আখ্যানের খোঁজ (সপ্তম পর্ব)
[ষষ্ঠ পর্বের পর]
..................
১৫
মাধবীর বাবার ভেতর কখনই কোনও অ্যাটাচমেন্ট ছিল না। কেমন ছাড়া ছাড়া। কিছু মানুষ থাকে না যাঁদের হাত ঠিক রক্তমাংসের নয়? কেমন যেন এক জালি…। সমস্ত সম্পর্কই সেই জালি বেয়ে ঝরে পড়ে।
ভালোবাসলে তো ভালোবাসা বোঝাতেও হয়। যে কাঠ জ্বলেনি তাকে যেমন আগুন বলা যায় না, যে ভালোবাসা বোঝানোই হয়নি তাকে কি সম্পর্ক বলা যাবে? বাবার অনেক সম্পর্কের কথা শুনতে শুনতে বড়ো হয়েছে মাধবী। অথচ বাবা সবসময়েই একা। বাবার পাশে কোনও মানুষকেই কখনও দেখেনি সে। এমনকি মাকেও।
বাবা বলতেই মাধবীর মনে ভেসে আসে এক দীর্ঘ ছায়া। বিশাল মাঠের মধ্যে দিয়ে হেঁটে আসছে। মাঠের শূন্যতাকে ওই একটি মাত্র মানুষের ছায়া আরও বেশি শূন্য করে তুলেছে।
এই মানুষকে একাধিক মহিলা ভালবেসেছিল? ভাবতে অবাক লাগে মাধবীর। তারপর একদিন নাকি তারা সবাই বাবাকে ছেড়ে চলে গেল। অথবা বাবা এক আশ্চর্য সরাইখানা। ছেড়ে চলে যেতেই হয়।
সেই বাবাকে মনে পড়ে মাধবীর। একজন একলা মানুষ সকাল বিকেল ব্যায়াম করছেন। দৌড়োচ্ছেন। ছবি আঁকছেন। মাধবী শিশু থেকে কিশোরী হচ্ছে। কিশোরী থেকে যুবতী। বাবার বয়স বাড়ছে না। শুধু দিনদিন এক বিষণ্ণ মানুষ আরও বিষণ্ণ হয়ে পড়ছেন।
বাবাকে কি ভালবাসত মাধবী? সম্ভবত না। এ তার জিনের অন্ধকার। কোনও কিছুকেই আঁকড়ে ধরতে পারে না সে। পারে না ভালোবাসতে। মাধবীর প্রেম যেন সরে যাওয়া ছায়া। কোথাও বসবে না। কোনও মানুষের মধ্যে দেখতে পাবে না নিজের ঘর। এইটুকু মাত্র মিল তার বাবার সঙ্গে।
আর বাকিটা?
বাকিটা এক অন্ধ মানুষ। আটকে পড়েছে বদ্ধ ঘরে। অন্ধকার ছুঁয়ে ছুঁয়ে যে পৌঁছে যাচ্ছে এক দেওয়াল থেকে আরেক অন্ধ দেওয়ালে। হাতড়ে হাতড়ে খুঁজে চলেছে দরজা।
এই ঘরটা মাধবীর ভেতরেই। না হলে তো বনবিভাগের চাকরি নিয়ে সে কবে ছেড়ে এসেছে কলকাতা। কে যেন ফিসফিস করে তার কানে বলে গেছে,
বরানুৎক্রম্য সর্বাংস্তান্ বরং বৃতবতী বনম্।
অবতীর্য্য রথাৎ কন্যা নমস্কৃত্য চ বন্ধুষু।
কলকাতা শহর আর এই শহরের মানুষগুলোকে এখন অনেক দূর থেকে দেখে মাধবী। তার মনে হয় এই কলকাতার সমস্ত মানুষ আসলে একটা মস্ত চিড়িয়াখানায় থাকে। দূর থেকে তাদের দ্যাখে মাধবী। আর খুব মজা পায়।
কলকাতা থেকে চলে আসার সময় যে আখ্যানের মন খারাপ করছিল সেটা মাধবী বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু মাধবীকে তো আসতেই হত। সরকারি চাকরিতে ছুটি পাওয়া যায় ঠিকই। কিন্তু অনন্তকাল নয়। তাছাড়া আখ্যান খুব মাধবীর ওপর নির্ভর করতে শুরু করেছিল। সেটা বুঝতে পেরেই সরে আসে মাধবী। মাধবী জানে আখ্যান একদিন তার ঘর ঠিক খুঁজে পাবে। কিন্তু সেটা খুঁজে পেতে হবে তাকে নিজেকেই।
এই পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষকে একাই নিজের খোঁজ চালিয়ে যেতে হয়। অন্য কেউ সেই খোঁজের সঙ্গী হতে পারে না।
মাধবীর খোঁজেরই কি সঙ্গী হয়েছে কেউ? এই যে চিলাপাতার জঙ্গল ভেদ করে এগিয়ে যায় তার জিপ, এ কি কেবল টহল? নাকি সমস্ত বনজুড়ে কিছু খুঁজে চলে মাধবী?
