উপন্যাস

সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (নবম পর্ব)

তপোব্রত ভাদুড়ি May 21, 2023 at 4:42 am উপন্যাস

[ আগে যা ঘটেছে : মুম্বই মেলে হাওড়ায় আসার পথে অপরাজিতার এক সহযাত্রীর সুটকেস চুরি হয়। লোকটিকে রেলপুলিশের কাছে ডায়রি করতে পরামর্শ দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে হুমকি চিরকুট পায় অপু। পরে হৃষীকেশ কাকুর কাছে গিয়ে অপু আর ওর মাসতুতো ভাই তপু জানতে পারে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মিলিটারি অফিসার ড্যানিয়েল রিচার্ডসনের ডায়রিতে লিপিবদ্ধ শাহ সুজার চিঠির কথা, যার মধ্যে ছিল সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধনের সংবাদ। এরই মধ্যে রায়পুরের সিমরন হেরিটেজ হোটেলে পাওয়া যায় ড্যানিয়েলের বংশধর ডেরেক রিচার্ডসনের লাশ। ড্যানিয়েলের বিষয়ে অনুসন্ধানের সূত্রে ডেরেকের বাবা ডেনিসের সঙ্গে হৃষীকেশ গুপ্তর সাক্ষাৎ হলে তিনি তাঁকে সুজার চিঠিটি দেখান। এদিকে রঘুবীরের কাছ থেকে বুরহানপুরের গুপ্তধনের খবর পেয়ে মিস্টার দারুওয়ালার মতো কুটিল মানুষও ব্যগ্র হয়ে উঠেছেন শাহি খাজানা লুঠ করার লোভে। ডেরেকের হত্যা সম্পর্কে কয়েকটা খটকা দূর করতে অপুরা এসেছে রায়পুরে।]

....................

সাপ্তাহিক উপন্যাস 

অষ্টম পর্বের পর 

..................... 

অনুজ নায়ার বেশ করিৎকর্মা লোক৷ সিআইডির ডিএসপি৷ অটলনগরে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে অফিস৷ রিজওয়ানুরের কাছ থেকে অপুদের আসার খবর পেয়েই মৌধাপাড়া থানায় জানিয়ে দিয়েছিলেন৷ অপুরা স্নান সেরে তৈরি হতে না হতেই সেকেন্ড অফিসার হোটেলে এসে হাজির৷ 

তপু সবে গোলাপি পাঞ্জাবিটা গায়ে চাপিয়ে যত্ন করে চুল আঁচড়াচ্ছিল৷ হোটেলের বেয়ারা এসে দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘পোলিসওয়ালা আপকো ঢুঁঢ় রহা হ্যায়৷’ 

তপু সমস্ত কথা জানত না৷ ঘাবড়ে গিয়ে আমতা আমতা করে প্রশ্ন করল, ‘ম্যাঁয়নে ক্যা কিয়া?’ 

‘ওয়হ তো আপকো হি মালুম৷’ 

হৃষীকেশ কাকু একটু আগেই বাথরুমে ঢুকেছেন৷ তপু অপুর ঘরের দরজায় গিয়ে দুবার টোকা দিতেই ও বেরিয়ে এসে বলল, ‘তোকে না — প্রণাম! এটা ছাড়া আর হোটেল ছিল না! বাথরুমে জল যাচ্ছে না৷’ 

তপু বকুনিতে ভ্রূক্ষেপ না করে ভয়জড়ানো গলায় বলল, ‘পুলিশ! আমাকে ঢুঁড়ছে!’ 

