উপন্যাস

সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (দ্বাদশ পর্ব)

তপোব্রত ভাদুড়ি June 10, 2023 at 8:01 pm উপন্যাস

[ আগে যা ঘটেছে : মুম্বই মেলে হাওড়ায় আসার পথে অপরাজিতার এক সহযাত্রীর সুটকেস চুরি হয়। লোকটিকে রেলপুলিশের কাছে ডায়রি করতে পরামর্শ দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে হুমকি চিরকুট পায় অপু। পরে হৃষীকেশ কাকুর কাছে গিয়ে অপু আর ওর মাসতুতো ভাই তপু জানতে পারে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মিলিটারি অফিসার ড্যানিয়েল রিচার্ডসনের ডায়রিতে লিপিবদ্ধ শাহ সুজার চিঠির কথা, যার মধ্যে ছিল সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধনের সংবাদ। এরই মধ্যে রায়পুরের সিমরন হেরিটেজ হোটেলে পাওয়া যায় ড্যানিয়েলের বংশধর ডেরেক রিচার্ডসনের লাশ। ড্যানিয়েলের বিষয়ে অনুসন্ধানের সূত্রে ডেরেকের বাবা ডেনিসের সঙ্গে হৃষীকেশ গুপ্তর সাক্ষাৎ হলে তিনি তাঁকে সুজার চিঠিটি দেখান। এদিকে রঘুবীরের কাছ থেকে বুরহানপুরের গুপ্তধনের খবর পেয়ে মিস্টার দারুওয়ালার মতো কুটিল মানুষও ব্যগ্র হয়ে উঠেছেন শাহি খাজানা লুঠ করার লোভে। ডেরেকের হত্যা সম্পর্কে কয়েকটা খটকা দূর করতে অপুরা এসেছিল রায়পুরে।]

....................

সাপ্তাহিক উপন্যাস 

একাদশ পর্বের পর 

..................... 


দুঃসংবাদটা ভোরেই এসেছে। সাড়ে সাতটা নাগাদ। মোবাইলের টাওয়ার ছিল না তার আগে। 


ফাল্গুনি কাকার ফোন পাওয়ার পর থেকেই হৃষীকেশ কাকু গম্ভীর হয়ে গেছেন৷ টাটানগরে চা উঠল৷ ফিরেও তাকালেন না৷ খড়গপুরে তপু একবার জিজ্ঞাসা করল, ‘কাকু, সিঙাড়া খাবে?’ বললেন, ‘তোমরা খাও৷’  


অপু-তপুরও খুব মনখারাপ৷ অপু অনেকক্ষণ উসখুশ করে শেষে সাহস করে প্রশ্ন করল, ‘তোমার কী কাউকে সন্দেহ হয়?’ 

‘এমনিতে তো কারও সঙ্গে আমার ঝামেলা নেই৷ তবে যেই হোক না কেন, নিশ্চয়ই তারা বই ভালোবাসে না৷’ 

তপু বলল, ‘তোমার সেই ডায়রিটা ঠিক আছে তো?’

‘ডায়রি তো আমার সঙ্গেই৷ মনে হয়, ওটার জন্যই এসেছিল৷ কিংবা অন্য কিছুও হতে পারে৷’

‘অন্য কিছু বলতে?’

হৃষীকেশ জবাব দিলেন, ‘অন্য কিছু মানে গুপ্ত সংকেত বা ম্যাপ৷ ভাবছে হয়ত আমার কাছে গুপ্তধনের হদিশ আছে৷’  


বাকি রাস্তাটুকু হৃষীকেশ আর কোনো কথা বললেন না৷ শুধু কোলাঘাটের ব্রিজ পেরোনোর সময়ে তপু একটু ক্যাডবেরি ভেঙে দিতে চুপচাপ খেয়ে নিলেন৷ 


অপু সাইড লোয়ারের একটা সিট ফাঁকা পেয়ে জানলা দিয়ে দূরের দিকে তাকিয়ে বসে ছিল৷ সামনের সিটের ভদ্রমহিলা খুব কৌতূহলী টাইপের৷ তার ওপর কানে একটু খাটো৷ হৃষীকেশকে ইশারায় দেখিয়ে অপুকে জিজ্ঞাসা করলেন, উনি কে হন৷ 

অপু বলল, ‘সম্পর্কে কাকু৷ তবে এমনি দাদার মতো৷’ 

‘কেউ মারা গেছে নাকি? মানে বাড়ি থেকে কোনো খারাপ খবর-টবর —’

অপু ইচ্ছা করে উত্তর দিল, ‘বঙ্কিম, শরৎ, আশাপূর্ণা —’

‘মানে?’

