উপন্যাস

আখ্যানের খোঁজ (প্রথম পর্ব)

বিবস্বান May 4, 2024 at 7:24 pm উপন্যাস

............


কলকাতায় পুজো এলে মনে হয় এক বিষণ্ন, বুড়ো গাছের গায়ে কেউ জোর করে টুনি লাগিয়ে দিয়েছে। এমনিতে একা। এমনিতে কেউ তাকিয়ে দেখে না। টুনি লাগানোর পরেও কেউ দেখছে না। সবাই হেঁটে চলে যাচ্ছে ওর পাশ দিয়ে। সাজের আলোটুকু ওর ওপর যত না পড়ছে, তার থেকেও বেশি পড়ছে সাজের অন্ধকার। লজ্জা। যে বিষণ্ণ বুড়ো গাছের কথা আমরা বলছি, সে আসলে এই পৃথিবীর কেউ নয়। অন্য পৃথিবীর গাছ সে। এইখানে ওর কোনও বন্ধু নেই।

তেমনই এক কলকাতার পুজোয় আমাদের একলা আখ্যান এসে দাঁড়াল কলকাতার রাস্তায়। পুজো বটে। তবে শুরু হয়নি এখনও। সবে তৃতীয়া। রাস্তায় সারি বাঁধা ক্লান্তিতে উজ্জ্বল মুখ। জামার খুঁটে ঘাম মুছে এগিয়ে চলা ব্যস্ত অফিসযাত্রী। সার বাঁধা গাড়ি। পুজোর হোর্ডিং। ব্যানার। আলো। এই সমস্তের মাঝখানে এসে দাঁড়াল আখ্যান। গায়ে চেক শার্ট। কপালে ঘাম। কাঁধে ঝুলে থাকা মেসেঞ্জার ব্যাগ। কিন্তু কোথায় এসে দাঁড়াল?

রাস্তাটা যা খুশি হতে পারে। ধরা যাক সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ। চাঁদনি। অথবা ধর্মতলা মোড়। গড়িয়াহাট বাজারও হতে পারে। মোট কথা, বেশ ব্যস্ত একটা রাস্তা। অনেক অচেনা মানুষের ভিড়। কেনাকাটা। পসরা। এর মাঝখান দিয়েই রাস্তা হাঁটছে আমাদের আখ্যান। আখ্যান এক আশ্চর্য চাকরি করে। খুঁজে দেওয়ার চাকরি। না, কোনও ডিটেকটিভ এজেন্সি নয়। কোনও মানুষকে খুঁজছে না সে। মুরাকামির কাফকা অন দ্য শোর-এর সেই নাকাতার মতো বিড়ালও খুঁজে দেয় না সে। আখ্যান আসলে একটা বিশেষ ধরনের ঘর খুঁজছে। না। তা বলে সে ব্রোকার বা দালাল নয়। সে যে আসলে কী, তার চাকরিটারই বা নাম কী, সে কোন পোস্টে চাকরি করে, এইসব আখ্যান জানে না।

এম.এ পাশ করে বসে ছিল আখ্যান। আমাদের দেশে চাকরি ডুমুরের ফুল। শুরুতে সে সেই ডুমুরের ফুলগুলোই খুঁজত। চাকরি দেওয়ার ওয়েবসাইট। কর্মখালির বিজ্ঞাপন। সঙ্গে টিউশনি। সপ্তাহে একদিন চাকরির পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি। মাঝেমধ্যে পরীক্ষা দিতে যাওয়া। দু-একটা প্রুফ রিডিংয়ের কাজ। এইসব। এরই মাঝখানে একদিন ওর ইমেলে এক আশ্চর্য মেল এল। জব অফার। কোনও এক মাল্টিন্যাশানাল কম্পানি আখ্যানকে সিলেক্ট করেছে চাকরির জন্য। আখ্যান যদি আগ্রহী হয়, তাহলে সে যেন সেই ই-মেলের রিপ্লাই করে।

প্রথমে ভেবেছিল স্প্যাম। এইরকম কত মেসেজই তো আসে। কোনো-কোনোটা ফ্রড। সাইবার ক্রাইম। টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ধান্দা। এইসব ভেবে ও মেসেজটাকে ডিলিট করে দিয়েছিল। পরের দিন রাতে আবার অভ্যাসমতো মেল চেক করতে গিয়ে দেখে সেই ই-মেল। নতুন করে পাঠানো নয়। আগের দিনের তারিখ। অথচ আখ্যানের স্পষ্ট মনে আছে সে মেল ডিলিট করে দিয়েছিল! কী ভয়ানক ভূতুড়ে ব্যাপার! ভূতুড়ে, নাকি হ্যাকিং! আখ্যান ভাবে। টেকনিক্যাল বিষয়ে আখ্যানের তেমন জ্ঞান নেই। তাই বুঝে পায় না এইভাবে হ্যাকিং বা এনক্রিপ্টেড ভাইরাস ঢুকিয়ে দেওয়া সম্ভব কি না। সে আবার সেই মেল ডিলিট করে দেয়। পরের দিন আবার এক ঘটনা। রোজই আখ্যান সেই এক মেল মোছে। কিন্তু জামার বেয়াড়া দাগের মতোই, এই মেল কিছুতেই মোছে না।

