উপন্যাস

সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (অষ্টম পর্ব)

তপোব্রত ভাদুড়ি May 13, 2023 at 6:36 pm উপন্যাস

[ আগে যা ঘটেছে : মুম্বই মেলে হাওড়ায় আসার পথে অপরাজিতার এক সহযাত্রীর সুটকেস চুরি হয়। লোকটিকে রেলপুলিশের কাছে ডায়রি করতে পরামর্শ দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে হুমকি চিরকুট পায় অপু। পরে হৃষীকেশ কাকুর কাছে গিয়ে অপু আর ওর মাসতুতো ভাই তপু জানতে পারে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মিলিটারি অফিসার ড্যানিয়েল রিচার্ডসনের ডায়রিতে লিপিবদ্ধ শাহ সুজার চিঠির কথা, যার মধ্যে ছিল সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধনের সংবাদ। এরই মধ্যে রায়পুরের সিমরন হেরিটেজ হোটেলে পাওয়া যায় ড্যানিয়েলের বংশধর ডেরেক রিচার্ডসনের লাশ। ড্যানিয়েলের বিষয়ে অনুসন্ধানের সূত্রে ডেরেকের বাবা ডেনিসের সঙ্গে হৃষীকেশ গুপ্তর সাক্ষাৎ হলে তিনি তাঁকে সুজার চিঠিটি দেখান। এদিকে রঘুবীরের কাছ থেকে বুরহানপুরের গুপ্তধনের খবর পেয়ে মিস্টার দারুওয়ালার মতো কুটিল মানুষও ব্যগ্র হয়ে উঠেছেন শাহি খাজানা লুঠ করার লোভে।]

....................

সাপ্তাহিক উপন্যাস 

সপ্তম পর্বের পর 

..................... 

সুকিয়া স্ট্রিটের মুখে এসে তপুকে অপু বলল, ‘সবে তো সাড়ে সাতটা বাজে৷ এত তাড়াতাড়ি ফিরে কী করব? চল, একটু ঘুরপাক খেয়ে আসি।’ 

তপু বলল, ‘কোথায় যাবি?’

অপু একটু ভেবে বলল, ‘ওয়েলিংটন স্কোয়্যার।’

তপু বলল, ‘ধুস্, ওয়েলিংটন স্কোয়্যারে আবার কেউ ঘুরতে যায় নাকি!’

অপু বলল, ‘উফ্! অত কথার জবাব দিতে পারছি না৷ যাবি তো বল৷ নইলে কেটে পড়।’

তপু হুম হুম শব্দ করে একবার খুব অস্ফুট স্বরে বলল, ‘সবসময় গরম দেখাবে!’


ওয়েলিংটনের মুখে ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিয়ে রাস্তা পেরিয়ে দত্ত ইলেকট্রিকাল এম্পোরিয়ামে ঢুকে অপু বলল, ‘নাইট ল্যাম্প দেবেন তো একটা।’

তপু বলল, ‘যত্তসব! একটা নাইট ল্যাম্প কেনার জন্য ফালতু ট্যাক্সিখরচ দিতে হল।’

অপু একবার ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দোকানের লোকটাকে বলল, ‘নীলটাই দিন। সবুজটা ক্যাটক্যাট করবে।’ 

টাকা মিটিয়ে দিয়ে বেরোনোর মুখে অপু জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা কাকু, এখানে আশেপাশে কোথাও ইলেট্রিকাল অ্যাপ্লায়েন্সেসের একটা দোকান ছিল মনে পড়ছে। ভদ্রলোকের নাম বোধহয় রিচার্ডসন। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। এখন ওটা বন্ধ হয়ে গেছে, না?’

দোকান-মালিক নাইট ল্যাম্পগুলো তুলে রাখতে রাখতে বললেন, ‘এইখানেই ছিল। অনেক পুরোনো দোকান। চালাতে পারল না ঠিক করে। … ছেলেটা বেহিসাবি টাইপের ছিল। দোকানের ক্যাশ ভেঙে বদখেয়ালে ওড়াত। ঘোড়ার পিছনেই পড়ে থাকত সারাক্ষণ। মানে রেসের ঘোড়া। বাবাটা শেষের দিকে খুব চেষ্টা করেছিল। ততক্ষণে সব ফিনিশ। বাজারে লাখ তিনেকের ওপর দেনা। আমরা কিনে নিলাম। … আমার বাবা একসময় ওঁদেরই কর্মচারী ছিলেন। আপনাদের চেনা কেউ হয় নাকি?’

