জগদীশচন্দ্র ও সমকালীন বঙ্গসমাজ (চতুর্দশ পর্ব)
পর্ব ১৪ : বিপ্লবী-সঙ্গে জগদীশচন্দ্র (২)
.........
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের বিপ্লবী সংযোগ
শিয়ালদার কাছে একটা ব্যস্ত রাস্তার নাম বিবি গাঙ্গুলি স্ট্রিট। যাঁর নামে এই রাস্তা, সেই বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি ছিলেন বিখ্যাত বিপ্লবী। ১৯১৪ সালে রডা কোম্পানির যে অস্ত্র-অপহরণের কাণ্ড ঘটে, সেই দলে তিনিও ছিলেন।
এই বিবি গাঙ্গুলির মোড়ে যে শহিদ বেদী, সেখান থেকে কলেজ স্ট্রিট ধরে মেডিক্যাল কলেজের দিকে একটু এগোলে চোখে পড়বে একটা তিনতলা বাড়ি। ঠিকানা ১১০ নম্বর কলেজ স্ট্রিট। ছানাপট্টির কাছের এই বাড়িটি বিশ শতকের প্রথম দিকে ১৯১১ থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত পরিচিত ছিল ডঃ রায়ের মেসবাড়ি হিসেবে। এখানে তখন ভাড়াটে হিসেবে থাকতেন একদল বিজ্ঞানের ছাত্র; মেঘনাদ সাহা, নীলরতন ধর আর তাঁর ছোট ভাই জীবনরতন ধর, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, সতীশচন্দ্র সেন, ক্ষিতীশচন্দ্র সেন— এরকম অনেকেই। এঁদের মধ্যে মেঘনাদ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ, নীলরতন ছিলেন সহপাঠী। ইডেন হিন্দু হোস্টেল থেকে জ্ঞানচন্দ্র আর মেঘনাদ এখানেই এসে উঠেছিলেন।
এই বাড়িতেই ওই সময়কালে এসে আড্ডা বসাতেন মেসের মালিক আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র। তাঁর নাম তখন এখানে পরিচিত ছিল ‘ডাক্তারবাবু’ হিসেবে। যে-কারণে সকলে এই মেসটিকে ডাক্তারবাবুর মেস-ও বলত। রোজ বিকেলে দেখা যেত একটা ঘোড়ায় টানা গাড়িতে চেপে তিনি এসে হাজির হয়েছেন এখানে। তারপর বসত আড্ডা। আবার তাঁর দেখাদেখি আসতেন বঙ্গবাসী কলেজের অধ্যক্ষ গিরিশচন্দ্র বসু, সত্যানন্দ বসু, কবিরাজ উপেন্দ্রনাথ সেন-এর মতো আরও একাধিক গুণী বাঙালি। কখনও এঁরা প্রত্যেকে এখান থেকে সদলবলে চলে যেতেন ময়দানে, তারপর লর্ড রবার্ট-এর মূর্তির নিচে বসত আড্ডার দ্বিতীয় কিস্তি। প্রায় দু-ঘন্টা ধরে চলত এই আড্ডা। কী না আলোচনা হত সেখানে? ইতিহাস, রাজনীতি, সমাজনীতি থেকে শুরু করে সংস্কৃতির আনাচেকানাচে বিহার করতেন সবাই ওই দু-ঘণ্টা ধরে। সত্যানন্দ বসু এখানে এলে বসে থাকতেন না, বেশিরভাগ সময়ই তাঁকে দেখা যেত দাঁড়িয়ে থাকতে। যে-কারণে প্রফুল্লচন্দ্র তাঁর নাম দেন ‘স্ট্যান্ডিং কাউন্সেল’। আরও অনেকেরই এরকম অস্বাভাবিক সব নাম জুটে গিয়েছিল। যেমন জ্ঞানেন্দ্রনাথ, জ্ঞানচন্দ্র, জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায় পরিচিত হয়েছিলেন জ্ঞানত্রয় হিসেবে, দেবপ্রসাদ ঘোষ যুদ্ধের কলাকৌশলে পারদর্শী বলে তাঁর নাম ‘ট্যাকটিশিয়ান’— এরকম।