বিষয়টা চলেছিল দিন তেরো। তেরোদিনের মাথায় সে একটা রিপ্লাই পাঠিয়েই দেয়। ভাবে কীই বা হবে। তাকে ঠকিয়ে কত টাকাই বা হাতাতে পারবে স্ক্যামার? হাজার দু-এক টাকাও নেই তখন অ্যাকাউন্টে। এদিকে মেল পাঠানোর পরের রাতেই আসে রিপ্লাই। চাকরির এগ্রিমেন্ট। সেইখানে ছিল বেশ একটা ভদ্রস্থ মাইনে। এবং একটা কাজ। একটা আশ্চর্য, ভীষণ আশ্চর্য কাজ। ঘর খুঁজে দেওয়া।


কেমন হবে সেই ঘর? স্কোয়ার। মেঝেতে চকমেলানো সাদা কালো খোপের টাইলস। দেওয়ালের রং নীল। কাঠের জানলা। বেশ পুরোনো দিনের আসবাবে সাজানো থাকবে সেই ঘর। কালো পালঙ্ক। একটা রিডিং ডেস্ক। একটা আরামকেদারা। ওপর থেকে ঝোলানো থাকবে হ্যাঙ্গিং লাইট। পালঙ্কের ওপরের দেওয়ালে থাকবে তিনটে ফটো ফ্রেম। যেখানে থাকবে তিনটে তাসের ছবি। হরতন রুইতন আর ইস্কাবন। আর থাকবে একটা লম্বা সিলিং ফ্যান। ব্যস। এইটুকুই।

খুবই ডিটেলড ডেসক্রিপশন সন্দেহ নেই। কিন্তু এর ওপর ভিত্তি করে কলকাতা শহরে একটা ঘর খুঁজে পাওয়া তো সম্ভব নয়। সম্ভবত মজা। প্র্যাঙ্ক। এইসব ভাবতে ভাবতেই আখ্যান কাটিয়ে দিল এক মাস। বোমাটা পড়ল পরের মাসের এক তারিখ। তার অ্যাকাউন্টে ঢুকে গেল তেত্রিশ হাজার চারশো সাত টাকা। এবং একটা মেল। যেখানে লেখা,

“সন্ধান জারি থাকুক।”


পুজোর সময় বেশ দেরি করে ঘুম ভাঙে আখ্যানের। বিছানা ছেড়ে ওঠার পরও অনেকক্ষণ আসলে ও ঘুমের মধ্যে থাকে। বাথরুমের কাজ, চা করা, সব ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে। একটা আলগা নেশার পরত ওকে জড়িয়ে থাকে। বাড়ির ঝামেলা, পাড়ার চিৎকার, রাস্তা দিয়ে চলে যাওয়া গাড়ির হর্ন কোনও কিছুই ওকে ছুঁতে পারে না। সমস্ত শব্দ আসে অনেক দূর থেকে।

ঘুম থেকে উঠেই আখ্যান আহির ভৈরব চালিয়ে দিল। ওর মনে হয় এই পৃথিবীতে কোথাও কোনও সকাল নেই। সবটুকু সকাল শুধু লেগে আছে কোমল রেখাবের গায়ে।

সেই সুরের মধ্যেই ঘুমন্ত আখ্যান ঢুকে পড়ে এক অসহায় সমনামবুলিস্টের মতো। এই পাড়া থেকে হারিয়ে যাওয়া সমস্ত চড়াই বাসা বেঁধেছে সেই আধো ঘুমের দেশে। কেটে ফেলা গাছের পাতা দিয়ে গড়িয়ে পড়েছে জল রঙের রোদ। কত যুগ আগে মরে যাওয়া পিঁপড়ের সারি বেরিয়েছে প্রাত্যহিক খাদ্যসন্ধানে। ভেঙে যাওয়া গির্জায় ঘণ্টা বেজে উঠেছে।

ঘুমের ভেতরে আসলে একটা মৃত সময়ের শহর। যা কিছু হারিয়ে গেছে, যা কিছু না হারালে আমাদের ভালো লাগত, সেই সমস্ত কিছু গিয়ে ঘর বাঁধে সেই শূন্য শহরে। অথচ এই পৃথিবীর কোনও বাস সেই শহরে যায় না। এক ঐতিহাসিক কোয়ারেন্টাইন সেন্টার যেন। শুধু আখ্যান, ঘুম আর জেগে থাকার ঠিক সীমানায় দাঁড়িয়ে সেই শহরের আভাস পায়।

