বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

জগদীশচন্দ্র ও সমকালীন বঙ্গসমাজ (ত্রয়োদশ পর্ব)

অর্পণ পাল Oct 13, 2024 at 5:39 am বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

পর্ব ১৩ : বিপ্লবী-সঙ্গে জগদীশচন্দ্র (১)

............

বাংলায় বিপ্লববাদ নিয়ে কিছু সাধারণ কথা 

ঠিক যে-বছর উনিশ থেকে বিশ শতকে পাড়ি দিল গোটা বিশ্ব, সেই সঙ্গে বাংলাও, একেবারে ওই সময় থেকেই বাংলার রাজনৈতিক চালচিত্রে বেশ বড় রকমের বদল ঘটতে শুরু করল। 

বঙ্কিমচন্দ্র আগের শতকের শেষ দিকে লিখেছিলেন ‘আনন্দমঠ’। সেটা ছিল ১৮৮২ সাল। সেই উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছিল অনুশীলন তত্ত্বের বেশ কিছু দিক। ওখানে বঙ্কিমচন্দ্র কালীমূর্তির যে-বর্ণনা দিয়েছিলেন, তার সঙ্গে বেশ মিল পাওয়া যায় পরবর্তীকালের ভারতমাতা-র চেহারার সঙ্গে। এই উপন্যাস রচনাকালের প্রায় একই সময়েই বাংলার বুকে তৈরি হয় প্রথম গুপ্ত সমিতি— যার নাম সঞ্জীবনী সভা। এর মুখ্য উদ্যোক্তা ছিলেন রাজনারায়ণ বসু। এই সমিতির সদস্য হয়েছিলেন ঠাকুরবাড়ির একাধিক ব্যক্তি, যাঁদের মধ্যে তরুণ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এবং সদ্য কৈশোর-উত্তীর্ণ রবীন্দ্রনাথও ছিলেন। তবে এই সমিতি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’-তে এই সমিতি সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডের বর্ণনা দিয়েছিলেন বেশ রসিকতা করেই। 

মূলত ‘আনন্দমঠ’-এর ওই ব্রহ্মচারী-সংঘের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে একদল বাঙালি যুবক বিশ শতাব্দীর শুরুতে ১৯০২ সালের ২৪ মার্চ দোলপূর্ণিমার দিনে হেদুয়ার কাছে ২১ নম্বর মদন মিত্র লেনে গড়ে তোলেন এক সমিতি এবং ব্যায়ামের আখড়া। নাম দিলেন অনুশীলন সমিতি। প্রধান উদ্যোক্তা ব্যারিস্টার প্রমথনাথ মিত্র (১৮৫৩ - ১৯১০), তিনিই ছিলেন প্রথম সভাপতি। জাতীয়তাবাদী এই মানুষটি ব্যারিস্টারি পাশ করেন লন্ডন থেকে। দেশে ফিরে জড়িয়ে পড়লেন সমিতির কাজে। সঙ্গী হিসেবে ইনি পেয়েছিলেন সতীশচন্দ্র বসুকে। তবে দুত কথা এখানে বলে নেওয়া দরকার— প্রথমত, বাংলার বুকে এই ধরনের গুপ্ত সমিতি উনিশ শতকের শেষ দশকে তৈরি হয়েছিল আরও কয়েকটা; এবং দ্বিতীয়ত এই অনুশীলন সমিতি কিন্তু প্রথম দিকে গুপ্ত ছিল না এবং এর কোনো রাজনৈতিক সত্তাও তৈরি হয়নি। এ-সবই অরবিন্দ ঘোষ যোগ দেওয়ার পরের ভোলবদল। 

মনে রাখা দরকার, এই সমিতি তৈরির সময় বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের কোনো চিহ্ন দেখা যায়নি কোথাও। যদিও ব্রিটিশ বিরোধী হাওয়া বেশ বইতে শুরু করেছে এদিক ওদিক থেকে। বাংলায় পরবর্তী কয়েক বছর যে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি হবে সশস্ত্র বিপ্লববাদের সৌজন্যে, তার লেশমাত্র তখনও দেখা যাচ্ছিল না কোথাও। এই সমিতির সূচনা হওয়ার মধ্যে দিয়ে আসন্ন দিনগুলোকে অগ্নিস্নাত করবার জন্য যেন এক সলতে পাকিয়ে রাখা হল। 

