বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

জগদীশচন্দ্র ও সমকালীন বঙ্গসমাজ (নবম পর্ব)

অর্পণ পাল 10 days ago বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

পর্ব ৯ : রামমোহন লাইব্রেরি ও জগদীশচন্দ্র

...............

বাঙালি যে প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সত্যিকারের গর্ব বোধ করতে পারে, সে-তালিকায় অবশ্যই আছে রাজা রামমোহন রায়ের নামাঙ্কিত এই লাইব্রেরি। শতবর্ষ অতিক্রম করেছে অনেকদিন আগেই, এখনও তার পথচলা থামেনি। বিশ শতকের শুরুর দিকে বিজ্ঞানচর্চার আসন ছেড়ে জগদীশচন্দ্র বেশ অনেকটা সময় নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন এই লাইব্রেরির বিবিধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে। 

এই লাইব্রেরিতেই নোবেল পাওয়ার পর সংবর্ধনা জানানো হয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে। তারিখ ছিল ১৯১৪ সালের পয়লা ফেব্রুয়ারি। সেদিন তিনি সঙ্গে ‘গীতাঞ্জলি’ বইটি আনেননি বলে যখন কবিতা পাঠ করতে গিয়ে অসুবিধেয় পড়েন, তখন লাইব্রেরি-ভবনের দোতলা থেকেই তাঁর জন্য নিয়ে আসা হয় বইটি। তিনি পাঠ করেন: ‘রাত্রি যখন আঁধার হল’। 

১৯১৩ সালের ২৩ নভেম্বর নোবেল-জয়ের আনন্দে আয়োজিত শান্তিনিকেতনের বিশেষ সংবর্ধনা-সভায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর ক্ষোভ আর আক্ষেপ মিশিয়ে যে-সমস্ত কথা বলে উপস্থিত গণ্যমান্য ব্যক্তিদের পরম বিরাগভাজন হয়ে উঠেছিলেন, যেন তারই কৈফিয়ত দিতে ওই ঘটনার তিন মাসের কিছু বেশি সময় পরে রামমোহন লাইব্রেরির হলঘরে আয়োজন করা হয় এই অনুষ্ঠানের। তবে সংবর্ধনার বদলে এই অনুষ্ঠানের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘সাহিত্য আলোচনা সভা’। ওই মাসের চার তারিখের অমৃতবাজার পত্রিকায় যে খবরটি বেরিয়েছিল, সেখানে আবার শিরোনাম দেওয়া হয়েছিল ‘কনভার্সেশন অ্যাট রামমোহন লাইব্রেরি’। এই সভায় সভাপতি হয়েছিলেন পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী, আর উপস্থিত ছিলেন গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, নীলরতন সরকার, বিপিনচন্দ্র পাল এবং অবশ্যই জগদীশচন্দ্র। এই সভাতেই রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে কিছুদিন আগে তাঁর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যে অপ্রীতিকর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল, সে প্রসঙ্গ এনে নিজের কৃতকর্মের ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেন। 

এর পরে ওই ১৯১৪ সালেরই মার্চ মাসের ২৫ তারিখে লাইব্রেরির নবনির্মিত হলঘরে প্রথম বার্ষিক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন জগদীশচন্দ্র, এবং আরও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা। সভায় পৌরোহিত্য করেন বাংলার শিক্ষামন্ত্রী পি সি লায়ন; সভার বিবরণ পরের দিন ‘বেঙ্গলি’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। 

সেদিনের সভায় জগদীশচন্দ্র যা বলেছিলেন, তা উদ্ধৃত করি : 

‘তিনি বলেছিলেন এই লাইব্রেরিতে মানুষ হালকা বই পড়ে সময় নষ্ট করবার জন্য আসবে না। এখানে মননশীল রচনাবলি সকলকে উদ্‌বুদ্ধ করবে এবং এখানে এমন-সব আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হবে যা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার সম্পূরক হবে। এই উদ্দেশ্যেই লাইব্রেরিতে বইয়ের সংখ্যাবৃদ্ধির দিকে নজর না দিয়ে বইয়ের মানের দিকে লক্ষ রাখতে হবে।’ (* সারস্বত, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ৯৯ পৃ) 


২. 

