বাঁজা
হিন্দমোটর স্টেশনে সাড়ে পাঁচটার বর্ধমান-হাওড়া লোকালে নামলেন রতন হালদার। রোজ বিকালে এই সময়ে নামেন তিনি। ব্যতিক্রম শনিবার স্কুলে হাফ ডে। আর রবিবার – ছুটির দিন। হাওড়া-বর্ধমান লাইনে উত্তরপাড়া আর কোন্নগরের মাঝে ছোট্ট স্টেশন হিন্দমোটর। মূলত হিন্দুস্থান মোটরস্ অ্যাম্বাসাডর কারখানার শ্রমিকদের জন্য রেল থেকে তৈরি স্টেশন। ফ্যাক্টরি উঠে গেছে দশ বছরের বেশি হয়ে গেল। সে-জমিতে এখন নানা প্রোজেক্ট হচ্ছে। বড়োলোকদের আবাসন। ঝাঁ চকচকে। হাজার হাজার শ্রমিক পরিবারের পেটে লাথি মেরে বেড়ে উঠছে আকাশচুম্বী ইমারত। হিন্দুমোটর স্টেশন আর প্ল্যাটফর্মের উপর গজানো বুড়ো অশ্বত্থ গাছ কেবল সাক্ষী এক সময়ের শ্রমিকদের ভিড় আর রাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ পদগুলিতে বসা মানুষদের জন্য গাড়ি তৈরির গর্বের ইতিহাসের।
রতন হালদার বর্ধমানের একটি স্কুলে ইংরেজির শিক্ষক। বিগত পঁচিশ বছর তাঁর রুটিনের পরিবর্তন হয়নি। শিক্ষকদের ট্রান্সফার চালু হলেও বাড়ির কাছে আর আসতে ইচ্ছে হয়নি। আবার কাগজপত্রের ঝামেলা। আসলে তিনি কোনো ঝামেলা চান না। তাঁর সুস্থির জীবনে একমাত্র তরঙ্গ তাঁর স্ত্রী সোমা। সে তরঙ্গের ঢেউয়েই তার জীবন ওষ্ঠাগত। বিয়ের বছর দুয়েক পর দুজনেই সন্তান নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। হয়নি। তাতে অবশ্য এখন আর আফশোস হয় না। তবে সোমার জন্য কষ্ট হয়। তাই সোমার মুখঝামটা মুখ বুঝেই সহ্য করে নেন তিনি। আর বলবেনই বা কী? সত্যিই তো– তার রোজ হাজারটা ভুল হয়। আর সব স্বামীদের মতন ‘পুরুষ’ হয়ে ওঠাটাও তার হলো না। আর হবেও না বোধহয় কোনোদিন। এই জীবনটাই তিনি মেনে নিয়েছেন।
আজ আগস্টের চোদ্দ তারিখ। আট তারিখ রাতে তিনি যখন অলিম্পিক দেখতে ব্যস্ত, তখন কলকাতায় আর. জি. কর হাসপাতালে ঘটে গেছে একটি অমানবিক ঘটনা। একজন মহিলা চিকিৎসককে নাকি ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে। খবরটা ফেসবুকে দেখেছেন তিনি। খবরের কাগজে পড়েছেন। প্রতিটা সংবাদ চ্যানেলেও আলোচনার বিষয় একই।
এতদিন কি আর এসব হয়নি? এই সরকারের আমলটুকুই যদি ধরা যায়, পার্কস্ট্রিট, কামদুনি – কত ঘটনাই তো ঘটেছে। এটাও তাদেরই একটা হয়ে রয়ে যাবে। তিনি জানেন। তাই অতিরিক্ত ভাবিত হননি। কাল সন্ধেতেই তো সোমা চা খেতে খেতে এই ঘটনার প্রসঙ্গ টেনে কথা বলতে চেয়েছিল।
তিনি আগ্রহ দেখাননি। কী হবে, সময় নষ্ট হওয়া ছাড়া? হাল ছেড়ে উঠে যাওয়ার আগে সোমা স্বগতোক্তি করে – “মেরুদণ্ডহীন লোক একটা!”