প্রকৃত অর্থে সশস্ত্র বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সূচনা কিন্তু বাংলায় নয়, সেই সুদূর মহারাষ্ট্রে। সেখানকার বাসুদেও বলবন্ত্‌ ফাড়কে দারুণ এক কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন আগের শতকের শেষ দিকে। ব্রিটিশ সরকারী মিলিটারি ফিনান্স অফিসের এক ক্লার্ক মায়ের অসুস্থতার জন্য ছুটি চেয়েছিলেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে, কিন্তু সেই ছুটি মঞ্জুর হয়নি। তাঁর মায়ের যখন মৃত্যু হয়, সেই শেষ সময়ে তিনি মায়ের পাশে আসতেই পারেননি। এই ঘটনা বাসুদেও-র মনে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি প্রবল বিদ্বেষ তৈরি হল। প্রথমে চাকরি ছাড়লেন, তারপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলন সংঘটিত করবার কাজে। ক্রমে তাঁর দল তৈরি হল, সেই দলের অধিকাংশ সদস্যই সমাজের তথাকথিত ‘নিচু’ শ্রেণীর। এঁদেরকে নানাভাবে ট্রেনিং দেওয়া হতে থাকল লড়াইয়ের জন্য উপযুক্ত হতে। মোটামুটি ১৮৭৯ সালের মধ্যে তাঁর এই দল বেশ বড় মাপের এক সংগঠনে পরিণত হয়। নাম দেওয়া হয় ‘২০০ নং স্ট্রং মিলিশিয়া’। এটাকেই ভারতের প্রথম সশস্ত্র বিপ্লবী সেনাবাহিনি হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। 

বাসুদেও এরপর বহু ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে ছিলেন কয়েক মাস। যার মধ্যে ছিল ডাকাতি করে অর্থ সংগ্রহ, সেই অর্থে অস্ত্র কেনা, ব্রিটিশদের সঙ্গে বারকয়েক সশস্ত্র লড়াই, আত্মগোপন করে একাধিক জায়গায় সংগঠনের কাজ চালিয়ে যাওয়া। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁকে ধরা পড়তে হয়। জেল থেকে তিনি পালিয়ে যান, যদিও আবার ধরা পড়েন এবং জীবনের শেষ দিকে জেলেই মুক্তির দাবিতে আমরণ অনশন করেছিলেন। ১৮৮৩ সালের জুলাই মাসে তাঁর মৃত্যু হয়। মহারাষ্ট্রে এরপরেও একাধিক সশস্ত্র সংগ্রামের ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করব, তবে এই ধরনের কাজের মূল ভরকেন্দ্রটা বিশ শতকের শুরু থেকেই বাংলা-র আয়ত্তাধীন হয়ে পড়ে। 

এই শতকের শুরুর দিকে জগদীশচন্দ্র যখন প্রেসিডেন্সি কলেজের অপ্রশস্ত গবেষণাগারে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের নেশায়, তখন বাইরের জগৎ মোটেই শান্ত নেই। 


অনুশীলন সমিতি ও অরবিন্দ-র কথা 

অনুশীলন সমিতি তৈরি হওয়ার পর কয়েক বছরের মধ্যেই প্রথমে কলকাতার একাধিক জায়গায় এবং তারপর বহু জেলায় অসংখ্য শাখায় ছড়িয়ে পড়ে। ওপার বাংলার ঢাকাতেও এর শাখা খুলেছিল ১৯০৫ সালে। তবে যে মানুষটির হাত ধরে এই সমিতি সত্যিকারের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে শুরু করে, তিনি অরবিন্দ ঘোষ। 

বঙ্গভঙ্গের কিছু পরে ১৯০৬ সালে অনুশীলন সমিতির সহ-সভাপতি হয়েছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ আর অরবিন্দ ঘোষ (১৮৭২ - ১৯৫০)। প্রথমজন সম্পর্কে জগদীশচন্দ্রের শ্যালক, পরে নামী ব্যারিস্টার হিসেবে বেশ সুনাম অর্জন করেছিলেন। যদিও পরের দিকে ইনি অত ভালো উপার্জনের রাস্তা ছেড়ে বেছে নেন দেশের কাজকেই। 

আর দ্বিতীয়জন বিশিষ্ট ব্রাহ্ম-নেতা রাজনারায়ণ বসুর নাতি (রাজনারায়ণ বসু সম্পর্কে ছিলেন তাঁর মা স্বর্ণলতা দেবীর বাবা)। যদিও হুগলির কোন্নগরে তাঁর জন্ম ১৮৭২ সালের ১৫ আগস্ট, বাবা কৃষ্ণধন ঘোষ ছিলেন পূর্ববঙ্গের রংপুর জেলার জেলা সার্জন। ইনি পড়াশুনো করেছিলেন বিলেতের কিংস কলেজে, সেই কারণে তাঁর স্বভাবচরিত্রে পড়ে গিয়েছিল অমোচনীয় বিলিতি আচার-সংস্কৃতির ছাপ। অরবিন্দ আর তাঁর দুই ভাইকে তাই ছোট থেকেই বিলিতি আদবকায়দা শেখানোয় কোনো ত্রুটি রাখা হয়নি। তাঁদের পরিবার এতটাই সাহেবি মনোভাবাপন্ন ছিল যে যে এই বাড়ির কেউ কখনও বিপ্লবী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়বেন, এমনটা তাঁর ডাক্তার বাবা বা মা স্বর্ণলতা কল্পনাও করতে পারেননি। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছিল সেটাই। অরবিন্দরা পাঁচ ভাই-বোন— বিনয়ভূষণ, মনমোহন, সরোজিনী আর বারীন্দ্রকুমার। অরবিন্দ ছোট থেকেই পড়াশুনোয় তুখোড়। সাহেবি স্কুলে পড়াশুনো করে বিলেত পাড়ি দিয়েছিলেন অরবিন্দ, উদ্দেশ্য ব্যারিস্টার হয়ে ফিরে আসা। 

