আখ্যানের খোঁজ (তৃতীয় পর্ব)
(দ্বিতীয় পর্বের পর)
...............
৫
অষ্টমীর অঞ্জলি শেষ হলে এক অন্যরকম ঢাকের বোল বেজে ওঠে। লয়টা একটু বেড়ে যায় যেন। এই লয় বাড়তে বাড়তে দশমীতে গিয়ে একদম চূড়ায় পৌঁছবে। হয়তো এমনটা হয় না। হয়তো এমনটা শুধু মনেই হয় আখ্যানের। এমনটা মাধবী ওকে বলেছে।
এক আশ্চর্য মেয়ে এই মাধবী। ওর বাবা এককালে বিশাল বড়োলোক ছিলেন। একটু পাগলাটে। প্রচুর দানধ্যান করতেন। কাউকেই ফেরাতে পারতেন না তিনি। আস্তে আস্তে তাঁর অবস্থা খানিক পড়ে আসে। তখনও কাউকে ‘না’ বলা তাঁর স্বভাবের বাইরে। এই সমস্ত শুনে আখ্যানের ওর বাবাকে বেশ ভালো মানুষ বলেই মনে হত। অথচ ঠিক সেই সময়গুলোতেই মাধবীর ঠোঁটের কোনায় ফুটে উঠত এক আশ্চর্য হাসি। বিসর্জনের আগে প্রতিমার মুখের দিকে তাকালে যেমন কান্নাভেজা হাসি দেখতে পায় কেউ কেউ। অনেকটা সেইরকম।
আস্তে আস্তে আখ্যান জানতে পেরেছিল আরও অনেক কথা। সত্যি জানার এক অদম্য বাসনা সবসময় আমাদের আখ্যানকে তাড়া করে ফেরে। এই দিক থেকে তার সঙ্গে অনেকটা অয়দিপাউসের মিল রয়েছে। তবে মাধবীর সত্যি জানার জন্য আখ্যানকে কোনও সর্বজ্ঞ, অন্ধ তাইরেসিয়াসের কাছে যেতে হয়নি। মাধবী নিজেই জানিয়েছিল। শেষ বিকেলের মরে আসা আলোর মতো গলায়। মরা মাছের মতো একটা শূন্য দৃষ্টি তখন খেলা করছে মাধবীর মুখে।
মাধবীদের পাড়ায় একটা লোক থাকত। শেয়ার মার্কেটে টাকা খাটিয়ে বেশ ফুলেফেঁপে ওঠা মানুষ। তবে এই পৃথিবীর সমস্ত জোয়ারের পর অনিবার্য ভাটা। লোকটার সব টাকা ডুবে যায়। ঋণে ঋণে জর্জরিত হয়ে সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। মৃতপ্রায় এই প্রতিবেশীকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতালে যাওয়ার সময় মাধবীর বাবা এক অদ্ভুত শপথ করেন। নির্জীব মানুষটার কানে ঠোঁট ঠেকিয়ে বলেন, তার সমস্ত ঋণ শোধ হয়ে যাবে। অথচ মাধবীর বাবা তখন কার্যত কপর্দকশূন্য। বাড়িটাও মর্টগেজ রাখা। তবু ফেলে আসা বাবুয়ানি এতটুকু কমাননি তিনি। ঠিক যেরকম কমাননি তাঁর আশ্চর্য দানের নেশা।
কথা দিলে কথা রাখা তাঁর স্বভাব। খানিকটা পাগলামিই বলা চলে। লোকটা সুস্থ হয়ে ফিরে আসে হাসপাতাল থেকে। আর মাধবীর বাবা আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকেন আরও একটু ঋণ যদি কোথাও মেলে। কিন্তু না। সব চেষ্টা ব্যর্থ। নাক পর্যন্ত ঋণে ডুবে থাকা মানুষকে কে ঋণ দেবে? অথচ কথা রাখার নেশায়, দান করার নেশায় পাগল হয়ে যাওয়া মানুষটা তখন নিজেকে আরও আরও নেশায় ডুবিয়ে দিচ্ছেন। মাধবী চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে বাবা, যিনি ছাড়া তার সমস্ত পৃথিবীতে নিজের বলতে আর কেউ নেই, তিনি খুব দ্রুতগামী একটা ট্রেনে উঠে বসেছেন। যে ট্রেন সরাসরি অন্য পৃথিবীতে নিয়ে যায় মানুষকে।
-তারপর?