কথাটা তাঁকে উদ্দেশ্য করেই বলা। অনেক অপমানের মতো এটাও গায়ে মাখেননি তিনি। মন দিয়েছিলেন পরীক্ষার খাতায়।
আজ স্কুলে স্টাফরুমেও একই আলোচনা। তিনি শুনছিলেন সবই। যোগ দেননি। স্কুল থেকে নাকি প্রতিবাদ মিছিল করবে ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকারা মিলে। এই ভরা গরমে রোদে হাঁটা! আর যদি চিহ্নিত হয়ে যান? এসব ভাবলেই তার কেমন একটা লাগে।
স্টেশনে নেমে অভ্যেস মতন বাসুদেবের রিকশায় উঠলেন। তিনি আজ প্রায় বছর তিনেক বাসুদেবের রিকশায় যাতায়াত তার। কোভিডের পর থেকেই। তবে গত তিন-চারদিন বাসুদেব আসেনি। বোধহয় শরীর খারাপ ছিল। আজ স্টেশনের বাইরে এসেই দেখলেন তার সারথি হাজির। রিকশা চলছে। বাসুদেবও জোয়ান নয়। সুতরাং রতন হালদারের জীবনের মতোই গুড়গুড় করে চলছে বাসুদেবের রিকশা।
“দাদা, একটা কথা বলব?”
“বলো।”
“খবর দেখছেন?”
“হ্যাঁ।”
রতনবাবু বুঝতে পারছেন কথা কোনদিকে ঘুরছে।
“ওই খবরটা দেখেছেন?”
ইচ্ছে করেই তিনি উত্তর দিলেন, “কোনটা?”
“ওই ডাক্তার দিদির খবরটা?”
“হ্যাঁ।”
“খুব খারাপ হয়েছে। ওভাবে…।”
কথা কেড়ে নিয়ে উত্তর দিলেন রতন হালদার, “ওসব কথা ছাড়ো তো বাসুদেব। কী হবে? সারাদিন খাটাখাটনির পর আর এসব কচকচানি ভালো লাগছে না গো।”
“এ কী বলছেন রতনদা? আপনি না একজন শিক্ষক? এসব দেখেও আপনার রক্ত গরম হয় না?”
“না। কারণ রক্ত গরম করে কিস্যু হবে না। আমি রক্ত গরম করলেই কাল থেকে সব ভালো হয়ে যাবে বলে তোমার মনে হয়?”
“না, কেবল আপনি কেন? আমি, আপনি সবাই। আপনারা শিক্ষক। আপনাদের…।”
“ওসব জ্ঞানের কথা এখন তোমার থেকেও শুনতে হবে বাসুদেব? তোমার বৌদি সারাদিন খোঁটা দেয়। শেষে তুমিও?”
আর কোনো উত্তর দেয় না বাসুদেব। হাজার হোক কাস্টমার তো। তাও আবার রোজকার সওয়ারি। বেশি কথা বললেই লস। গুড়গুড় করে রিকশা এগিয়ে চলে সিমেন্টের ঢালাই ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে।
বাসুদেবের ফোনটা বেজে ওঠে। এক হাতে রিকশার হ্যান্ডেল ধরে আরেক হাতে ফোনটা নিয়ে কথা বলতে থাকে সে।
“কী হয়েছে রে মা?”
ওপার থেকে উত্তরে কেউ কথা বলতে থাকে। রতন হালদার বোঝেন ওর মেয়ে ফোন করেছে।
“ও, ফিরতে দেরি হবে? কেন?”
আবার ওপার থেকে উত্তর আসে কিছু।
“খেয়ে নিস। আর হ্যাঁ, আমি ফোন করব।”
(আবার উত্তর-পর্ব চলতে থাকে)।
“আরে না। যা হচ্ছে চারিদিকে! টেনশন হয় না, বল?”