ময়দানের এই আড্ডা পরিচিত হয়েছিল ময়দান ক্লাব নামে। আর এই নামকরণের পেছনে রয়েছেন এক বিখ্যাত ব্যক্তি মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। প্রফুল্লচন্দ্রের সঙ্গে যাঁর খুব ভালো বন্ধুত্ব হবে কয়েক বছর পর।
এই আড্ডাতেই আসতেন এক তরুণ। তখন তাঁর বয়স তেত্রিশ-চৌত্রিশ, মেঘনাদ সাহার মাধ্যমেই তাঁর এখানে আসা। ততদিনে তিনি নানা বিপ্লবী গুপ্ত সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন, বিদেশ থেকে অস্ত্রশস্ত্র এনে সশস্ত্র বিপ্লব ঘটিয়ে দেশকে স্বাধীন করবার স্বপ্ন দেখছেন।
অল্প কয়েক বছর পরে ১৯১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ওড়িশায় বুড়িবালামের তীরে ব্রিটিশদের সঙ্গে এক খণ্ডযুদ্ধে তাঁর মৃত্যু হয়। তারপর গোটা বাংলা তাঁকে চিনে যায়। তাঁর নাম যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, যদিও আরও বেশি মানুষ তাঁকে চেনেন বাঘাযতীন নামে। এই মেসে বসেই নাকি তিনি চোরা-আক্রমণের নানা পরিকল্পনা করতেন অন্যদের সঙ্গে মিলে।
এই বাঘাযতীনকে নিয়ে রয়েছে আরও এক কাহিনি। একদিন সকলের কাছে খবর আসে যে যতীন্দ্রনাথ এখান থেকে বেরিয়ে আহিরীটোলায় এক পুলিশ অফিসারকে গুলি করে মেরে দিয়েছেন। শুনে সকলের তো আক্কেল গুড়ুম। এবার মেসে যদি পুলিশ হানা দেয়! আরও জানা গেল, যতীন্দ্রনাথের হাতে ছিল জ্ঞানচন্দ্রের নাম লেখা একটা বই। এটা শুনে তো সকলের আতঙ্কের পরিমাণ আরও কয়েক গুণ বেড়ে গেল। যদিও পরে পুলিশ আসেনি, সকলের স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়েছিল।
২.
প্রায় গোটা জীবন যিনি বিজ্ঞানের অন্দরমহলে কাটিয়েছিলেন, সেই জগদীশচন্দ্রের সঙ্গে প্রফুল্লচন্দ্রের সবচেয়ে বড় তফাৎ এটাই যে, গবেষণাগারের বাইরেও যে একটা প্রকাণ্ড জগত রয়েছে, সেটা প্রফুল্লচন্দ্র খুব ভালো জানতেন এবং মানতেন। তাই দেখি ছাত্রদেরকে বিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট করবার পাশাপাশি তিনি তাঁদের দীক্ষিত করছেন জাতীয়তাবাদে। তিনি একবার বলেছিলেন, ‘Science can afford to wait but Swaraj cannot’(বিজ্ঞান অপেক্ষা করতে পারে, স্বরাজ নয়।) দেশের মানুষকে স্বয়ংসম্পূর্ণতার পাঠ শেখাতে নিজেই শুরু করেছিলেন রাসায়নিক-নির্ভর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল কেমিক্যাল, যা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিল যে গবেষণাগারের বাইরে বেরিয়েও একজন বিজ্ঞানী ব্যবসায়ী হয়ে উঠতে পারেন, নিজের কোম্পানিকে লাভজনক জায়গায় পৌঁছে দিতে পারেন।