অপু তপুকে দেখিয়ে বলল, ‘ওর খুব ক্লোজ বন্ধু ছিল৷’ তারপর তপুকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী যেন নাম ছেলেটার? ডেরেক না ডেভিড?’

তপু উত্তর দেওয়ার আগেই ভদ্রলোক বললেন, ‘ডেভিড৷’

অপু তপুর হাত ধরে প্রায় একটা হ্যাঁচকা টান মেরে বলল, ‘চল৷ হয়ে গেছে৷ ওরকম হাঁ করে আবার দেখছিস কী?’


তপু দোকান থেকে বেরিয়ে কিছুটা দূরে এসে বলল, ‘এবার সব বুঝতে পেরেছি৷ কিন্তু আমার ক্লোজ বন্ধু মানেটা কী? কবেকার বন্ধু? কোথাকার? সেন্ট জেভিয়ার্সের?’

অপু হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘তোর মাথাটা একবার আমাদের ল্যাবে নিয়ে যাব৷’


***

টিফিনের আগের ক্লাসটা আজ ছিল নাইন বি সেকশনে৷ বেগম রোকেয়ার ‘হিমালয় দর্শন’ প্রবন্ধটা হৃষীকেশ আগের দিন শুরু করেছিলেন৷ আজ শেষ হল৷ সেকেন্ড বেঞ্চের সৌরদীপ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘স্যার, এইখানে লিখেছে — কারবনিফেরাস যুগে বড় বড় ঢেঁকিতরু ছিল৷ কারবনিফেরাস যুগ কী স্যার?’ কারবনিফেরাস নিয়ে গল্প করতে করতে হৃষীকেশ এসে পড়লেন প্যালিওজোয়িক পিরিয়ডে৷ তার মধ্যেই ঘন্টা পড়ে গেল৷ হৃষীকেশ বললেন, ‘আচ্ছা, আজ এই পর্যন্তই থাক৷ পরের দিন তোমাদের আমি আরো ভালো করে বলব৷’


টিফিনের সময়ে হেডমাস্টারের অফিসে ঢুকে হৃষীকেশ বললেন, ‘একটা আর্জি আছে স্যার৷ সামনের সোম-মঙ্গল একটু ছুটি চাই৷’ 

হেডমাস্টার বললেন, ‘কোথাও বেড়াতে যাচ্ছেন নাকি?’ 

হৃষীকেশ বললেন, ‘ওই আর কী৷’

—কোথায়?

—রায়পুরে স্যার৷

—হোটেল বুক করেছেন?

—আমার ভাইপো করছে৷

—আচ্ছা, ফ্যামিলি টুর! বেশ, ঘুরে আসুন ভালো করে৷


ভূগোলের সাধনবাবু হেডমাস্টারের ঘরে বসে ছিলেন৷ হৃষীকেশকে বললেন, ‘আমরা দুহাজার সাতে গিয়েছিলাম৷ ঘটারানি ওয়াটারফলসটা দেখতে যেয়ো৷ আর ঘাসিদাস মিউজিয়াম৷’

হৃষীকেশ বললেন, ‘নিশ্চয়ই যাব৷’


বাইরে এসে তপুকে কল করলেন হৃষীকেশ৷ 

—শোনো, ছুটির দরখাস্ত করে দিয়েছি৷ সোম আর মঙ্গল৷ হোটেলটা বুক করতে হবে এবার৷ শনিবার রাতের ট্রেনে রওনা হয়ে যদি রোববার পৌঁছাই, দুটো দিন তাহলে হাতে থাকবে৷

তপু বলল, ‘আমি এখখুনি করে ফেলছি, কাকু৷ অপু ট্রেনের টিকিটটা তৎকালে কেটে নেবে৷ আজাদ হিন্দ ধরলে ভালো হয়, ও বলছিল৷’

—আচ্ছা বেশ৷ আমি তোমাকে ছুটির পরে ফোন করব আবার৷ এখন আবার ক্লাস শুরু হয়ে যাবে৷


***

অপু গেছিল লালবাজারে৷ রিজওয়ানুর কাকু অফিসেই অপেক্ষা করছিলেন৷ অপুকে দেখে বললেন, ‘বল৷ কী খবর? দর্পণ কোথায়?’ 

