্টুডিও। সে তো কলকাতা গেছিল আখ্যানকে সেই খবরখানাই দিতে। ভেবেছিল বলবে একজন লোকের কথা। জরা আটকে গেছে যাঁর শরীরে। যিনি অজস্র সঙ্গিনী পেয়েছেন। কিন্তু সবাই পিছলে গেছে হাত থেকে। ভালোবাসা গায়ে আঁটে না যাঁর। প্রচণ্ড মাঠের মধ্যে যিনি একলা ছায়া।
--চলে যা আখ্যান! চলে যা এই শহরের সব থেকে পুরোনো পানশালায়। দিন আর রাতের ঠিক মাঝখানে যে পানশালা ভরে ওঠে ধুনোর ধোঁয়ায়। সেই ধোঁয়ায় মিশে যায় ফেলে আসা সময়। কত শত হারিয়ে যাওয়া ক্যালেন্ডার। কিছু বয়স পেরিয়ে আসা মানুষ। দু-একটা বাঁশির সুর। সেইখানে বসে যে মানুষটা একটা মুখের ছবি এঁকে যাচ্ছে শান্ত চারকোলে, তাঁর পাশে গিয়ে বস। যদি চিনতে না পারিস, তাহলে খোঁজ কর বৃদ্ধ ইয়াসমিনের। সেই লোকটাকে রোজ আড়াই পেগ ব্ল্যাক ডগ এনে দিতে দিতে যার বয়সগাছ থেকে ঝরে যাচ্ছে সমস্ত পাতা। লোকটার আঁকা শেষ হচ্ছে না। সেদিনও শেষ হবে না লোকটার ছবি। সেদিনও লোকটা বেরিয়ে যাবে পানশালা থেকে। তারপর উনিশ শতকের একটা রাস্তা লোকটাকে নিয়ে যাবে সেই ঘরটায় যেটা তুই খুঁজছিস! যা আখ্যান। সেই লোকটাকে খোঁজ। না হলে এই কলকাতায় হাঁটতে হাঁটতে একজন লোকের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু? দেখলেও কি চিনতে পারবি তাঁকে? দুই শহরের মাঝে আটকে থাকা এক আশ্চর্য ঘরের সম্রাট! মহারাজ যযাতি!
অথচ মাধবী তো কিচ্ছু বলতে পারল না আখ্যানকে। সে অবাক হয়ে দেখল আখ্যানের শরীরেও তার বাবার ছায়া। সেই নিস্পৃহা। সেই না ভিজে জলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাওয়া। যার কেউ নেই কিছু নেই একটা খোঁজ ছাড়া। আর এমন নির্জন মানুষ দেখেই তো মাধবীর ভয় হল। তার ইচ্ছে করল বাবার মতো মানুষটার ঠোঁটে ঝাঁপিয়ে পড়ার। কিন্তু সে দেখল এক উদাসীন গাছ মাধবীকে মাটি ভেবে আঁকড়ে ধরছে। ভরসা করতে শুরু করছে। মাধবী বুঝল তাকে পালাতে হবে! জঙ্গল ছাড়া তার কোনও অস্তিত্ব নেই। কোনও শহুরে গাছের মাটি সে হতে পারবে না!
আর মাটিহীন গাছকে দেখতেও পারবে না চোখের সামনে। তাই চলে এল মাধবী। আমাদের আখ্যান থেকে গেল একটা গনগনে খোঁজের মাঝখানে। একা।
তবে মাধবী বুঝতে পারছিল, সে না বলে দিলেও এইরকম নির্জন নিস্পৃহ মানুষের দল সেই ছাতিম গাছের খোঁজ ঠিকই পায়। অন্য পৃথিবীর চিঠি এসেছে যার কাছে, সে অন্য পৃথিবীর দরজা পাবে না?
আর কিছু খোঁজ মানুষকে একাই করতে হয়। খোঁজই সঙ্গী তার। সেই নিভৃত দ্বিরালাপের বাগানে অন্য কারও প্রবেশ মানা।
তারপর দেশ রাগে মেঘ ঘনাল। এক আশ্চর্য চাদরে ঢেকে গেল কলকাতা থেকে চিলাপাতার আকাশ। জারুল আর গুলমোহরের ফুলে নিম্নচাপ ঘনিয়ে এল।
২০
প্রত্যেকটা দিনের মুখ একরকম হলে ফেলে আসা সময়কে মনে হয় লহমা যেন। জীবনে সামান্য নতুন কিছু না হলে জীবনের গল্প এগোয় না। আখ্যানের জীবন তো প্রায় গল্পহীন। প্রচণ্ড জ্যামের মধ্যে আটকে থাকা বাস। রাস্তায় মিছিল চলেছে। আর তার পেছনে আটকে আছে বাসেদের সারি। একটা ট্রাম। আর ইতিউতি চারচাকা গাড়ি। অবরেসবরে সামান্য এগোচ্ছে। কিন্তু গন্তব্যের তাড়া নেই। অথবা তাড়া থাকলেও এগোবার উপায় নেই দেখে সে বদ্ধ জলের জীবনকেই নিয়তি বলে মেনে নিয়েছে।
কলকাতার জ্যামে আটকে পড়ে আখ্যানের এইসব মনে হচ্ছিল। আখ্যান আজ কলেজ স্ট্রিট যাচ্ছে। শ্যামবাজার পেরিয়েই চূড়ান্ত জ্যাম। সেইখানেই আটকে আছে আখ্যান। আটকে থেকে ভাবছে নিজের জীবনের কথা। ব্যর্থতার কথা।