-তারপর মদের নেশায়, দানের নেশায়, কথা রাখার নেশায় পাগল একটা লোক আমাকে তুলে দিল গালবের হাতে। গালবের স্বর্গীয় ঋণমুক্তির এক সামান্য মানবী চাবিকাঠি। গালব আমায় নিয়ে গেলেন ইক্ষ্বাকু বংশের রাজা হর্যশ্বের কাছে। পুত্রহীন রাজা লুব্ধ হলেন। পুত্রহীন না হলেও লুব্ধ তো তিনি হতেনই। তখন আবহমান কবিদের কল্পনা মহাকাব্যিক রূপ নিয়ে নেমে এসেছে আমার শরীরে। আবহমানের পুরুষ আমায় ঢেকে রাখতে চাইছে পর্দা, ঘোমটা কিংবা হিজাবের তলায়। আর সমস্ত ঢাকনা সত্ত্বেও এই পৃথিবীর সমস্ত পুরুষের লোভ, শুধু লোভ হচ্ছে আমায় দেখে। গালবের ঋণমুক্তির সংগ্রহবাক্সে ধীরে ধীরে জমা হচ্ছে কাঙ্ক্ষিত অর্থ। কাশীপতি দিবোদাস, ভোজরাজ উশীনর, আরও কত কত রাজা। কত কত মুনি। কত কত পুরুষের লোভ মিটিয়ে আমার বাবা হচ্ছেন মহান! তাঁর বাক্য ঋণমুক্ত হচ্ছে।”
হঠাৎ এক অষ্টমীর সকালে আমাদের আখ্যান এইভাবে ঢুকে পড়ে একটা মহাকাব্যের ভেতর। সে দেখতে পায়, সবার সমস্ত প্রয়োজন মিটিয়েও তার বন্ধু মাধবী কেমন এক অনিঃশেষ কলস! প্রতিটি সংগমের পর কুমারীত্ব ফিরে পায় সে। সবার প্রয়োজন মিটে যাওয়ার পর একদিন মহা আয়োজন হল। নবপত্রিকা এল। এল মঙ্গলঘট। আলপনায় ঢেকে গেল সমস্ত পৃথিবী। পুজোর ভঙ্গি নিয়ে এই পৃথিবীর সমস্ত পুরুষ এগিয়ে গেল তার দিকে। বাবা বললেন, এইবার আমার মাধবী মা-র বিয়ে দেব।
অথচ মাধবী ততদিনে ব্যবহৃত, ব্যবহৃত আর ব্যবহৃত হতে হতে, সত্যি সত্যি লতা হয়ে গেছে। জানিয়ে দিয়েছে, সে আর কোনোদিন বিয়ে করবে না। হাঁটা দিয়েছে এক গভীর অরণ্যের দিকে।
সেই অরণ্যের গভীর থেকে উঠে এসে আমাদের আখ্যানের সঙ্গে একটা ঘর খুঁজতে বেরোয় সে। হেঁটে যায় কলকাতার রাস্তা দিয়ে। যে রাস্তায় থিকথিক করছে মানুষের ভিড়। সন্ধিপুজোর ঢাক বেজে উঠেছে।
৬
তারপর যযাতি সেই ঘরের মধ্যে হারিয়ে গেলেন। চকমেলানো মেঝে দিয়ে হেঁটে এসে বসে পড়লেন আরামকেদারায়। আলবোলা হাতে তুলে নিলেন। ঘর ভরে গেল অম্বুরী তামাকের সুবাসে। গ্রামোফোনে গান বেজে উঠল। বাবুল মোরা নৈহার ছুটহি যায়..