অপু বলল, ‘তোমার কাছে একটা দরকারে এসেছি, কাকু৷ আমরা আসলে রায়পুর যাওয়ার প্ল্যান করেছি৷ ডেরেকের মার্ডারটা নিয়ে কয়েকটা জায়গায় বেশ খটকা লাগছে৷ সিমরন হেরিটেজে না গেলে পরিষ্কার হবে না৷’

রিজওয়ানুর বললেন, ‘আমি কীভাবে সাহায্য করব বল৷’

অপু বলল, ‘আমাদের লোকাল পুলিশের হেল্প লাগবে৷ ধরো যদি হোটেলে জিজ্ঞাসাবাদ করার দরকার পড়ে কিংবা সিসিটিভি ফুটেজ দেখতে চাই৷ এমনি এমনি তো আমাদের পাত্তা দেবে না৷’

রিজওয়ানুর অল্প একটু ভেবে বললেন, ‘ব্যবস্থা হয়ে যাবে৷ আমাদের ব্যাচের অনুজ নায়ার এখন ছত্তিশগড়ে আছে৷ আজই ওকে জানিয়ে দিচ্ছি৷ ও লোকাল থানাকে ইনফর্ম করে রাখবে৷’

অপু বলল, ‘থ্যাঙ্কিউ৷ ফিরে এসে তোমাকে সব জানাব৷’ 


***

আজাদ হিন্দেই যাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে৷ দশটা দশে ট্রেন৷ হৃষীকেশ হাওড়ায় পৌঁছালেন সাড়ে আটটায়৷ অপরাজিতা বড় ঘড়ির নিচে দাঁড়াতে বলেছে৷ হাতে অনেকটা সময়৷ হৃষীকেশ হুইলারের স্টলে গিয়ে কিছুক্ষণ বইপত্র দেখলেন৷ তেমন ভালো কিছু চোখে পড়ল না৷ বেশিরভাগই ‘হাউ টু অ্যাট্রাক্ট অপোজিট সেক্স’ কিংবা ‘ফাইভ হাড্রেড প্লাস ওয়েজ টু মেক মানি’ মার্কা রদ্দি বই৷ হতাশায় এক কাপ কফি খেয়ে বড় ঘড়ির নিচে এসে দাঁড়ালেন হৃষীকেশ৷ 


অপু এল সওয়া নটায়৷ তপুও তার পরপরই ঢুকল৷ হৃষীকেশকে দেখে অপু বলল, ‘অনেকক্ষণ এসেছ?’

হৃষীকেশ বললেন, ‘এই ঘন্টাখানেক হবে৷’

তপু বলল, ‘ট্রেন তো দশটা দশে৷ এত আগে এসেছ কেন?’

হৃষীকেশ জবাব দিলেন, ‘রাস্তাঘাটের ব্যাপারে কিচ্ছু ভরসা নেই৷ তার চেয়ে হাতে খানিকটা সময় নিয়ে বেরোনোই ভালো৷’

অপু শুনে হাসল৷

হৃষীকেশ বললেন, ‘তোমাদের খুব খিদে পেয়ে গেছে নিশ্চয়ই৷ ফাল্গুনি কিন্তু রাতের জন্য লুচি-আলুর দম করে পাঠিয়েছে৷ ট্রেনে উঠে খুলব৷’

তপু বলল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ৷ কিচ্ছু চিন্তা কোরো না৷ আমি দুপুরের পর থেকে আর ভালো করে কিছু খাই নি৷’