স্বদেশী কর্মসূচির একটা বড় অংশ তখন আস্থা রেখেছিল গান্ধিজি প্রবর্তিত অহিংস আন্দোলনে। যার একটা বড় উপবিভাগ হিসেবে দেখানো হয় দেশীয় জিনিসপত্রের প্রসার ও ব্যবহারের দিকে জোর দেওয়ার কর্মসূচিকে। দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতেই গান্ধিজি চরকার প্রবর্তন করেন। তাঁর এই কর্মসূচিতে তিনি সম্পূর্ণভাবেই পাশে পেয়েছিলেন প্রফুল্লচন্দ্রকে। গান্ধিজির এতটাই ভক্ত হয়ে উঠেছিলেন যে তিনি নিজেই বলতেন ‘I m the disciple of the semi-naked fakir’ (* উৎস: ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলার বোমা, রাজর্ষি ঘোষ, খোয়াবনামা, ৮৭ পৃ)
গান্ধিজির সঙ্গে প্রফুল্লচন্দ্রের আলাপ ১৯০১ সালে। সে-বছর গোপালকৃষ্ণ গোখলে-র সঙ্গে গান্ধিজি এসেছিলেন কলকাতায়। তখনও গান্ধিজি সরাসরি এ-দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেননি। দক্ষিণ আফ্রিকা ফেরত ব্যারিস্টারের জন্য সেবারে কলকাতায় আলবার্ট হলে একটা সভার আয়োজন করা হয়েছিল, যে উদ্যোগে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র।
প্রথম আলাপের সেই সময় প্রফুল্লচন্দ্রকে দেখিয়ে গোপালকৃষ্ণ বলেছিলেন, ইনি হলেন ডঃ রায়, যিনি মাসে আটশো টাকা মাইনে পেয়েও নিজের জন্য মাত্র চল্লিশ টাকা রেখে বাকিটা মানুষের কল্যাণে দান করে দেন। ইনি বিয়ে করেননি, আর করতেও চান না। আরও পরে গান্ধিজি প্রফুলচন্দ্রকে বাংলায় চরকা আর খাদির প্রচারের দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন। সেই কাজটা প্রফুল্লচন্দ্র যথেষ্ট নিষ্ঠার সঙ্গেই পালন করতেন। ব্রজেন্দ্রনাথ শীল তাঁকে এজন্য ‘চরকর্ষি’ (চরকা+ঋষি) উপাধিও দিয়েছিলেন। প্রফুল্লচন্দ্র হিসেব করে দেখেছিলেন, বাংলার সাড়ে চার কোটি মানুষের মধ্যে যদি এক তৃতীয়াংশ, মানে দেড় কোটি মানুষ যদি চরকা কাটেন, তবে সকলের সামগ্রিক আয় দেড় কোটি টাকায় পৌঁছে যাবে!
তবে এমনটা মনে করবার কোনো কারণ নেই যে গান্ধিজির অহিংস আন্দোলনে আস্থা ছিল বলেই তিনি সশস্ত্র বিপ্লবীদের কাজকর্মের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন না। বরং বাস্তবে এর উলটোটাই ঘটেছিল। যখনই তিনি সময় বা সুযোগ পেয়েছেন, সাহায্য করেছেন এই বিপ্লবীদের। এঁদের প্রতি তাঁর ভালোবাসা বা কোমল মনোভাবে কোনো ঘাটতি ছিল না। ১৯০৮ সালে যখন মুরারিপুকুর বাগান বাড়িতে বিপ্লবীরা ধরা পড়ে, তখন তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চেয়েছিলেন যে বিপ্লবীরা কি সকলেই ধরা পরেছে? (* উৎস: ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলার বোমা, রাজর্ষি ঘোষ, খোয়াবনামা, ৯০ পৃ থেকে নেওয়া হল।)
৩.