আখ্যানের বাবা আর মা যেমন সন্তান চেয়েছিলেন আখ্যান তেমনটা হতে পারেনি। নিজের সাফল্যের আলো দিয়ে ঢেকে দিতে পারেনি তাঁদের জীবনের অন্ধকারগুলো। প্রেম যখন এসেছিল তখনও সে এক উদাসীন বৃক্ষ হয়ে রইল। কিছু বৃষ্টির জল তবু এসে পড়ে সেই উদাসীন বৃক্ষের দেহে। ধুলো ধুয়ে যায়। বেরিয়ে পড়ে সবুজ পাতা। আখ্যান প্রাণপণ চেষ্টা করে ভালো প্রেমিক হতে। কিন্তু কোনও নক্ষত্রের দোষ তাকে ভুলিয়ে দিত প্রেমিকাদের জন্মদিনের তারিখ। সে অবাক হয়ে দেখত বৃষ্টির জল বেয়ে পড়ছে পাতার শরীর থেকে। হাত নেই বলেই যেন সে আঁজলা ভরে জল ধরতে পারেনি। অথচ কেউ কেউ তো পারছে। আখ্যান দেখতে পেত সে যেমন প্রেমিক হতে চেয়েছিল অন্যরা ঠিক তেমন তেমন প্রেমিক বা প্রেমিকা হয়ে উঠছে। বৃষ্টির দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে হাতের আদর। ফেসবুকের দেওয়াল ভরে ভালোবাসা লিখে দিচ্ছে। আখ্যানের ভাবতে ভালো লাগত, সে না পারলেও তো অন্য কেউ পারল। পারছে প্রত্যেকদিন।
যে মেয়েটি ভালোবেসেছিল আরেক মেয়েকে, সে সমস্ত কুণ্ঠার জামা ছেড়ে এসে দাঁড়িয়েছে প্রকাশ্য আলোয়। লাজুক আখ্যান যা কোনও দিন পারবে না, ঠিক তেমনভাবে ভালোবাসার কথা বলছে। যে ছেলে একজন মেয়ের থেকে একবার হ্যাঁ শোনার জন্য অপেক্ষা করেছিল বারোটা বছর, সে অবশেষে পেয়েছে মুক্তির পরোয়ানা। কলকাতায়, এক প্রচণ্ড জ্যামের রাস্তায় আকাশ থেকে ভালোবাসা নেমে আসছে।
--তুমি চাইলেই হবে। ভালোবাসা এমন কোনও ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাস নয় যে বোঝাতে কষ্ট হবে।
এক ইতিহাসবিদ বলেছিলেন আখ্যানকে। সেই ইতিহাসবিদ, যাঁকে ফিরে যেতে হয়েছিল অন্য শহরে। যাঁর জন্য কিনে রাখা উপন্যাস আখ্যান পৌঁছে দিতে পারেনি। সেই বই আখ্যানের কাছ থেকে একদিন হারিয়ে যায়। ঠিক যেমন ভালোবাসা বোঝানোর আগেই হারিয়ে যায় ভালোবাসার মানুষ। আর তারপর একদিন ভালোবাসাও হারিয়ে যায়।
কিন্তু ভালোবাসা ফিরেও আসে। যেমনভাবে এক অচেনা চিঠি আখ্যানের কাছে ফিরিয়ে এনেছিল সেই হারিয়ে যাওয়া বই। আখ্যান বুঝতেই পারেনি, তার ঘরে, বইয়ের তাকে জমে উঠেছিল শতাব্দীর ধুলো। সেই ধুলো বাড়তে বাড়তে একদিন গিলে নিল সেই উপহার দিতে চাওয়া কিন্তু না দিতে পারা বই। তারপর অন্য পৃথিবীর ডাকবাক্সে আখ্যানের বাড়ির ঠিকানা আর স্ট্যাম্প সহ একদিন সেই বই জমা পড়ল। অলীক ডাকহরকরা তাকে আবার বয়ে আনল আখ্যানের বাড়ি। তখন সেই বইয়ের গায়ে আর একটুও ধুলো লেগে নেই।
আখ্যান আবছা করে বুঝতে পারছিল এই কলকাতা শহরটার মধ্যে একটা সমুদ্র আছে। সে যা টেনে নেয় তাকে ফিরিয়েও দেয়। অপেক্ষা ছাড়া সে কোনও দিন কিচ্ছু চায়নি।
কিন্তু কবে যেন মানুষ অপেক্ষা করতে ভুলে গেল। কবে যেন কলকাতার বুকে দেখা দিল আশ্চর্য শ্যাওলা। কবে যেন হারিয়ে ফেলা ভালোবাসারা ফিরে আসা বন্ধ করে দিল।
শহরটাকে টেনে নিচ্ছে আরেক শহর। অন্তত টেনে নেওয়ার চেষ্টা করছে। আখ্যান ঘরটা খুঁজে পেলে হয়তো এই শহর মিশে যাবে আরেক শহরে।
তবুও কারও কারও কাছে ফিরে আসবে হারিয়ে যাওয়া বই। কেউ আলগোছে মনে করিয়ে দেবে, একদিন এই শহরে কত আলো ছিল।
হঠাৎ একটা হ্যাঁচকা লাগল আখ্যানের দেহে। আখ্যান দেখতে পেল কলকাতার জ্যাম ছেড়ে গেছে। নিম্নচাপের মেঘ ছিঁড়ে রোদ এসে পড়েছে কলকাতায়।
........................
(ক্রমশ)
...........................
[অলংকরণ : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র]
আগের পর্ব পড়ুন : আখ্যানের খোঁজ (অষ্টম পর্ব)
#বাংলা উপন্যাস #ধারাবাহিক উপন্যাস #আখ্যানের খোঁজ #সিলি পয়েন্ট