আখ্যানের খোঁজ (অষ্টম পর্ব)
[সপ্তম পর্বের পর]
.............................
১৭
স্বাধীনতা আসার আগেই নাকি আখ্যানের বাবা বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন। আর স্বাধীনতা আসার পর আখ্যানের মা। এইসব গল্প ছোটো থেকে শুনে আসছে আখ্যান। বাবার মুখে। মায়ের মুখে। এইসব ছেড়ে আসার ইতিহাস তার মনে। এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে গল্প বয়ে চলে। গল্পেই বেঁচে থাকে ফেলে আসা সময়। গল্পই বলে দেয় তেরো বিঘা জমির কথা। পুববাংলার জমিদার বাড়ি। কোনও এক চাঁদের রাতে বাস্তুসাপেরা এসে শুয়েছিল উঠোনে। গ্রীষ্মের উঠোনখানি। বাড়ির সমস্ত কাচ্চাবাচ্চা বসে। মিঠে হাওয়ায় ভেসে আসছে আমের আঘ্রাণ। আসলে আমের নয়। আমের বোলের। সেই সুগন্ধ বুক ভরে নিতে নিতে ক্ষয়িষ্ণু জমিদার এসে দাঁড়ালেন জ্যোৎস্নাউঠোনে। উঠোনভর্তি বংশধর। এদেরই কেউ উস্কে দেবে নেভা প্রদীপের আলো। চাঁদের আলোয় স্বপ্নের গন্ধ পান জমিদার। সব ক্ষেত-ধান-জমি গিয়েছে বটে। কিন্তু বসত রয়েছে। ভাঁড়ারে অন্ন আছেন। অন্নের সুবাস আছেন। চারদিকে আগুনের তাপ। অথচ এই তেরো বিঘায় এখনও লক্ষ্মীআলপনা। তুলসি মঞ্চে সন্ধ্যাবাতি জ্বলে। নিকানো উঠোনে সধবা পায়ের ছাপ দেখে মনে হয়, এই গৃহ এক ভরাট ধানের গোলা। খড়ের আদর যেন আগলে রাখবে সমস্ত ছায়া। সব রোদ ফিরে যাবে দুয়ার থেকে।
হঠাৎ সেই জ্যোৎস্নাউঠোনে সাপ দেখে চমকে উঠলেন জমিদার। প্রচণ্ড ভয়ে হাতে তুলে নিলেন লাঠি। উঠোনভর্তি আমের মুকুল। আহারে!। এখনও ফুইট্যে নাই। ফুইটলে যাইতাম না গ। লাঠি নিতাম না হাইত্যে। ব্যাক্কল। পুরা ব্যাক্কল। মারতাম না। অগো মারতাম না…
কলকাতার যক্ষ্মা হাসপাতালে রিফিউজি জমিদারের আর্তনাদ মিলিয়ে যায়। আখ্যানের দাদু। মায়ের বাবা। বাস্তুসাপের খুনের সঙ্গে সঙ্গেই নাকি সেই পরিবারে ঢুকে এসেছিল অমোঘ অমাবস্যা। চাঁদের আলোর মতো চাঁদের ছায়া। যা ঢেকে দিচ্ছিল পুরো দেশ। দেশের সমস্ত ধানজমি। সমস্ত পুকুর। তারপর এক অমাবস্যার রাতে পুববাংলার সেই জমিদার-পরিবার সমস্ত সম্বল ছেড়ে উঠে বসেন নৌকায়। জমিদারের হাতে বৈঠা। জলে শব্দ ওঠে ঝুপ। জলের বুকে দেশান্তরি টান। রাতের আলো ছেড়ে যাচ্ছে দেশ। নৌকোর পেছনে সাঁতার কাটছে বাড়ির কুকুর। ও তো ডাকবে! ও তো শব্দ করবে! নিশুত রাত চিরে সেই শব্দ মানুষ চিনিয়ে দেবে। মানুষ না! মেয়েমানুষ। একা জমিদার বাদে নৌকায় পঞ্চকন্যা। স্ত্রী। আর এক বিশ্বস্ত মাঝি। হাতের বৈঠা তাই আততায়ী হয়। জলে ভাসে কুকুরের দেহ। বিষয়ের সহায় আর স্নেহের সম্বল। আখ্যানের মা ইন্ডিয়ায় ঢোকেন।