মানুষের বয়স না বাড়লে আরও বেশি ক্লান্তি এসে বসে চোখে মুখে। বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায় না যদিও। সময়ের অনেকগুলো দরজা পেরিয়ে এসেছেন যযাতি। সঙ্গে করে এনেছেন সময়ের ক্লান্তি। নবমীর ভিড় এখন ছড়িয়ে পড়েছে কলকাতায়। পূর্বাভাস মতোই আকাশ ছেয়ে এসেছে ঘন কালো মেঘে। হালকা একটা নেশা ধোঁয়া পাকিয়ে উঠেছে যযাতির মাথায়।
এই যে চোখে লাগার মতো সময় ধরে জরাকে ঠেকিয়ে রেখেছেন যযাতি, এ তো স্বাভাবিক নয়। চোখের সামনে মারা গেছে প্রিয় পুত্র। তার আয়ুই হয়তো চুরি করে ফেলেছেন তিনি। বুড়ো হয়ে যাওয়াকে বড়ো ভয় ছিল তাঁর। সেই ভয়ের কারণ ঘটেনি। নিয়মিত শরীরচর্চায় তাঁর বয়স বোঝা ভার। অথচ এখন, এই বিষণ্ণ নবমীর বিকেলে বসে যযাতির মনে হয়, এত দীর্ঘ জীবনও তিনি চাননি। জরা এসে অন্য পৃথিবীর দরজা খুলে দেয়। জরা আসেনি যযাতির শরীরে। কিন্তু খুলে গেছে আরেক পৃথিবীর দরজা। একে একে সবাই ছেড়ে গেছে তাঁকে। মেয়েও শেষ পর্যন্ত তাঁর কাছে থাকেনি।
এক নিস্পৃহতার চাদর যেন তাঁর সমস্ত অঙ্গে। সেইখানে এসে ঠিকরে পালিয়ে যায় সমস্ত ভালোবাসা। যে অনুপম প্রতিভা তাঁকে কার্যত রাজা করে তুলেছিল, সেই প্রতিভাই তাঁকে করে তুলেছে অনন্ত একা। পুরোনো শহরের সমস্ত পুরোনো জিনিস এসে জমা হয় তাঁর কাছে। সেই ফেলে আসা পৃথিবীর থেকে মাঝেমধ্যে বেরিয়ে আসেন যযাতি। হেঁটে বেড়ান কলকাতার রাস্তায়।
রাস্তাটা যা খুশি হতে পারে। ধরা যাক সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ। চাঁদনি। অথবা ধর্মতলা মোড়। গড়িয়াহাট বাজারও হতে পারে। মোট কথা, বেশ ব্যস্ত একটা রাস্তা। অনেক অচেনা মানুষের ভিড়। কেনাকাটা। পসরা। এইসব। এর মধ্যেই একজন মানুষ, বয়সের গাছ আর পাথর হারিয়ে ফেলে, সেগুলোকেই খুঁজে খুঁজে চলেছে।
আসলে তো পালানোর একটা দরজা খুঁজছেন তিনি। সেই দরজাটা কোথায় যযাতি জানেন। কিন্তু তালা দেওয়া। একটা বিশেষ জিনিস নিতে আসবে বিশেষ কেউ। তাকে সেই জিনিসটা দিয়ে যেতে পারলেই খুঁজে পাওয়া যাবে পালানোর দরজা। যযাতির পৃথিবীটা আসলে দুটো জগতের মাঝখানে। একদিকে আলো। পায়ে হাঁটা শহর। অনেক লোক। অনেক রাস্তা। পুজোর আওয়াজ। ছাতিমের গন্ধ। আরেকদিকে একটা গাঢ় অন্ধকার। জায়গাটা সম্ভবত কলকাতার তলাতেই। মাঝেমধ্যে সেখানকার দরজা খুলে যায়। আর এই দুটো পৃথিবীর মাঝখানে জেগে আছে যযাতির ঘর। অনাদিকাল ধরে একটা মানুষ ঝুলে আছে যেন দুটো শহরের ঠিক মাঝখানে।
কেউ একদিন আসবে। সে-ই খুঁজে নেবে যযাতিকে। তাকে একটা কিছু দিতে পারলেই খুলে যাবে কলকাতার নিচের দরজাটা।
আপাতত তার অপেক্ষা করছিলেন যযাতি। হঠাৎ বেজে উঠল আগমনীর সুর। অনেকদিন পর, নিভৃত অরণ্য থেকে উঠে এল তাঁর কন্যা। মাধবী। অনেকদিন পর। ষষ্ঠীর ঢাকে কাঠি পড়ল।
মাধবী। যযাতির মেয়ে। কোনও একটা কাজে অনেকদিন পর কলকাতায় এসেছে। কাজটা যযাতি জানেন না। জিজ্ঞেস করতে ভয় পান। নিজের মেয়েকে সত্যি বলতে খুবই ভয় পান তিনি।
এই দারুণ নবমী নিশিতে তাই যযাতির খুব ভয় হতে থাকে। নিশি অবসানে হয়তো মাধবী আবার লতা হয়ে হারিয়ে যাবে কলকাতার এই পার থেকে। আর কোনোদিন তাকে খুঁজে পাবেন না তিনি। মাধবী বলেছিল, তার কাজ শেষ হয়ে আসছে।
তাই ভয়ানক একটা ভয় এগিয়ে আসছে যযাতির দিকে। ঘড়ির কাঁটার প্রত্যেকটা শব্দ তাঁকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। প্রাণপণে তিনি চাইছেন এই রাত যেন শেষ না হয়। জাগপ্রদীপের আলো নিভে গেলেই ফিরে যাবে মেয়ে। যযাতির গ্রামোফোন ভেঙে সমস্ত কলকাতা জুড়ে ছড়িয়ে পড়বে সেই গান।
বাবুল মোরা নৈহার ছুটহি যায়।
Father, I'm leaving my home.
(ক্রমশ)