‘সব ঘেঁটে রেখে গেছে৷’

‘ও৷’ 

শেষে মহিলা যখন তপুর নাম দু’বার শোনার পরেও আবার প্রশ্ন করলেন, ‘দর্পহরণ?’, অপু ভদ্রতা করে ‘একটু আসছি’ বলে তপুদের পাশে গিয়ে বসল৷


গাড়ি অনেকটা লেট৷ হাওড়ায় ঢুকতে ঢুকতেই পৌনে একটা৷ হৃষীকেশ ট্রেন থেকে নেমে বললেন, ‘আমি একটু বো-ব্যারাকে যাব৷ বাড়ি ঢুকে গেলে তো এখন আর বেরোতে পারব না৷ অ্যাঞ্জেলা বিশ্বাসের সঙ্গে শিগগিরি একবার দেখা করা দরকার৷’

অপু-তপু বলল, ‘আমরাও যাব৷’

‘আচ্ছা, চলো৷’ 

তপু বলল, ‘ফুড প্লাজা থেকে লাঞ্চটা সেরে নিলে ভালো হত না? একেবারে ঝাড়া হাত-পা হয়ে যেতাম৷’

হৃষীকেশ কিছু বলার আগেই অপু বলে উঠল, ‘আমার এখন একটুও খিদে পাচ্ছে না৷ এই তো একটু আগে মেচেদায় চারখানা চপ খেলি৷ দামোদর শেঠ কোথাকার৷’

হৃষীকেশ বললেন, ‘আমি ফাল্গুনিকে বলে দিচ্ছি, দুপুরে তোমরা আমার ওখানেই খেয়ে যাবে৷’

অপু বলল, ‘সেই ভালো৷’


***

মিনিট পাঁচেক স্তব্ধ হয়ে বসে থাকার পরে হৃষীকেশকে অ্যাঞ্জেলা প্রশ্ন করলেন, ‘পুলিশে ইনফর্ম করেছেন?’ 

‘এখনও জানাই নি৷ তবে সময় মতো জানাব৷ স্টেশন থেকে সোজা আপনার কাছেই এসেছি৷’

অপু বলল, ‘আসলে আমরা পুরোপুরি শিওর হতে পারছিলাম না৷ আপনার কাছে ওদের ফোটো আছে, কাকু বলেছিলেন৷ সেইজন্যই আগে এখানে এলাম৷’

অ্যাঞ্জেলা উঠে ভিতরের ঘরে গিয়ে কিছুক্ষণ পরে একটা অ্যালবাম নিয়ে ফিরে এলেন। 

‘দেখুন৷ এই ডানদিকেরটা। বোটানিকালে পিকনিক। নাইনটি এইটে।’

অ্যাঞ্জেলার হাত থেকে অ্যালবামটা নিয়ে হৃষীকেশ গ্রুপ ফোটোর দিকে তাকালেন৷ অপু আর তপু হুমড়ি খেয়ে ঝুঁকে পড়ল দু’দিক থেকে। 


এই তো … মিস্টার রিচার্ডসন। নীল টিশার্ট আর ঘিয়ে রঙের ট্রাউজার পরে৷ কমবয়সে অনেকটা ডেরেকের মতোই দেখতে ছিলেন৷ লালপাড় শাড়িতে ইনি নিশ্চয়ই শান্তিলতা৷ বাঁদিকে মাইকেলের মতো দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক, বোঝাই যাচ্ছে সেবাস্টিয়ান বিশ্বাস৷ অ্যাঞ্জেলা একটা সুন্দর গোলাপি গাউন পরে আছেন৷ আর ঠিক সামনেই একে অন্যের কাঁধে হাত রেখে হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে ডেভিড আর ডেরেক৷ অবশ্য চিনিয়ে না দিলে আলাদা করে বোঝার উপায় নেই, কে কোন্ জন৷ অবিকল একরকম৷


তপু খানিকক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থেকে বলে উঠল, ‘কমেডি অফ এরর্স৷’

অপু বলল, ‘ট্র্যাজেডি৷’


***

বাড়ি ফেরার পথে অমলকান্তিকে ফোন করলেন হৃষীকেশ৷

‘জয় গুরু৷ ভরদুপুরে কী মনে করে?’