আর আখ্যানের বাবা? তাঁকে পেরোতে হয়নি কাঁটাতার। জন্মেছিলেন বেলেঘাটার এক সচ্ছল পরিবারে। আখ্যানের দাদু চাকরি করতেন স্টেটসম্যানে। কিন্তু বেলেঘাটার বাড়ি-সংলগ্ন জমি পড়ে গেল ক্যালকাটা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্টের আওতায়। বাড়িও ছাড়তে হল। বাস্তুচ্যুতি। বিশেষত আখ্যানের বাবা তখন শিশু। সেইজন্যই সারাজীবন ভুলতে পারেননি বেলেঘাটার বাড়ি।
বাবা মা দুজনেই দুজনের মতো করে ঘর খুঁজেছেন। এবং ঘর তৈরি করেছেন। লঙ্কাপোড়া দিয়ে ভাত খাওয়ার মতো একটা ঘর। সেই ঘরে কে হরতন, কে রুইতন আর কেই বা ইস্কাবন? চক মেলানো মেঝে তো কখনোই ছিল না সেখানে! ক্ষয়ে যাওয়া সিমেন্টের মেঝে। দু-এক জায়গা দেখে বোঝা যেত কোনও এককালে এর রং ছিল লাল। এখন খোঁদলে ভরা। ছাদ থেকে ভেঙে পড়ত সিমেন্টের চাঁই। বর্ষায় বিছানার ওপর গামলা। ছাদের ফুটো থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল ছিটকে উঠছে গামলার ভেতর। ছোট্ট আখ্যান হাঁ করে তাকিয়ে আছে। এমন আশ্চর্য ছবি সে এর আগে দেখেনি। তারপর সেই ছাদে দেওয়া হবে পিচের আস্তরণ। তারপর বাড়ির পাশের ডুমুরগাছ থেকে ফল পেড়ে আখ্যানের মা রেঁধে ফেলবেন সেই আশ্চর্য তরকারি। আখ্যান এক থালা ভাত শেষ করে ভাববে এমন সুন্দর খাবারও হয়!
কিন্তু সে বাড়িও তো রইল না! ভাঙা পড়ল। হিমসাগর গাছটা কেটে ফেলা হল। টগর, ডুমুর, কাঁচামিঠে… রইল না কেউ। শ্যাওলাঢাকা উঠোন থেকে একদিন আখ্যানেরা চলে গেল পরিষ্কার ভাড়াবাড়িতে। এরপর যতদিন প্রোমোটিং চলেছে আখ্যানের বাবা আখ্যানকে সেই বাড়ির আশেপাশে নিয়ে যাননি। কে জানে, হয়তো তাঁর মনে পড়ে যেত বেলেঘাটার বাড়ি। যেখানে এখন রাস্তা। কে জানে, হয়তো তাঁর মনে হত ছোটোবেলার বাড়ি ভাঙতে দেখলে ছোট্ট আখ্যানের কষ্ট হবে! আখ্যানের স্মৃতিতে তাই ভাঙাবাড়ির স্মৃতি নেই। একটা শ্যাওলাঢাকা উঠোন থেকে স্মৃতি ঝাঁপ দিয়েছে পাঁচতলা ফ্ল্যাটবাড়িতে। টাইম কলের জল বদলে গেছে চব্বিশ ঘণ্টার ট্যাঙ্কির জলে। শ্যাওলায় আর পা পিছলে যায় না কারও। মাথায় সিমেন্টের চাঁই ভেঙে পড়ার ভয়ও নেই। মাটিতে মোজাইক। সব ভালো। শুধু জায়গা কমে গেছে খুব। একটাই ঘর। রান্নাঘর। ছোট্ট বাথরুম। আর হ্যাঁ, এইখান থেকে আকাশ দেখা যায় না!