অপু হেসে ফেলে বলল, ‘ঢুঁড়ুক৷ তোকে ধরে নিয়ে গেলে ভালো হয়৷ আমিই রিজওয়ানুর কাকুকে বলেছিলাম, লোকাল পুলিশকে আমাদের আসার কথা ইনফর্ম করে রাখতে৷ ইনভেস্টিগেট করতে সুবিধা হবে৷’ 

‘আরেকটু হলেই হার্টবিট বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল৷’

অপু বলল, ‘দাঁড়া, আমি চটপট তৈরি হয়ে আসছি৷’


***

মিনিট পনেরোর মধ্যে তিনজনেই নিচে নেমে এল৷ মৌধাপাড়ার সেকেন্ড অফিসারের নাম অখিলেশ কুঁয়ার৷ বয়স বড়জোর বছর পঁয়ত্রিশ৷ ছিপছিপে চেহারা৷ হাসিখুশি ছটফটে স্বভাব৷ অপুকে দেখেই বললেন, ‘সো ইউ আর অপরাজিতা?’ 


রিসেপশন লাউঞ্জের একপাশে চারখানা বেতের চেয়ার পাতা ছিল৷ সেখানেই বসল সবাই৷ থানার দারোগা হোটেলে পদধূলি দিয়েছেন বলে ম্যানেজার এসে ভক্তি ভরে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সাব, চায়ে পানি কা থোড়া ইন্তেজাম করুঁ?’ অখিলেশ হাত নাড়িয়ে বললেন, ‘নো থ্যাঙ্কস, ডিউটি পর হুঁ৷’


অনুজ নায়ার ব্যাপারটা সংক্ষেপে বলে রেখেছিলেন৷ অপু তাও তপুকে দেখিয়ে বলল, ‘যিস কা কতল হুয়া হ্যায়, ওয়হ মেরে ভাই কা বহোত করিবি দোস্ত থা৷ উসকি অচানক মৌত কি বজা সে গহরা সদমা পহুঁছা হ্যায় ইসে৷ … হামে কুছ শক হ্যায়৷ ইস লিয়ে হোটেল সিমরন মে থোড়া পুছতাছ করনে কে লিয়ে ইতনি দূর সে আয়ে হ্যায়৷ হামেঁ আপকি মদদ চাহিয়ে৷’

অখিলেশ বললেন, ‘ওকে, ফাইল তো ক্লোজ হো গ্যয়া হ্যায়৷ ফির ভি … নো প্রবলেম৷ কব চলনা চাহতে হ্যায় আপ?’

হৃষীকেশ একটু ভেবে বললেন, ‘কাল সুবাহ যানে সে আচ্ছা হোগা৷ জাদা ওয়ক্ত মিলেগা৷’

‘হাঁ হাঁ, ওহি ঠিক রহেগা৷ অব তো আপ লোগো কা থকান হ্যায়৷ খানা-বানা ভি নেহি হুয়া সায়দ৷ আজ আরাম কিজিয়ে৷ ঘুমিয়ে ফিরিয়ে৷ ম্যাঁয় কাল সুবাহ পাক্কা দশ বাজে আ যাউঙ্গা৷’

তপু এতক্ষণে খানিকটা সাহস পেয়ে বলল, ‘সো কাইন্ড অফ ইউ৷’

‘আরেহ, কোই বাত নেহি৷ ম্যাঁয় ভি দোস্তানা সমঝ সকতা হুঁ৷ মেরা অপনা দোস্ত বিস্ফোট মে মারা গ্যয়া৷ দন্তেওয়াড়া মে৷’


কথা বলতে বলতে অখিলেশ উঠে পড়লেন৷ হোটেল থেকে বেরোতে বেরোতে ম্যানেজারকে বললেন, ‘আচ্ছে সে খাতিরদারি করনা৷ ডিএসপি সাব কে মেহমান হ্যায়৷’


অপু তপুর পিঠে একটা খোঁচা মেরে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘বাথরুমে জল যাচ্ছে না, বল ওদের৷’


***

অতিথিতে খাওয়াদাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই৷ অপুরা খেতে ঢুকল নোয়াজ আর্কে৷ খাওয়ার পরে হৃষীকেশ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমরা কি এখন হোটেলে ফিরতে চাও? শহরটা আজ একটু ঘুরে দেখতে পারলে মন্দ হত না৷’ 