‘শোন৷ কল্পতরু অ্যাপার্টমেন্টের সেই অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ফ্যামিলিটার কথা বলেছিলাম না? ওদের ফ্ল্যাটের ওপরে একটু নজর রাখতে হবে৷ কে কখন ঢুকছে বেরোচ্ছে সব খবর চাই৷’

‘তোদের ইস্কুলে এখন ঘন্টার বদলে ভেঁপু বাজানো হয়?’ 

‘আমি এখন রাস্তায় আছি৷ ট্যাক্সিতে৷ তোকে পরে সন্ধ্যাবেলায় সব খুলে বলব৷’

‘ঠিক হ্যায়৷ নো টেনশন৷ আজই গুপ্তচর লাগাচ্ছি৷’


ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে৷ সায়ন্স কলেজের কাছে ট্রাফিক সিগন্যালে বিশ্রীরকমের একটা জট পাকিয়ে গেছে৷ সামনে একটা মিনিবাস কিছুতেই সাইড দিচ্ছে না৷ পিছনে লেখা ‘পিছু নিয়ো না, কিছু পাবে না’৷ 


অপু বলল, ‘রিজওয়ানুর কাকুকে তাহলে এখনই কিছু জানাচ্ছি না৷’ 

হৃষীকেশ উত্তর দিলেন, ‘পুলিশের কাছে এখখুনি গিয়ে তো কোনো লাভ নেই৷ ওরা পাত্তাই দেবে না৷ সাক্ষ্যপ্রমাণ চাইবে৷’

‘সেটাই৷ শুধুমাত্র সন্দেহের বশে তো কারও বাড়িতে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট নিয়ে এমনি এমনি যাওয়া যায় না৷’

তপু বলল, ‘বার্গলারির ব্যাপারটা থানায় জানাবে তো?’

‘জিডি একটা করব৷ তবে খুব বেশি হইচই করতে চাইছি না৷ কালপ্রিটরা অ্যালার্ট হয়ে যাবে৷’

অপু বলল, ‘ঠিক বলেছ৷’


***

ফাল্গুনি কাকার গুণের অন্ত নেই৷ সকালবেলা নিজেই মাপজোখ করে কাচ কিনে এনে পেরেক মেরে পুটিং দিয়ে আলমারিতে সাঁটিয়ে দিয়েছেন৷ যেখানকার যা বইপত্র সব গোছগাছ করে তুলে রেখেছেন৷ অপুরা যখন গাড়ি থেকে নামল, গ্রিলের মিস্তিরি বাইরের দিকের জানলায় লোহা ঝালাই করছিল৷ ফাল্গুনি কাকা ওদের দেখে বলে উঠলেন, ‘আহা গো! কত বেলা হয়ে গেল তোমাদের ফিরতে৷ চটপট হাতমুখ ধুয়ে বসে পড়ো৷’


হৃষীকেশ কাকু বাড়ি এসেই পড়ার ঘরে ঢুকেছিলেন৷ অপু আর তপু হাতমুখ ধুয়ে খাবার টেবিলে এসে বসল৷ তপু জিজ্ঞাসা করল, ‘আজ কী মেনু গো, ফাল্গুনি কাকা?’ 

‘মেনু? আজ সোনামুগ, ঝিঙেপোস্ত, মাছের ডিমের বড়া, বেগুন-সরিষা দিয়ে ইলিশ মাছ আর টমেটো-খেজুর-আমসত্ত্বের চাটনি৷’

তপু বলল, ‘উফ্! দুর্দান্ত!’

অপু প্রশ্ন করল, ‘তুমি সব সামলে এতকিছু করলে কখন?’

‘ঘরদোর তো এগারোটার মধ্যে গুছিয়ে ফেলেছি৷ বাজারও কাল করাই ছিল৷ দাদা ফোন দিতেই গ্যাসে করে ফেললাম ডাল, মাছের ঝোল, চাটনি আর বড়াটা৷ আর ইনজেকশনে ঝিঙেপোস্ত৷’

‘কাকু খাবেন না?’

