বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

জগদীশচন্দ্র ও সমকালীন বঙ্গসমাজ (একাদশ পর্ব)

অর্পণ পাল 6 days ago বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

পর্ব ১১ : জগদীশচন্দ্র ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়

...............

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়, আমরা সকলেই জানি ১৮৫৭ সালের জানুয়ারি মাসের ২৪ তারিখে, যে-বছরে দেশ দেখেছিল সিপাহি বিদ্রোহ। ওই বছরে এ-দেশে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়, যেগুলোর মধ্যে প্রথমটা অবশ্যই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানী কলকাতায়; বাকি দুটো বোম্বে আর মাদ্রাজে (প্রতিষ্ঠার তারিখ যথাক্রমে ১৮ জুলাই ও ৫ সেপ্টেম্বর)। সেই হিসেবে এই ‘কলিকাতা’ (ইংরেজিতে University of Calcutta; সূচনা থেকেই এই নামটাই লেখা হয়ে আসছে, যদিও আমরা এই লেখায় ‘কলকাতা’ ব্যবহার করেছি) বিশ্ববিদ্যালয় ভারতের প্রথম আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়। আর এর ঠিক পরের বছর (১৮৫৮) নভেম্বর মাসে জন্ম হয় জগদীশচন্দ্র বসুর। সেই হিসেবে ভারতের প্রথম পাশ্চাত্য ধাঁচে তৈরি বিশ্ববিদ্যালয় আর এই মহান বিজ্ঞানী প্রায় সমান-বয়সী।

প্রথমে হেয়ার স্কুলে অল্প কয়েক মাস, তারপর সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল এবং কলেজে পড়বার পর জগদীশচন্দ্র চলে যান বিলেতে, সেখানে একটানা পাঁচ বছর পড়াশুনো করে বিএসসি পাশ করে দেশে ফেরবার পর অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন প্রেসিডেন্সি কলেজে। সেটা ১৮৮৫ সাল। অবশ্য প্রথম দিকে তাঁকে অপেক্ষাকৃত উঁচু স্তরের ইম্পিরিয়াল সার্ভিসের অধীনে চাকরি দিতে বিস্তর গড়িমসি করেছিলেন সরকারি কর্তাব্যক্তিরা, তবু শেষ পর্যন্ত দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। আবার নেটিভ বলে তাঁর মাইনে ব্রিটিশ অধ্যাপকদের তিন ভাগের দু-ভাগ নির্ধারিত হওয়ায় এর প্রতিবাদ হিসেবে একটানা তিন বছর বিনা বেতনে চাকরি করে যান তিনি, আর তাঁর ওই প্রতিবাদের প্রেক্ষিতে সরকার তাঁকে পুরো মাইনেই দিতে সম্মত হয় তিন বছর পর।

প্রেসিডেন্সি কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রথম এ-দেশীয় অধ্যাপক তিনিই, তাঁর অধ্যাপনাকালে এই কলেজের সবচেয়ে বিখ্যাত শিক্ষক হিসেবে তাঁকেই গণ্য করা হত। পাশাপাশি উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে তাঁর নাম বিজ্ঞানী হিসেবে ভারতে এবং ভারতের বাইরেও ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ব্রিটিশ সরকারও বাধ্য হয়েছিল তাঁর গবেষণার জন্য অর্থ বরাদ্দ করতে। এদেশীয়দের মধ্যে অন্য অনেকের চেয়েই অনেক বেশি খ্যাতিমান হয়ে যাওয়ার কারণেই আমরা দেখি যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু কাজে তাঁকে যুক্ত হতে হয়েছিল জীবনের নানা পর্বে। এই ধারাবাহিকের দুটো পর্ব জুড়ে আমরা জগদীশচন্দ্রের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের নানাবিধ কাজকর্মের একটা রূপরেখা অঙ্কনের চেষ্টা করব। তবে তার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিকের কিছু কথা বলে নেওয়া দরকার।

২.
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনা পর্বে বছর কয়েক কাজকর্ম চলত ক্যামাক স্ট্রিটের একটি অস্থায়ী ভবন থেকে, কলেজ স্কোয়ারের পশ্চিম দিকের মূল ভবনটি তৈরির কাজ শুরু হয় ১৮৬৪ সালে আর শেষ হয় ১৮৭২-এ। প্রতিষ্ঠানের মূল জায়গা হিসেবে বাছা হয়েছিল হেয়ার স্কুলের দক্ষিণ দিকে। মূল ভবনের সঙ্গেই তৈরি হয় সেনেট হল (যদিও অনেক পরে ১৯৬২ সালে সেই ঐতিহ্যমণ্ডিত হলটি ভেঙে ফেলা হয়েছে)। ধাপে-ধাপে এরপর শুরু হয় বিভিন্ন বৃত্তি বা স্কলারশিপ দেওয়া বা অধ্যাপক পদ তৈরির কাজ। বা বিভিন্ন স্কুল-কলেজকে অনুমোদন দেওয়া।


ছবি: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (নির্মাণকালের কাছাকাছি সময়ে ফ্রান্সিস ফ্রিথ-এর আঁকা। উইকিমিডিয়া কমন্‌স থেকে নেওয়া)

......