অপু বলল, ‘চলো আমরা প্ল্যাটফর্মে গিয়ে দাঁড়াই৷ ট্রেন দিয়ে দেবে এবার৷’


তিনটে সিটই পাওয়া গেছে আপারে৷ হৃষীকেশ শুনে বললেন, ‘আপারই ভালো৷ একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট৷ যখন খুশি উঠে পড়লেই হল৷ ছোটবেলায় মামার বাড়িতে গিয়ে কতবার গাছে চড়েছি৷ পেয়ারা গাছের মগডালে উঠে বসে থাকতাম ছুটির দিনে৷’

তপু বলল, ‘ঘুমের মধ্যে না পড়ে গেলেই হল৷’


ট্রেন ছাড়ল বারো মিনিট লেট করে৷ বাঙালবাবুর ব্রিজটা ছাড়াতেই তপু উসখুশ করে বলে উঠল, ‘লুচি-আলুর দমটা কোন্ ব্যাগে আছে কাকু?


***

রায়পুর বেশ জমকালো জায়গা৷ স্টেশন থেকে বেরিয়েই দোকানপাট বাজার আর ট্যাক্সি স্ট্যান্ড৷ অপুদের দেখে একজন এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল, ‘কাঁহা যায়েঙ্গে?’ 

তপু বলল, ‘হোটেল অতিথি৷’

লোকটা বলল, ‘জাদা নেহি মাঙ্গুঙ্গা৷ দো শো রুপেয়া দে দেনা৷’

হৃষীকেশ বললেন, ‘ঠিক হ্যায়৷’

অপু গলা নামিয়ে বলল, ‘একটু দরাদরি করলেই আরেকটু কমে রাজি হত৷’


অপু বসল ড্রাইভারের পাশে৷ হৃষীকেশ আর তপু পিছনের সিটে বসলেন৷ এগারটা বেজে গেছে৷ স্টেশন মার্গে ভালোই জ্যাম৷ এফ এমে গান বাজছে৷ রঘুকুলরীত সদা চলি আয়ি৷ তপু শুনে গুনগুন করে উঠল৷ ট্যাক্সিওয়ালা গাড়ি চালাতে চালাতে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপলোগ সাইট সিয়িং কে লিয়ে জায়েঙ্গে তো ম্যাঁয় লে চলুঙ্গা৷’ 

হৃষীকেশ বললেন, ‘গানটা একটু আস্তে করতে বলো তো৷ ঠিক করে কথা শোনা যায় না৷’

লোকটা জিজ্ঞাসা করল, ‘কেয়া বোলা?’

অপু বলল, ‘আপ ইয়ে রঘুকুল কা ভলিউম থোড়া কম কর দিজিয়ে৷ আপকে বাত ঠিক সে সুনাই নেহি দে রহা হ্যায়৷’

লোকটা গানের ভলিউম কমিয়ে দিল৷

হৃষীকেশ বললেন, ‘শান্তি!’

একটু পরেই হোটেল এসে গেল৷ দুজন বেয়ারা এসে মালপত্রগুলো উঠিয়ে নিল৷

হৃষীকেশ ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ট্যাক্সিওয়ালাকে বললেন, ‘আপ কা নাম্বার হামে দে দিজিয়ে৷ জরুরত হোনে পর বাতা দেঙ্গে৷’ 

অপু নম্বরটা ফোনে তুলে নিল৷

—নামটা?

লোকটা উত্তর দিল, ‘মহম্মদ আখলাক৷’


(চলবে)


আগের পর্বগুলি পড়ুন : 

১) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (প্রথম পর্ব)

২) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (দ্বিতীয় পর্ব) 

৩) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (তৃতীয় পর্ব) 

৪) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (চতুর্থ পর্ব) 

৫) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (পঞ্চম পর্ব) 

৬) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (ষষ্ঠ পর্ব) 

৭) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (সপ্তম পর্ব) 

..................... 

[অলংকরণ : বিবস্বান]   


#ধারাবাহিক উপন্যাস #রহস্য উপন্যাস #তপোব্রত ভাদুড়ি #Thriller #সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন #silly পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

7

Unique Visitors

177666