রামমোহন লাইব্রেরির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বা জগদীশচন্দ্রের যোগাযোগ অনেক কালের। রবীন্দ্রনাথ এখানে সহ-সভাপতি ছিলেন ১৯১১ থেকে ১৯৪১, মানে প্রায় তিরিশ বছর। তাঁর আগে এই পদে ছিলেন ভগিনী নিবেদিতা, তাঁর মেয়াদ ছিল ছ-বছরের। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর সভাপতি হন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রও। 

এখানে দীর্ঘ চব্বিশ বছর (১৯১৩ থেকে ১৯৩৭ পর্যন্ত) সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব সামলেছিলেন জগদীশচন্দ্র, যুক্ত ছিলেন নানা সময়ে নানা কাজে। সেই হিসেবে ‘রামমোহন লাইব্রেরি আর জগদীশচন্দ্র’ শিরোনামে একটা অধ্যায় অবশ্যই থাকা উচিত। তবে সে-সব প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে এই লাইব্রেরি কীভাবে গড়ে উঠেছিল সে ব্যাপারে দু-চার কথা বলে নেওয়া দরকার। 

রাজা রামমোহন রায়ের স্মৃতির উদ্দেশ্যে কলকাতায় যে একটি লাইব্রেরি তৈরি করা হবে, এর উদ্যোগ চলছিল উনিশ শতকের শেষ দিক থেকেই। ১৮৮৬ সালে সিটি কলেজে রামমোহন রায়ের স্মৃতি রক্ষা করবার জন্য একটা সভা আয়োজিত হয়, সেখানে সভাপতি হয়েছিলেন মহেন্দ্রলাল সরকার। প্রস্তাব ওঠে যে রাম্মহ্ন রায়ের জন্য একটা স্মৃতিসৌধ গড়ে তোলা হবে। এরপর একদিন কলকাতায় আসেন এক সুইডিশ কার্ল এরিখ হ্যামারগেন (Karl Errich Hammergain) এ-দেশে আসেন রামমোহনের ওপর বই লিখবেন বলে। তিনিই প্রথম উদ্যোগ নিয়েছিলেন রামমোহনের স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে কোনো একটা লাইব্রেরি যাতে গড়ে তোলা যায়। কিন্তু ১৮৯৪ সালে নিতান্ত অল্পবয়সেই তাঁর মৃত্যু হয়, তাঁর পারলৌকিক ক্রিয়ার সময় রাজাবাজার থেকে আসেন চিকিৎসক ডঃ মোহিনীমোহন বসু, তিনি প্রথমেই এই প্রস্তাবিত লাইব্রেরির জন্য একশো টাকা দান করেন। 

কিন্তু সেই লাইব্রেরি তৈরি হতে লেগে যায় আরও প্রায় এগারো বছর। ১৯০৫-এর জানুয়ারি মাসের ২৪ তারিখে মানিকতলার কাছে রামমোহন রায়ের বসতবাড়ির কাছেই একটি ভাড়া বাড়িতে এই প্রস্তাবিত লাইব্রেরির প্রথম কার্যকরী কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়, আর সেদিনের পর থেকেই বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তাঁদের সংগ্রহ থেকে বইপত্র সদ্যস্থাপিত লাইব্রেরিতে দান করতে শুরু করেন। প্রায় তেরোশো বই নিয়ে লাইব্রেরিটি শুরু হলেও বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির দানে তা ক্রমেই পরিপুষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। ওই ১৯০৫ সালেই লাইব্রেরির সাম্মানিক সদস্য হয়েছিলেন বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি, যাঁদের মধ্যে দেখি রয়েছেন প্রফুল্লচন্দ্র রায়, এবং ভগিনী নিবেদিতাও। নিবেদিতা তাঁর সংগ্রহের বেশ কিছু বই এই লাইব্রেরিতে দান করেছিলেন। সেই হিসেবে এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলাদা কালপর্বে হলেও জড়িয়ে ছিলেন জগদীশচন্দ্র আর নিবেদিতা দু-জনেই। 

বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট বাঙালির অর্থানুকূল্যে সুকিয়া স্ট্রীট আর আপার সার্কুলার রোডের সংযোগস্থলে এই লাইব্রেরির প্রথম নিজস্ব ভবন গড়ে ওঠে আপার সার্কুলার রোডের ওপরেই, ১৯১৩-র ৯ই ডিসেম্বর তারিখে। উদ্বোধন করেন বাংলার ছোটলাট লর্ড কারমাইকেল। ঐ সভায় উপস্থিত ছিলেন লাইব্রেরির সভাপতি জগদীশচন্দ্র বসু এবং অবলা দেবীও। 