অপু বলল, ‘ঘন্টাখানেক জিরিয়ে নিয়ে বেরোই? সবে তো এখন আড়াইটে বাজে৷’

তপু বলল, ‘সেই ভালো৷’


বিকালের দিকে তপুরা বেরোলো একটা অটো ভাড়া করে৷ যাওয়ার পথে হৃষীকেশ বললেন, ‘মস্তক বিক্রয় কবিতা পড়েছ তো? কোশল নৃপতির তুলনা নাই, জগৎ জুড়ি যশোগাথা; ক্ষীণের তিনি সদা শরণ ঠাঁই, দীনের তিনি পিতামাতা৷ সেই কোশল রাজ্যের অংশ ছিল রায়পুর৷ তখন অবশ্য শহরটা গড়ে ওঠে নি৷’ 

অপু বলল, ‘এখানে আসার আগে একটা জায়গায় পড়ছিলাম, মৌর্য হৈহয় আর সাতবাহন বংশের রাজত্ব ছিল এখানে৷’ 

‘ঠিকই৷ সমুদ্রগুপ্তও জয় করেছিলেন মধ্য ভারতের এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল৷ তারপর আসে কলচুরিরা৷ কলচুরি রাজাদের হাতেই রায়পুরের পত্তন৷’

তপু গলা নামিয়ে অপুকে বলল, ‘কলচুরি শুনলেই কেমন যেন কচুরির কথা মনে পড়ে৷ তাই না?’

অপু কটমট করে তাকিয়ে বলল, ‘না৷’


***

শহরের মধ্যেই দু-তিনটে জায়গায় ঘুরিয়ে অটোওয়ালা ওদের বুদ্ধ সরোবরের ধারে পৌঁছে দিল পৌনে ছটা নাগাদ৷ ঠিক তখনই রিজওয়ানুর কাকু কল করলেন৷ 

—কী রে, আছিস কেমন? পৌঁছে একটা খবর দিবি তো!

অপু বলল, ‘সরি কাকু, তোমাকে আরেকটু পরে আমি নিজেই ফোন করতাম৷ সময় করে উঠতে পারি নি৷ আমরা ভালোই আছি৷ থানা থেকে এসে দেখা করে গেছে৷ কাল সকালে সিমরন হেরিটেজে যাব৷’

‘আচ্ছা, সিসিটিভি দেখবি খুঁটিয়ে৷ অবশ্য ঠিকঠাক ফুটেজ যদি পাওয়া যায়৷ আজকাল অর্ধেক জায়গাতেই তো খারাপ হয়ে পড়ে থাকে৷ গরম কেমন ওখানে?’

‘ভালোই৷ বৃষ্টি পাই নি৷ হিউমিড ভীষণ৷’

‘বেয়ারাগুলোকে ভালো করে জেরা করবি৷ ম্যানেজারটাকেও৷ কীরকম বেয়াক্কেলে একটা লোক৷ যে যখন পারছে হোটেলে ঢুকে নুইসেন্স করে বেরিয়ে যাচ্ছে৷ কানের গোড়ায় দিতে হয় একটা৷’

অপু বলল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তুমি কিচ্ছু চিন্তা কোরো না৷ আমরা সামলে নেব৷’

রিজওয়ানুর কাকু সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, ‘আচ্ছা, রাখলাম এখন৷’


কাল রাতের ট্রেনে ভালো করে ঘুম হয় নি৷ তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে হবে৷ সকালে উঠে বিস্তর কাজ আছে৷ সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘোরাঘুরি করে হোটেলে ফেরার আগে অপুরা একেবারে রাতের খাওয়া সেরে নিল৷ 