ঢাকায় অনুশীলন সমিতির একটা শাখা খুলেছিলেন পুলিনবিহারী দাস, ১৯০৫ সালের নভেম্বর মাসে। পরে এর আরও বেশ কয়েকটা শাখাও তৈরি হয় কাশী, দিল্লি বা লাহোরেও। পুলিনবিহারী ঢাকায় ‘ন্যাশনাল স্কুল’ নামে এক প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন। স্কুল বলে পরিচিত হলেও আদতে এটা ছিল গোপনে বিপ্লবীদের ট্রেনিং দেওয়ার একটা প্রতিষ্ঠান। এখানেই অনুশীলন সমিতির সদস্যদের নানা ধরনের অস্ত্রচালনা আর লাঠি, ছোরা বা তলোয়ার-চালনার ট্রেনিং দিয়ে তাদের বিপ্লবের জন্য তৈরি করে উপযুক্ত করে তোলা হত। এই ধরনের শিক্ষা-ব্যবস্থা নিয়ে পুলিনবিহারি একটা বইও লিখেছিলেন, নাম ‘লাঠিখেলা ও অসিশিক্ষা’।
পুলিনবিহারী শিখেছিলেন বোমা তৈরির পদ্ধতিও। এমনটা বলা হয়ে থাকে যে ঢাকায় এসে তাঁকে এই ব্যাপারে বেশ কিছু শিক্ষাদান করেছিলেন স্বয়ং প্রফুল্লচন্দ্র। তাঁকে প্রফুল্লচন্দ্র এ-ও জানিয়েছিলেন যে তাঁর কয়েকজন অনুগত ছাত্রের মাধ্যমে বোমা আর বিস্ফোরক তৈরির জন্য সাহায্য করবেন।
প্রফুল্লচন্দ্র রায় যে প্রেসিডেন্সি কলেজে তাঁর ল্যাবরেটরিকে এই ধরনের কাজে ব্যবহার করেছেন, তার প্রমাণ রয়েছে রমেশচন্দ্র মজুমদারের ‘History of the Freedom Movement in India’ বইয়ে (Vol. II, 1963, 474 pp.), শঙ্করীপ্রসাদ বসুর অনুবাদে দেখি:
‘বিখ্যাত রাসায়নিক এবং যথার্থ বাঙালী দেশপ্রেমিক আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় কীভাবে বোমা-তন্ত্রের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করতেন তা এক বিপ্লবীর স্মৃতিকথায় বর্ণিত আছে। ঢাকা অনুশীলন সমিতির নেতা পুলিনবিহারী দাসের সঙ্গে তাঁর গোপন সাক্ষাৎ হয়েছিল, ... এবং তিনি নিজের কয়েকজন বিশ্বস্ত ছাত্রের সাহায্যে বিস্ফোরক প্রস্তুতির ভার গ্রহণ করতে স্বীকৃত হয়েছিলেন।’ (* নিবেদিতা লোকমাতা ২য় খণ্ড, শঙ্করীপ্রসাদ বসু, আনন্দ, ৩২ পৃ।)
বিপ্লবীদের প্রতি প্রফুল্লচন্দ্র কীরকম মনোভাব পোষণ করতেন, তার আরও একটা প্রমাণ মেলে তেষট্টি দিন অনশনের পর যখন লাহোর সেন্ট্রাল জেলে যতীন দাসের মৃত্যু হয় ১৯২৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর। প্রফুল্লচন্দ্র তখন ছিলেন ফরিদপুরে। খবর পেয়ে তিনি ভেঙে পড়েন, বেশ কিছুক্ষণ নাকি কারও সঙ্গে কথা বলেননি, জানা যায় দেবেন্দ্রনাথ মিত্রের লেখা একটি চিঠি থেকে। ফরিদপুরে যতীন দাসের স্মৃতিতে যে শোকসভা হয়, সেখানে প্রফুল্লচন্দ্রকে সভাপতি করা হয়েছিল। তিনি সেই সভায় খালি পায়ে উপস্থিত হয়েছিলেন।
ফরিদপুর থেকে কলকাতায় ফিরে প্রফুল্লচন্দ্র রায় উপস্থিত হয়েছিলেন হাওড়া স্টেশনে, যতীন দাসের মরদেহে শ্রদ্ধা জানাতে।
এই ধারাবাহিকের পরের পর্বে আমরা দেখব, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র আর জগদীশচন্দ্র কীভাবে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিপ্লবীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন নানা সময়ে।
..................
#Jagadish Chandra Bose #Scientist #জগদীশচন্দ্র বসু #series #ধারাবাহিক #silly পয়েন্ট