(ওদিক থেকে উত্তর দেয় বাসুদেবের মেয়ে)।
“ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমায় বোঝাস না। ফোন করব এক ঘন্টা অন্তর অন্তর। আর হ্যাঁ, একা ফিরবি না। পারলে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ফিরবি। দল বেঁধে। কী বললি? রাস্তার লোক থাকবে আজ? ভালো।”
ঠিক সেই সময় রিকশাটা একটা গাড্ডায় পড়ে। এক হাতে ফোন আর এক হাতে হ্যান্ডেল। কোনোমতে সামলে দেয় বাসুদেব। বেশ একটা ঝাঁকুনি লাগে। রিকশা থেকে পড়তে পড়তে বেঁচে যান রতন হালদার। ঝাঁঝিয়ে ওঠেন তিনি, “আঃ! বাসুদেব, কতদিন না বলেছি একহাতে ফোন নিয়ে কথা বলতে বলতে রিকশা চালাবে না। আর একটু হলেই পড়তাম।
“আসলে মেয়ে ফোন করেছিল। কাজ থেকে ফিরতে দেরি হবে।”
“তা বলে তুমি প্যাসেঞ্জারের খেয়াল রাখবে না আমায় নামিয়ে মেয়েকে ফোনটা করতে পারতে না? দশ মিনিট দেরি হলে মহাভারত অশুদ্ধ হতো না।”
আমতা আমতা করে উত্তর দেয় বাসুদেব, “আসলে একা মেয়েটা বাইরে কাজে যায় তো। চিন্তা হয়। যা সব হচ্ছে আজকাল। তারপর হাসপাতালের ঘটনাটা…।”
“এতই যদি ভয়, মেয়েকে ঘরে রেখে দিলে পারো, বিয়ে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। আর টেনশন থাকে না।”
রিকশাটা থামিয়ে দেয় বাসুদেব।
“কী হল, চলো। থামলে কেন?”
“আপনি আমার রিকশা থেকে নেমে যান রতনদা।
“মানে?”
“আপনাকে আমি ঘরে পৌঁছে দিতে পারব না।”
“আরে, আমার কথায় রাগ করলে নাকি? তোমার ভালো চেয়েই তো বলেছি।”
“না দাদা, আসলে আপনিও ওদের মতোই। কোনোদিন নিজেকেই সম্মান করেননি। তাই মহিলাদেরও সম্মান দিতে পারেন না। নামুন আপনি।”
নেমে দাঁড়ালেন রতন হালদার। অপমানে চোখ-কান লাল হয়ে আসছে। তবু তার মনে সংশয়, একটা রিকশাওয়ালার সাথে ঝামেলা করা কি ঠিক হবে? যদি পরে লোকজন নিয়ে রাস্তায় ঘিরে ফেলে?
বাড়ি তো আর একটুখানি রাস্তা। ওই রাস্তাটুকু পেরোলেই হলো। কাল থেকে নতুন রিকশা দেখে নেওয়া যাবে। ঝামেলা করে লাভ নেই। পা বাড়ালেন বাড়ির পথে।
“শুনুন।” পিছু ডাকল বাসুদেব।
পথে এসো বাওয়া! কাস্টমার, তাও আবার তার মতন! যে দরদাম করে না! পাওয়া সহজ নাকি? ঘুরে দাঁড়ালেন রতন হালদার। মুখে জেতার হাসি।
“আপনি সন্তানের বাবা হতে পারেননি। আর আপনি ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষকও হতে পারেননি। দুটোর যেকোনো একটা হলেই আপনি আমার মতন করে চিন্তা করতেন। আপনার ছাত্রীরা রাত জেগে কাজ করলে একটু হলেও তাদের পক্ষ নিতেন। অনেক ভাগ্য ভালো আপনার যে বৌদি এখনও আপনাকে ত্যাগ করেননি। ভগবান আপনাকে কেন সন্তান দেননি জানেন? আপনি কেবল শারীরিক নয়, মানসিকভাবেও বাঁজা।”
এটুকু বলেই উত্তরের অপেক্ষা না করে রিকশা ঘুরিয়ে বাসুদেব রওনা দেয় ঘরের দিকে। পেছন ঘুরলে দেখতে পেত, পাংশু মুখে দাঁড়িয়ে আছেন রতন হালদার। পথচলতি লোকজন অবাক হয়ে তাকে মাপছে।
আজ আর গাড়ি চালাবে না বাসুদেব। মাথাটা গরম। পাড়ায় নাকি আজ রাতে মেয়েরা রাস্তায় নামছে। ‘রাত দখল’ না কী যেন বলছে ওরা। বাসুদেব একটা মোমবাতি নিয়ে রাস্তায় থাকবে। ওর মেয়ের ঘরে ফেরার অপেক্ষায়।
….…………..
[অলংকরণ : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র]