জগদীশচন্দ্র সেই ১৯১৩ সাল থেকে সভাপতি পদে ছিলেন আমৃত্যু, ১৯৩৭ সাল অবধি। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সংগ্রহের বেশ কিছু বই এই লাইব্রেরিতে দান করা হয়। আজও সেখানে গেলে চোখে পড়ে তাঁর নিজস্ব এক আলমারি বই পূর্ব দিকের দেওয়ালের সামনে দণ্ডায়মান। রামমোহন লাইব্রেরির সঙ্গে জগদীশচন্দ্রের সম্পর্ক বহুমুখী, নানা রঙে ভাস্বর। আমরা পরবর্তী অনুচ্ছেদে এই লাইব্রেরির সঙ্গে তাঁর বহুমুখী সম্পর্কের কিছু কিছু পরিচয়ের কথা সংক্ষেপে বলে নেব। 


    রামমোহন লাইব্রেরির অন্যান্য কর্মকাণ্ড 

রবীন্দ্রনাথকে নোবেল পাওয়ার পর প্রথম সংবর্ধনার কথা তো একটু আগেই বলেছি। এছাড়াও লাইব্রেরিটিকে কলকাতার জ্ঞানচর্চার মানচিত্রে এক বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী করে তুলতে সদস্যদের চেষ্টায় খামতি ছিল না। এরই অঙ্গ হিসেবে এখানে প্রতি শনিবার সন্ধেয় আলোচনাসভার আয়োজন করা হয়। কে আসতেন না সেই সভায় বক্তব্য রাখতে? রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চুনীলাল বসু, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের মতো বহু মানুষের নাম দেখি রয়েছে সেই তালিকায়। মোটামুটি ১৯৩৯ সাল অবধি নিয়মিত এই আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হত। জগদীশচন্দ্র নিজেও একবার বক্তৃতা দিয়েছিলেন ১৯১৮ সালে, সেটা পরে তাঁর ‘অব্যক্ত’ বইয়ে ‘আহত উদ্ভিদ’ নামে স্থান পেয়েছে। 


রামমোহন লাইব্রেরিতে তাঁর অন্যান্য কর্মকাণ্ড - ২ 

জগদীশচন্দ্র এই লাইব্রেরির জন্য কত ধরনের বিচিত্র কাজে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন, আজ জানলে অবাক লাগে। সেরকম কয়েকটা নমুনা: 

১. এই রামমোহন লাইব্রেরিতে জগদীশচন্দ্র ডেকে এনেছিলেন এক যুবককে, তাঁর নাম হেমচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। ইনি চারণ কবি মুকুন্দ দাসের দলে গান গাইতেন। ইনি মাঝেমধ্যেই আসতেন আর গান শোনাতেন। সেই গান মন দিয়ে শুনতেন জগদীশচন্দ্রও। 

২. ১৯১৫ সালে জগদীশচন্দ্র বিদেশ সফর থেকে ফিরে এলে এই লাইব্রেরির পক্ষ থেকে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এই সভায় উপস্থিত ছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র রায়ও। 

৩. এই লাইব্রেরির শতবর্ষ উপলক্ষ্যে প্রকাশিত স্মরণিকায় জগদীশচন্দ্রকে যথাযথভাবে গুরুত্ব দিয়ে স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানানো হয়েছিল। (* এই প্রসঙ্গ আছে ‘ঐতিহ্য উত্তরাধিকার ও প্রফুল্লচন্দ্র’, শ্যামল চক্রবর্তী, সাহিত্য সংসদ- এই বইয়ের ২০৮ পৃষ্ঠায়)। 

৪. জগদীশচন্দ্রের মৃত্যুর পর সভাপতি হন প্রফুল্লচন্দ্র। তিনিও ছিলেন আমৃত্যু, ১৯৪৪ সাল অবধি। রবীন্দ্রনাথও এই লাইব্রেরির সহ-সভাপতি ছিলেন ১৯১১ থেকে ১৯৪১ অবধি। 

আজ এই লাইব্রেরি সরকারী উদাসীনতায় অর্থাভাবে যখন ধুঁকছে, তখন এর গৌরবময় অতীত মনে করলে দুঃখ হওয়ার চেয়ে আফসোস হয় বেশি।

.................. 

 

#Jagadish chandra Bose #জগদীশচন্দ্র বসু #Indian Scientist #series #silly পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

130

Unique Visitors

206243