চোরাশিকারের উপদ্রব এই বনে তেমন নেই। দক্ষ প্রশাসকের মতোই মাধবী একা হাতে সামলেছে সব। বনবিভাগের লোকের কাছে সে যেমন প্রিয়, ঠিক তেমনভাবেই প্রিয় পাহাড়ি গ্রামগুলোর মানুষদের কাছেও। মাধবীকে বনের থেকে আলাদা করে দেখতে পারে না কেউ। শুধু সবাই জানে ম্যাডাম দিনে একবার হলেও জঙ্গলে ঢুকবেন। ম্যাডামের জিপ আবছা হয়ে যাবে কুয়াশার পাহাড়ে। একসময় ম্যাডাম আর জঙ্গল এক হয়ে যাবে।
১৬
এই সেই সমুদ্রতীর। এইখানে এসেছিলেন যযাতি। এত আগে যে আগের জন্ম মনে হয়। অথবা আশেপাশের সবকিছু এত বদলে গেছে যে মনে হয় অন্য জন্ম। যে এসেছিল সে যেন অন্য কোনও মানুষ। কদিনের মৃগয়ায়। অথচ কেউ জানে না যযাতি গোপনে ভালোবেসে ফেলেন সেই দ্রুতগতি হরিণীকে। সঙ্গে সঙ্গে তার গায়ে উড়ে আসে দুঃখের ধুলো। কেউ জানে না, এইসব ধুলো এক গোপন বাক্সে জমিয়ে রাখছেন যযাতি। সেই বাক্সের ভার একটা সমুদ্রের সমস্ত জলের থেকে কম নয়।
হরিণী দ্রুতগতি। এসেছিল যত তাড়াতাড়ি, চলে গেল তার থেকেও জোরে। যযাতির ভেতর সে দেখতে পেয়েছিল আদিম বাঘ। যাদের গায়ের গন্ধে হরিণের রোম খাড়া হয়ে ওঠে। মাংসপেশিগুলো হয়ে ওঠে শক্ত। ফুসফুস আর হৃদয় প্রচন্ড জোরে কাজ করতে শুরু করে দেয়। শ্বাস ঘন হয়ে আসে। আর হরিণ হয়ে যায় এক আশ্চর্য হাওয়া। কত শতাব্দীর বাঘেরা যার পেছনে ছুটে বেড়ায় অথচ ধরতে পারে না।
তারপর ছুটতে ছুটতে ছুটতে সেই বাঘ বৃদ্ধ হয়। কমে যায় নখের ধার। একদিন সে ভুলে যায় হরিণ খাদ্য ছিল তার। ভক্ত যেমন ঈশ্বরের পেছনে ছোটে, অসম্ভব প্রেমিক যেমন ছোটে অসম্ভব প্রেমের পেছনে ঠিক তেমন সে ছুটতে থাকে। হরিণ তখন তো হাওয়া হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে দিগন্তে। সমুদ্রে সন্ধে নামছে। আর এক বাঘ প্রাণপণ দৌড়ে গিয়ে দিগন্তকে বোঝাতে চাইছে সে হরিণ শিকার করতে চায়নি। ভালোবেসে ফেলেছিল।
ভালোবাসা! যযাতিকে দেখে কেউ বলবে না যে সে ভালোবাসতে পারে। যে রঙিন জীবন উড়ে এসেছে যযাতির গায়ে সেখানে ভালোবাসা বড়ো শান্ত সমুদ্রতীর। যখন দৃষ্টিপথে কোনও মানুষ নেই। শুধু এক কৃষ্ণনীল জল মিশে যাচ্ছে আরেক রাধাকান্তি বিকেলের আলোয়। যা প্রচন্ড গ্রীষ্মে ঘড়ার জল। অথচ ঠিক গ্রীষ্মকালেই মানুষের জীবন থেকে হারিয়ে যায়। যযাতি তাঁর ছন্নজীবনে ভালোবেসেছিলেন ঠিক তেমন। কিন্তু বোঝাতে পারেননি কাউকে। নিজেকেও না। বোঝাতে পারেননি তিনি ভালোবেসেছিলেন দেবযানী আর শর্মিষ্ঠা দুজনকেই। বোঝাতে পারেননি এই পৃথিবীর সমস্ত ভালোবাসার মুখ একরকম নয়। বোঝাতে পারেননি একইসঙ্গে ভালোবাসা দুটি মেয়েকে আসলে ভীষণ আলাদাভাবে ভালোবাসেন তিনি। অলিন্দ আর নিলয় একই জায়গায় থাকে। কোনও একটি বাদ দিলে মানুষ চলে যায় মৃত পাখিদের দেশে।
অথচ অলিন্দ বোঝেনি এসব। সে একদিন বন্ধ হয়ে গেছে।
যযাতির মনে হয়েছে কেউ জোর করে ধাক্কা মেরে ঘর থেকে বের করে দিল তাকে। যযাতি পড়ে গেছেন। বড্ড লেগেছে তাঁর। অথচ অলিন্দ তাকিয়ে দেখেনি আর। বন্ধ হয়ে গেছে নিজস্ব অভিমানী আলোয়। এখন এক ছেঁড়া হৃদ্পিণ্ডের মানুষ প্রত্যেক সন্ধেবেলা মোকাম কলিকাতার সবচেয়ে পুরোনো পানশালায় এঁকে চলেছেন তাঁর ছবি। সময় বদলে যাচ্ছে। যুগ শেষ হয়ে যাচ্ছে। যযাতির ছবি শেষ হচ্ছে না।
তাঁর জীবনে নেমে এসেছে আচার্যের অভিশাপ। যৌবন পড়ে গেছে ফুটো কলসি বেয়ে। প্রচণ্ড প্রতিজ্ঞায় সেই যৌবন ফেরত নিয়েছেন তিনি।
কিন্তু যযাতির জীবনের সেই আকাশি জানলা বন্ধ হয়ে গেছে। সেখান দিয়ে আর কোনোদিন সমুদ্র দেখা যাবে না।
(ক্রমশ)
...........................
[অলংকরণ : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র]
আগের পর্ব পড়ুন : আখ্যানের খোঁজ (ষষ্ঠ পর্ব)