ঘর খুঁজতে খুঁজতে আখ্যান ঘরের কথা ভাবে। ছেড়ে আসা ঘর। গল্পের ঘর। কিন্তু কলকাতা শহরে সেই বিশেষ ঘরের খোঁজ তো আখ্যান এখনও পায়নি। ক্যালেন্ডার বদলে যাচ্ছে। ঋতু বদলে যাচ্ছে। সমস্ত ঋতুর গায়ে লেগে যাচ্ছে আখ্যানের খোঁজ। কলকাতার রাস্তায় নেমে এসেছে মৃত সাপের দল। ওদের কারও অভিশাপেই একদিন ছিন্ন হয়েছিল আখ্যানের মাতৃবংশ। সেই থেকে খোঁজ শুরু। প্রজন্ম পেরিয়ে যায়। খোঁজ আর থামে না।
১৮
সেসিল হেনরি বম্পাসের ক্যালকাটা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট কলকাতাকে খানিক ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা করেছিল। সময়টা ১৯২০ এর আশেপাশে। দক্ষিণ কলকাতার প্রায় ১৯২ একর জলাজঙ্গলের জমি নেওয়া হল বসবাসের যোগ্য করে তোলার জন্য। ওই জমির খানিক দূরেই এক মরে যাওয়া নদীর খাত। যার পাশে মিছিলের বাড়ি। মিছিল… আখ্যানের বন্ধু। মিছিলের কাছে আখ্যান শুনেছে, অনেক আগে এই পথেই প্রবাহিত হতেন গঙ্গা।
তারপর একদিন তিনি অন্য পথ নেন। কিন্তু নদী চলে গেলেও নদীর দাগ থেকে যায়। পূতপ্রবাহিণী বুকে পুতিগন্ধের নালা। এই পথে একদিন ভেসে গিয়েছিল চাঁদ সওদাগরের বাণিজ্যতরী। চৈতন্যদেব হয়তো এই পথেই বয়ে গিয়েছিলেন নীলাচলে। তারপর একদিন নদী মরে গেল। সেই মৃতদেহের পাশে বসে রইল কত শত মানুষ। সেই মৃতদেহের পাশ থেকে উঠে এল আখ্যানের মিছিল। যে এককালে হাত ধরে আখ্যানকে চিনিয়েছিল দক্ষিণাপথ। রাসবিহারীর কাকার চাউ। লেকের জলে মরে আসা বিকেল।
সেই বিকেলের গায়ে এসে পড়ত গল্পের আলো। মিছিলের সঙ্গে তখন হেঁটে বেড়াত আখ্যান। এলোমেলো ছাত্র রাজনীতি। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা। রাস্তায় স্ট্যান্ডমাইকে চিৎকার। পুলিশের লাঠি। তারপর একদিন মিছিল মিছিলে মিশে গেল। আখ্যান সরে এল রাজনীতি থেকে। শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী মিছিল এখন কেওনঝড়ের জঙ্গলে। রাজনীতির জন্যই ঘর ছেড়েছিল সে। একটা নদীর মৃতদেহের পাশ থেকে উঠে আসা অতিবামপন্থী সেই বিপ্লবী তরুণ কলকাতা ছেড়ে হারিয়ে গেছে। হারিয়ে যেতেই তো চেয়েছিল সে। চেয়েছিল জংলি মানুষদের জন্য কাজ করতে। মিছিলের চিঠি এখনও বয়ে আনে এক আশ্চর্য পায়রা। আখ্যান জানতে পারে, মিছিল সেই জঙ্গলের মধ্যে তৈরি করেছে বারুদের ভয়ানক কারখানা। এক নৈশ বিদ্যালয়। মিছিল এখন এক ইস্কুল শিক্ষক।