এটা অবশ্যই এখানে বলে নেওয়া দরকার যে তৈরি হওয়ার পর থেকে বেশ কয়েক দশক এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠন-পাঠনের কোনও ব্যবস্থা ছিল না। এর কাজ ছিল পরীক্ষা নেওয়া, এবং ফলাফল তৈরি করা আর ডিগ্রি দেওয়া। তখন সুদূর পাঞ্জাব বা পূর্ব দিকে ব্রহ্মদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ড। তবে স্নাতক স্তরের পাশাপাশি স্নাতকোত্তর স্তরের পড়ানোর কাজ হত প্রেসিডেন্সি বা জেভিয়ার্সের মতো কলেজগুলোয়। অনেক পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তর বিভাগ শুরু হয় রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজে। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় কাজকর্ম চালানোর মূল ক্ষমতা দেওয়া ছিল সরকার অনুমোদিত সেনেট সদস্য বা ফেলোদের ওপর (নির্বাচন করতেন গভর্নর জেনারেল, আর সংখ্যায় এঁরা থাকতেন কমপক্ষে তিরিশজন)। এঁরা আবার নির্বাচন করতেন চারটি ফ্যাকাল্টি বা অনুষদের সদস্যদের; এই অনুষদগুলি হল কলা, আইন, মেডিসিন আর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং। আবার সেনেটে কোনও বিষয় আলোচনার জন্য আগে সেটাকে পাশ করতে হত সিন্ডিকেট থেকে, এই সিন্ডিকেট তৈরি করা হত চারটি অনুষদ থেকে বেছে নেওয়া মোট ছ-জন সদস্য নিয়ে (এঁদের মধ্যে থাকতেন উপাচার্যও)। সিন্ডিকেট আর সেনেট, এই দুটোই ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম-তৈরির আলোচক-দল। আর সেনেটের সিদ্ধান্তকে যখন গভর্নর জেনারেল অনুমোদন দিতেন, তখন সেটা পরিণত হত আইনে বা নিয়ম, তার পর সেটা চালু হত। 

প্রথম বছর থেকেই এন্ট্রান্স পরীক্ষা নেওয়া শুরু করে এই প্রতিষ্ঠান, অবশ্য বিএ পরীক্ষার ভার নেওয়া শুরু হয় পরের বছর থেকে। প্রথম যে দুজন বিএ পাশ করেছিলেন, তাঁদের একজনকে আমরা সকলেই চিনি, তিনি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। অন্যজন যদুনাথ বসু। এই হিসেবে বঙ্কিমচন্দ্রই এ-দেশের প্রথম স্নাতক। শুরু হওয়ার পর প্রতি বছরই ধাপে-ধাপে ছাত্রসংখ্যা বাড়তে থাকে। 

প্রথম দিকে বিএ অনার্স-সহ পাশ করলে এমএ পড়া যেত। তখন দেখা গিয়েছিল যে এন্ট্রান্স পাশ করবার পর প্রায় সকলেই চাকরি করবার দিকে চলে যাচ্ছে, খুব অল্প সংখ্যক কয়েকজন আসছে বিএ পড়তে। তাই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ম করে দেয় যে এই দুটো পরীক্ষার মাঝখানে এফএ বা ফার্স্ট আর্টস নামে একটি ডিগ্রি দেওয়ার প্রথা চালু হবে। যেটা এখনকার হিসেবে উচ্চমাধ্যমিকের মতন। আর এই পরীক্ষার জন্যেই জগদীশচন্দ্র পরীক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন ১৮৮৭ সালের জুলাই মাস থেকে। পদার্থবিদ্যা শাখায় তাঁর সঙ্গেই পরীক্ষক নিযুক্ত হন সেন্ট জেভিয়ার্সের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক ফাদার ইউজিন লাফোঁ। যিনি আবার এক কালে জগদীশচন্দ্রেরই শিক্ষক ছিলেন। বাকি দু-জন ছিলেন ব্রিটিশ। 

শুধু পরীক্ষক হিসেবে নয়, তাঁর ওপর ছিল প্রশ্নপত্র তৈরির দায়িত্বও। ওই সময় তিনি বানিয়েছিলেন আলো আর তড়িৎবিদ্যার ওপর প্রশ্ন। পরের বছর তাঁর ওপর দায়িত্ব আরও বেড়ে যায়, তিনি বিএ পরীক্ষারও পদার্থবিদ্যা বিভাগের পরীক্ষক হন। আরও এক পর ১৮৮৯ সাল থেকে তাঁর মুকুটে আরও একটি পালক যুক্ত হয়, তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো নির্বাচিত হন (সে বছর তাঁরই সঙ্গে ফেলো হয়েছিলেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়)। মনে রাখা দরকার যে তখনও তিনি সকলের কাছে প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক হিসেবেই স্রেফ পরিচিত, বিজ্ঞান-গবেষণায় তাঁর দক্ষতা বা খ্যাতি তখনও মোটেই প্রকাশ্যে আসেনি। অবশ্য তখন তিনি বউবাজারে মহেন্দ্রলাল সরকারের প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অভ সায়েন্স’-এ প্রায় নিয়মিত বক্তৃতা দিতে যাচ্ছেন। আমরা দেখি যে ওই সময়ে জগদীশচন্দ্রেরই সঙ্গে পদার্থবিদ্যা বিভাগের পরীক্ষক হিসেবে কাজ করছিলেন মহেন্দ্রলাল সরকারও। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের আরও নানা দিক আমরা দেখতে পাব, আগামী পর্বে। 

……………………… 

#Jagadish Chandra Bose #Scientist #জগদীশচন্দ্র বসু #series #প্রবন্ধ #silly পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

36

Unique Visitors

207835