খাবারের অর্ডার দিতে গিয়ে হৃষীকেশ বললেন, ‘দুপুরের খাবার এখনও আমার সবটা হজম হয় নি৷ আর রাত্রে এমনিতেই খুব অল্প খাই৷ তোমরা কে কী নেবে বলো৷’ অপুর খুব বেশি খিদে ছিল না৷ ওও বলল, ‘হালকা পলকা কিছু নাও৷’ তপু বেগতিক দেখে বলল, ‘এখানকার জলে কীরকম অদ্ভুত একটা তেজ আছে৷ খাচ্ছি বলে মনেই থাকছে না৷’


***

ঘরে ফিরে এসে অপু তপুকে ডাকল৷ 

‘কাগজ-কলম নিয়ে বোস তো৷ প্রশ্নগুলো একবার প্রথম থেকে ঝালিয়ে নিই৷’

তপু বলল, ‘বল৷’

‘এখানে আমরা এসেছি কেন?’

‘সিমরন হেরিটেজ হোটেলে তদন্ত করতে৷’

‘কীসের তদন্ত?’

‘মৃত্যুরহস্যের৷’

‘মৃত ব্যক্তির পরিচয়?’

‘ডেরেক রিচার্ডসন৷’

‘ডেরেকই যে মারা গেছে, তার কোনো অকাট্য প্রমাণ আছে কি?’

তপু জিজ্ঞাসা করল, ‘প্রমাণ নেই? হোটেলের ঘরে তো ডেরেকই এসে উঠেছিল৷’

‘প্রমাণ নেই বলছি না৷ কিন্তু কতগুলো খটকা আছে৷’

‘কী খটকা?’

অপু বলল, ‘প্রথম খটকা হচ্ছে ডেরেকের ফোন থেকে খুনিকে দেওয়া সুপারি৷ নিজেকে শেষ করার জন্য তো সুইসাইড করলেই হয়৷ খামখা কেউ গ্যাঁটের কড়ি খরচা করে কি?’

‘আচ্ছা৷ বেশ৷ আর কী খটকা?’

‘খুনিকে ডেরেকের লাস্ট ফোনকল৷ খুনের কিছুক্ষণ আগে৷ রায়পুরে বসে৷ ব্যাপারটা অনেকটা যেন অন্তিম আমন্ত্রণ৷ হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হল পার করো আমারে৷’

‘এতে খটকার কী আছে?’

‘খটকা এইখানেই, সুইসাইড করার জন্য যেহেতু কেউ সুপারি দেয় না, তাই ডেরেক নিশ্চয়ই নিজে ফোন করে খুনিকে ডাকে নি৷ আর যদি কলটা ডেরেকই করে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে, ভিকটিম আসলে অন্য কেউ৷ এই দুটোর মধ্যে প্রথম সন্দেহটা জোরালো নয়৷’

‘তাহলে?’ 

‘তাহলে সাত দুগুণে চোদ্দর নামে চার, হাতে রইল পেন্সিল৷’


অপু হঠাৎ বিছানা ছেড়ে উঠে অস্থির ভাবে পায়চারি করতে করতে বলল, ‘এটা একটা ভয়ঙ্কর ঠান্ডা মাথার খুন৷ জটিল হিসাব কষে সাজানো নিষ্ঠুর ষড়যন্ত্র৷ কিন্তু এর শেষ কিনারাটা যে কোথায়, সেইটাই আমি ভেবে চলেছি৷’  


(চলবে)


আগের পর্বগুলি পড়ুন : 

১) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (প্রথম পর্ব) 

২) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (দ্বিতীয় পর্ব)

৩) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (তৃতীয় পর্ব) 

৪) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (চতুর্থ পর্ব)

৫) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (পঞ্চম পর্ব)

৬) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (ষষ্ঠ পর্ব) 

৭) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (সপ্তম পর্ব) 

৮) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (অষ্টম পর্ব) 

........................ 

[অলংকরণ : বিবস্বান]   




#ধারাবাহিক উপন্যাস #রহস্য উপন্যাস #তপোব্রত ভাদুড়ি #thriller #সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন #silly পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

0

Unique Visitors

182900