আখ্যানের পিতৃবংশের জমি অধিগ্রহণের বছর কুড়ি আগে ক্যালকাটা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট আদিগঙ্গার শরীর ছুঁয়ে দক্ষিণ কলকাতার ১৯২ একর জমিকে বসবাসযোগ্য করার কাজে হাত দেয়। সেই সময়েই পরিকল্পনা করা হয় এক বিশাল দিঘির। পরে যার নাম হবে ঢাকুরিয়া লেক। আরও পরে রবীন্দ্র সরোবর। সেই দিঘির জন্য মাটি খোঁড়ার সময়ে বেরিয়ে পড়ে আটটি কামান। তার মধ্যে সব থেকে বড়োটা আট ফুটের। বাকি সাতটি চার ফুটের। এই কামানগুলো নাকি পলাশির যুদ্ধের সময়ের। ইংল্যান্ডে তৈরি। কিন্তু কেউ জানে না কীভাবে ফোর্ট উইলিয়ামের এত দূরে এই কামানগুলো আনা হয়েছিল। বিশেষত বড়ো কামান এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া বেশ সমস্যারই ছিল তখন। কেউ কেউ মনে করেন একসময়ে টিপু সুলতানের বংশধরেরা এই অঞ্চলে থাকতে শুরু করেন। কামানগুলো তাঁদেরই। কিন্তু এই কামানদের আসল ইতিহাস কেউ জানে না। কেউ জানে না ওই গর্তে বাসা বেঁধেছিল কলকাতার তলার সাপেরা। গড়ের মাঠ যখন তৈরি হচ্ছে তখনই এইসমস্ত লৌহবাসরকে মাটির তলায় টেনে নেয় কিছু আদিম সাপ। গোবিন্দপুরের জঙ্গল ফাঁকা হচ্ছে তখন। আর মাটির তলায় সেই কাটা গাছেদের শিকড় তৈরি করছে অন্য জঙ্গল। সেই জঙ্গলে বাসা বেঁধেছিল এই সমস্ত সাপেরা। তারাই ওই কামানদের নিয়ে আসে আদিগঙ্গার দিকে। পাতালের জীবেরা মাঝেমধ্যে আলোর পৃথিবীর কিছু স্মারক টেনে নেয় নিজেদের দিকে। এক অদৃশ্য সাম্রাজ্যবাদ চালাতে চায় যেন। তারা চায় একদিন পুরো কলকাতা শহরটাকেই টেনে নেবে মাটির নিচে। ভিক্টোরিয়ার পরীর গায়ে কিলবিল করবে অন্য পৃথিবীর সরীসৃপ। জিপিওর গায়ে শ্যাওলা জমবে। এই শহরের সমস্ত রাজপথকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে শুয়ে থাকবে অতিকায় সাপেরা। কলকাতা থেকে সূর্য হারিয়ে যাবে।
ঠিক যেভাবে একটা গোটা নদীকে ওরা টেনে নিয়েছিল মাটির নিচে! ওপরে পড়েছিল সেই নদীর মৃতদেহ। যে মৃতদেহ এখন এক বিশাল নর্দমা। আদিগঙ্গা নাম নিয়ে পড়ে আছে শহরের ধারে।
ঠিক যেভাবে কলকাতা শহর থেকে একসময় উবে গিয়েছিল হাড়গিলে পাখিদের সমস্ত পরিবার। কলকাতা মিউনিসিপালিটির পুরোনো এম্বলেমে দেখা মেলে তাদের। ঠিক যেভাবে এক আশ্চর্য ছাতিম গাছের তলায় ওরা টান মেরেছিল যযাতিকে। কিন্তু দুঃখের ধুলো যযাতির গায়ে এঁকে দিয়েছিল এক আশ্চর্য বর্ম। যযাতি কলকাতার তলায় যাননি। কিন্তু ওপরেও থাকেননি আর। একটা ঘর আর একটা ছাতিম গাছ নিয়ে তিনি আটকে আছেন দুই শহরের মাঝখানে। সেই ঘরটার মেঝেতে চকমেলানো সাদা কালো খোপের টাইলস। দেওয়ালের রঙ নীল। কাঠের জানলা। বেশ পুরোনো দিনের আসবাবে সাজানো সেই ঘর। কালো পালঙ্ক। একটা রিডিং ডেস্ক। একটা আরাম কেদারা। ওপর থেকে ঝোলান হ্যাঙ্গিং লাইট। পালঙ্কের ওপরের দেওয়ালে তিনটে ফটো ফ্রেম। যেখানে তিনটে তাসের ছবি। হরতন রুইতন আর ইস্কাবন।
(ক্রমশ)
...........................
[অলংকরণ : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র]