অলৌকিক মাইনে পাওয়ার পরের সকালে আখ্যান সেইসব কথা ভুলে গেছিল। প্রত্যেকদিনের অভ্যেসমতো চা শেষ করে ফোনটা হাতে নিতেই তার সবকিছু মনে পড়ে গেল। একরাশ বিরক্তি এসে যেন কালি ঢেলে দিল কোমল রেখাবের গায়। কোথাও কিছু নেই, একটা ঘর খুঁজতে হবে। অনেক আগে খবরে নিখোঁজ মানুষের সন্ধান পাওয়ার জন্য বিজ্ঞাপন বেরোত। উচ্চতা পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি। গাঁয়ের রং শ্যামলা। হারিয়ে যাওয়ার সময় পরনে ছিল চেক শার্ট আর নীল প্যান্ট। এ যেন ঠিক তেমনটাই। একটা ঘরের অন্দরসজ্জার বিবরণ। শুধু এইটুকু। ঠিকানা বলতে কলকাতা। আর কিচ্ছু নেই। এর ওপর ভিত্তি করে কি সন্ধান সম্ভব? অথচ এখন তার অ্যাকাউন্টে তেত্রিশ হাজার চারশো সাত টাকা। ইনবক্সে সন্ধান জারি রাখার মেল। এই প্রথম আখ্যানের মনে হল, টাকার হাতে এক অদৃশ্য চাবুক থাকে। সেই চাবুকের সামনে মানুষ হয়ে যায় একটা নীল রঙের ঘোড়া। টাকার অলক্ষ চাবুক পিঠে এসে পড়ে সপাং। ঘাস আর ঠুলি পরে দৌড়ে যাওয়ার একটা অন্ধকার রাস্তা ছাড়া জীবনে আর কিছুই থাকে না।

সুতরাং আখ্যান উঠেছিল। চেক শার্ট আর নীল জিন্স পরে বেরিয়েছিল ঘর খুঁজতে। কিন্তু খুঁজবে কীভাবে? সে প্রথমে গেল এক ব্রোকারের কাছে। ব্রোকার খুব মন দিয়ে ঘরের সবটা বিবরণ শুনে বলল, দাদা একটা ভালো ফ্ল্যাট আছে। সুন্দর। দক্ষিণ খোলা। টপ ফ্লোর। নিয়ে নিন। কমে করে দেব।

কিন্তু ঘর?

আরে সে সাজিয়ে নেবেন নিজের মতো। ঝাসু ইন্টেরিয়র ডেকরেটর আছে আমার কাছে। পুরো ছবির মতো করে দেবে।


ছবির মতো একটা ঘরে ঘুমিয়ে-পড়ার-ইচ্ছে যে আখ্যানের ছিল না তা নয়। সে যখন প্রেম করত, তখন এসব ভাবত। প্রেমটা ঘুমিয়ে পড়ার পর তার ঘরের ইচ্ছেটাও আর জেগে থাকেনি। ঘুম বড়ো সংক্রামক জিনিস।

তা ছাড়াও সমস্যা আছে। মাসে তেত্রিশ হাজার চারশো সাত টাকা আসছে বলেই তো আর আখ্যান ফ্ল্যাট কেনার মতো বড়োলোক হয়ে যায়নি। তাও আবার এক ভূতুড়ে কম্পানি। তাদের অফিস কোথায়, তাদের বস কে, এইসব কিছুই জানে না আখ্যান। কোনও পে-বিল নেই। পে-স্কেল আছে কি নেই বোঝা যায় না। প্রত্যেক মাসে যে সে মাইনে পাবেই এমনটাও নিশ্চিত করে বলা যায় না। আর মেলে পরিষ্কার বলা আছে, ওই বিবরণ অনুযায়ী ঘর আগে থেকেই আছে কলকাতা শহরে। সেই ঘরটাই খুঁজে দিতে হবে।


সুতরাং আখ্যান ব্রোকারের গুটখা খাওয়া মুখ থেকে বেরিয়ে এল। দাঁড়াল কলকাতার পুজো শুরুর রাস্তায়। বাইরে থেকে দেখে বোঝার চেষ্টা করতে লাগল আশেপাশের বাড়িগুলোর ভেতরে সত্যিই তেমন কোনও ঘর থাকা সম্ভব কি না। এই প্রথম আখ্যান বুঝতে পারল, বাড়ির সঙ্গে মানুষের অনেক মিল আছে।


(ক্রমশ)

.........

পরবর্তী পর্বগুলি পড়ুন :


আখ্যানের খোঁজ (দ্বিতীয় পর্ব)

আখ্যানের খোঁজ (তৃতীয় পর্ব) 

আখ্যানের খোঁজ (চতুর্থ পর্ব) 

আখ্যানের খোঁজ (পঞ্চম পর্ব) 

আখ্যানের খোঁজ (ষষ্ঠ পর্ব)

আখ্যানের খোঁজ (সপ্তম পর্ব)

আখ্যানের খোঁজ (অষ্টম পর্ব) 

আখ্যানের খোঁজ (নবম পর্ব) 

আখ্যানের খোঁজ (দশম পর্ব)


.................

[অলংকরণ : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র] 


#বাংলা উপন্যাস #ধারাবাহিক উপন্যাস #Bengali Novel #silly পয়েন্ট #আখ্যানের খোঁজ

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

38

Unique Visitors

215814