‘কাকুর এখন অনেক দেরি৷ বইপত্তর সব অক্ষত আছে কি না ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে তবে খেতে বসবে৷ এই চা দিয়ে এলাম৷’


অপুরা খাওয়াদাওয়া সেরে কাকুকে ‘আসছি’ বলতে গেল৷ হৃষীকেশ তখন পড়ার ঘরে সেলোটেপ আর কাঁচি নিয়ে একটা বইয়ের জ্যাকেট মেরামত করছিলেন৷ অপুদের দেখে হেসে বললেন, ‘প্লাস্টিক সার্জারি৷’

অপু বলল, ‘দেরি কোরো না৷ খেয়ে নাও৷ তোমার জন্য ফাল্গুনি কাকা বসে আছে৷’

তপু বলল, ‘বেশিক্ষণ না খেয়ে থাকলে পিত্তি পড়ে, মা বলে৷’


***

তপু আজ ফিরবে না৷ মাসির বাড়িতে থাকবে৷ মা-বাবা গেছেন ডানকুনিতে৷ বাবার বন্ধু ধূর্জটিকাকুর ছেলের বৌভাতে৷ 


দুশো সাতাশটা বেশ ফাঁকা৷ বাদলা দিন বলে রাস্তায় লোক কম৷ জানলার ধারের একটা সিট দখল করে তপু বলল, ‘এরকম বিচ্ছিরি দিনে কী করে যে কেউ বৌভাত খেতে যায়!’

অপু বলল, ‘বৌভাত ব্যাপারটাই বোকা বোকা৷ আজ থেকে আমি তোমার ভাতকাপড়ের দায়িত্ব নিলাম৷ কে হে তুমি হরিদাস পাল!’

‘তারপর ধর জামাইষষ্ঠী৷’

‘ভাইফোঁটা৷’ 

‘না, না, ভাইফোঁটা বলিস না৷’ 

অপু কপট রাগ দেখিয়ে বলল, ‘সেই তো৷ প্রিভিলেজড ক্লাস৷’

তপু ফিক করে হেসে বলল, ‘বৃষ্টিটা ধরলে কিন্তু ছাদে উঠে রেলগাড়ি দেখব৷’

‘রেলগাড়ি দেখার বয়স আছে এখনও?’

‘নজরুল পড়িস নি? আমি চিরশিশু চিরকিশোর৷’


***

খেয়ে উঠে থানা থেকে ঘুরে এসে হৃষীকেশ আরামকেদারায় বসে একটু ঝিমোচ্ছিলেন৷ এমন সময়ে অমলকান্তির ফোন বেজে উঠল৷ 

‘মান্না দে-কে ফিট করে দিলাম, বুঝলি৷’

হৃষীকেশ চমকে উঠে বললেন, ‘মান্না দে?’

‘আরে সিঙ্গার না৷ উনি তো কবেই ইয়ে হয়েছেন৷ আমাদের পাড়ার৷ ওর ভালো নাম বান্টি৷ মান্না দে বলতে অজ্ঞান৷ কল্পতরুর ঠিক সামনেই ওর চায়ের দোকান৷’

‘ভেরি গুড৷’

‘রিচার্ডসনদের ও ভালো করেই চেনে৷ কিছুদিন আগে বুড়োটার সঙ্গে আরেকটা লোককে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছে৷ বলল, অনেকটা বুলডগের মতো থোবড়া৷’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, রঘুবীর৷’

‘রঘু ঘুঘু যেই হোক, পালাতে গেলে নাকের ডগা দিয়েই বেরোতে হবে৷’

‘এক্সেলেন্ট৷’

‘তোর নেক্সট কুমতলবটা কী?’

হৃষীকেশ হেসে উঠে বললেন, ‘এমন কিছু বলতে পার যাতে খুব ধোঁয়া হয়?’


(চলবে)


আগের পর্বগুলি পড়ুন : 

১) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (প্রথম পর্ব) 

২) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (দ্বিতীয় পর্ব) 

৩) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (তৃতীয় পর্ব) 

৪) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (চতুর্থ পর্ব) 

৫) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (পঞ্চম পর্ব) 

৬) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (ষষ্ঠ পর্ব) 

৭) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (সপ্তম পর্ব) 

৮) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (অষ্টম পর্ব) 

৯) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (নবম পর্ব)  

১০) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (দশম পর্ব) 

১১) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (একাদশ পর্ব) 

........................  

[অলংকরণ : বিবস্বান]  


#সাপ্তাহিক উপন্যাস #রহস্য উপন্যাস #weekly novel #কিশোর উপন্যাস #সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন #তপোব্রত ভাদুড়ি #silly পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

18

Unique Visitors

219123