চোদ্দ বছর ইংল্যান্ডে কাটিয়ে সেই ছেলে একদিন দেশে ফেরেন। সেটা ১৮৯৩ সাল। আসবার আগেই, বিলেতে থাকবার সময় থেকেই তিনি জানতেন যে আট বছর আগে তৈরি হওয়া জাতীয় কংগ্রেস দিয়ে দেশ-বদলানোর কাজ কিচ্ছু এগোবে না। ওঁদের কাজ শুধু ব্রিটিশ কর্তাব্যক্তিদের সামনে গিয়ে হাত কচলে যতটা সম্ভব বিনয়ের অবতার হয়ে দাবিদাওয়া আদায় করে নেওয়ার চেষ্টা করা। 

আসলে তখনকার গোটা দেশের পাশাপাশি এই বাংলাতেও ব্রিটিশ-সাম্রাজ্যবাদের সমর্থক বা সাহেবদের গুণমুগ্ধ মানুষ দেখা যেত যথেষ্ট পরিমাণেই। যে মহেন্দ্রলাল সরকার সম্পূর্ণ ভারতীয়দের হাতে নিয়ন্ত্রিত হবে এই আশায় তৈরি করেছিলেন ‘আইএসিএস’-এর বেশ কিছু নিয়মকানুন, সেই তিনিও এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, এই দেশে ব্রিটিশ সরকার আছে বলে মানুষ সুখে আছে। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তো রাণী ভিক্টোরিয়া-কে সম্বোধন করেছিলেন ‘আমাদের মাতা’ বলে। বরং সেই তুলনায় স্বামীজী অনেক বেশি স্বদেশী মনোভাবাপন্ন ছিলেন। 

অরবিন্দ চাইতেন যে দেশের অসংখ্য ‘প্রোলেতারিয়েত’ (হ্যাঁ, তিনি এই শব্দটাই ব্যবহার করেছিলেন ১৮৯৩ সালে ‘নিউ ল্যাম্পস ফর ওল্ড’ নামে এক লেখায়) যদি জেগে ওঠে, তবেই দেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। এঁদের যদি জাগিয়ে তলা যায়, তাহলে এঁদের দিয়ে আগামী দিনে দেশ চালানো কঠিন কোনো কাজ হবে না। এখন শুধু দরকার এই মানুষকে বুঝিয়েসুঝিয়ে নিজেদের দলে আনতে পারা। 

দেশে ফেরবার পর অরবিন্দ সরাসরি চলে গেলেন বরোদায়। সেখানকার মহারাজা সয়াজীরাও গায়কোয়াড়-এর কাছে চাকরি নিলেন দুশো টাকা মাস-মাইনেতে। সেই সঙ্গে তিনি বরোদা কলেজে শিক্ষকতাও করেন ফরাসি ভাষা শেখানোর। 

এই কলেজেই তিনি কাটিয়েছিলেন ১৯০৫ সাল পর্যন্ত। এখানেই তিনি বাংলা ভাষা প্রকৃত অর্থে শিক্ষালাভ করেন। সেই সঙ্গে পড়াশুনো করেন ভারতীয় দর্শন, পুরাণ বা সংস্কৃত সাহিত্য। বিলিতি সাহেব থেকে এরপর তাঁর উত্তরণ ঘটতে থাকে দেশীয় অবতারে। 

১৯০৬ সালে বরোদা থেকে চাকরি ছেড়ে পাকাপাকিভাবে কলকাতায় আসবার পর অরবিন্দ বিয়ে করেন মৃণালিনী নামে এক চোদ্দ বছরের মেয়েকে। তখন তাঁর বয়স আঠাশ। কিন্তু ইনফ্লুয়েঞ্জায় ভুগে মৃণালিনীর মৃত্যু হয় ১৯১৮ সালে। নিজের আসবার আগে অরবিন্দ তাঁর ভাই বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে বরোদা থেকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন বাংলায়, যাতে তিনি এসে অনুশীলন সমিতির কাজকর্ম আগেভাগে বুঝে নিতে থাকেন। বিপ্লবী হিসেবে নিয়োজিত হওয়ার আদর্শে ততদিনে বারীন্দ্রকুমার দীক্ষা নিয়েই নিয়েছেন দাদার কাছ থেকে। 

.............


#Jagadish Chandra Bose #Scientist #জগদীশচন্দ্র বসু #series #ধারাবাহিক #silly পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

32

Unique Visitors

219075