উপন্যাস

সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (ষষ্ঠ পর্ব)

তপোব্রত ভাদুড়ি April 29, 2023 at 8:14 pm উপন্যাস

[ আগে যা ঘটেছে: মুম্বই মেলে হাওড়ায় আসার পথে অপরাজিতার এক সহযাত্রীর সুটকেস চুরি হয়। লোকটিকে রেলপুলিশের কাছে ডায়রি করতে পরামর্শ দিয়ে ট্যাক্সিতে বাড়ি ফেরার পথে হুমকি চিরকুট পায় অপু। পরে হৃষীকেশ কাকুর কাছে গিয়ে অপু আর ওর মাসতুতো ভাই তপু জানতে পারে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মিলিটারি অফিসার ড্যানিয়েল রিচার্ডসনের ডায়রিতে লিপিবদ্ধ শাহ সুজার চিঠির কথা, যার মধ্যে ছিল সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধনের সংবাদ। এরই মধ্যে রায়পুরের সিমরন হেরিটেজ হোটেলে পাওয়া যায় ড্যানিয়েলের বংশধর ডেরেক রিচার্ডসনের লাশ। ডেরেকের বাবা ডেনিস রিচার্ডসনের সঙ্গে হৃষীকেশ গুপ্তর সাক্ষাৎ হলে ডেনিস তাঁকে সুজার চিঠিটি দেখান। ]

....................

সাপ্তাহিক উপন্যাস 

পঞ্চম পর্বের পর 

..................... 


অপু ভোরের দিকে অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখছিল। কোথাও একটা যুদ্ধ হচ্ছে। হাতি ঘোড়া উট। সেপাইসান্ত্রি। মার মার কাট কাট ব্যাপার হঠাৎ ফোনের শব্দে স্বপ্নটা ভেঙে গেল। অপু ঘুমজড়ানো গলায় বলল, ‘হ্যাঁ। কী?’

—ঘুমোচ্ছিলি?

তপুর গলা।

—কেন? কী হয়েছে?

—আমি ট্রেনে। 

—ওহ্।

—হুট করে খবর পাঠিয়েছে। বর্ষামঙ্গলের রিহার্সাল শুরু হবে। তাই গণদেবতা ধরলাম।

—ওহ্।

—তিন-চারদিনেই ফিরে আসব। আচ্ছা, তুই ঘুমো এখন। পরে ফোন করব। 


ফোন হাতে নিয়েই আবার ঘুমিয়ে পড়ল অপু ।


***


স্কুল থেকে ফেরার পথে হৃষীকেশ একবার জিপিওতে ঢুঁ মারলেন৷ অমল এখন কাজ করে ফিলাটেলি সেকশনে৷ দূর থেকে দেখেই ঠাট্টা করে বলে উঠল, ‘অহো ভাগ্য মম! গুপ্ত আজ ব্যক্ত হয়েছেন৷’ 


হৃষীকেশ মৃদু হেসে বললেন, ‘তোদের পাড়ায় গিয়েছিলাম এর মধ্যে একদিন৷’

—হতভাগা! আসিস নি কেন বাড়িতে?

—রাতের দিকে গিয়েছিলাম বলে সময় করে উঠতে পারি নি৷ রাগ করিস না৷ পরে যাব আরেকদিন৷

—বেশ৷ যচ্ছ্রেয়ঃ স্যান্নিশ্চিতং ব্রুহি তন্মে৷

—তোকে একটা হেল্প করতে হবে৷ 

—বলে ফ্যাল৷  


হৃষীকেশ রিচার্ডসনদের ব্যাপারে সংক্ষেপে সব কথা বললেন৷ অমলকান্তি একটু গলা নামিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘নজর রাখতে হবে? না হাঁড়ির খবর চাই?’ 

হৃষীকেশ উত্তর দিলেন, ‘আপাতত হাঁড়ির খবরটুকু হলেই চলবে৷’ 

অমলকান্তি বললেন, ‘কাজ হয়ে যাবে৷ তবে খরচ আছে৷ ফিফটি পারসেন্ট অগ্রিম দক্ষিণা আমরা কে সি দাশে নিয়ে থাকি৷’

হৃষীকেশ হেসে বললেন, ‘চল৷ ওঠ৷’   


***


সন্ধ্যার সময়ে মেসে ফিরে অপুকে ফোন করল তপু৷ সারা দুপুর ‘গহন রাতে শ্রাবণধারা পড়িছে ঝরে’ গেয়ে গেয়ে গলাটা বসে গেছে৷ অপু ফোন ধরেই বলল, ‘আচ্ছা, তুই ভোরবেলায় আমাকে ফোন করেছিলি, না?’

তপু বলল, ‘যাব্বাবা! ভুলে গেছিস নাকি?’

অপু বলল, ‘না৷ মানে একটু আগে মনে হচ্ছিল, স্বপ্ন দেখেছি হয়ত৷’

—কী বেয়াক্কেলে ঘুম রে ভাই৷ 

—আচ্ছা, কিছু একটা ভরসার কথা বলেছিলি৷ তিন-চারদিন বাদে৷ ঠিক মনে পড়ছে না৷

—হা ভগবান! ভরসা নয়৷ বর্ষামঙ্গল৷ তুই একটা যা-তা৷ 

—ওহ্, তুই এখন শান্তিনিকেতনে? ওয়েদার কেমন?

তপু বলল, ‘উতল ধারা বাদল ঝরে৷’ 

অপু বলল, ‘হুঃ! এখানেও ননস্টপ৷ পিএইচডির কাজ নিয়ে বসেছি৷ গাইড একটু আগে ফোন করে চমকাল৷’

তপু হেসে বলল, ‘বেশ করেছে৷ ঘুমো আরও৷’

—চুপ কর৷ শয়তান৷

—শাহজাহানের খবর কী?

—জানি না৷ হৃষীকেশ কাকুকে ফোন করবি?

—তুই কর৷ 

—ধুর্ বাবা৷ আমাকে এখন দুটো গ্রাফ রেডি করতে হবে৷ অনেক কাজ৷

—আচ্ছা, দেখছি৷ রাখ৷


***


অন্ধকার গুমঘর৷ মাঝে মাঝে ধারালো আলো জ্বলে ওঠে৷ চোখের মধ্যে যেন ছুঁচ ফোটে৷ অল্প কিছুক্ষণের জন্য মুখ আর হাতের বাঁধন খুলে দিয়ে যায় একটা লোক৷ তার পাথরের মতো ভাবলেশহীন মুখ৷ দুচোখে হিমশীতল নিষ্ঠুরতা৷ লোকটা খাবার দিয়ে যায়৷ ঠান্ডা খাবার৷ সবটা খাওয়া যায় না৷ খেতে বসলে গলার মধ্যে দলা পাকিয়ে ওঠে অসহায় আকুলতা৷ 


মাঝে মাঝে আরেকজন আসে৷ জিমি৷ যখনই আসে, কড়া গলায় ধমক দিয়ে শাসায়৷ ভয় দেখায়, গলার নলি কেটে গায়েব করে দেবে৷ 


বাইরে কি এখন দিন? না রাত? মেঘ ডাকল? বৃষ্টি পড়ছে? এখান থেকে কিছুই ঠাহর যায় না৷ আজ কত তারিখ তাও এখন খেয়াল করা শক্ত৷ 


সামনের কঠিন দেয়ালটা যদ্দুর মনে পড়ছে দক্ষিণ দিক৷ দেয়ালের ওপারে বাইরে কোথাও একটা আড়াআড়ি রাস্তা চলে গেছে৷ এখান থেকে সোজাসুজি বেশ খানিকটা গেলে লোয়ার সার্কুলার রোড সেমেট্রি৷ ভিতরটা শান্ত নিরিবিলি৷ মাথার উপরে ছায়ার আড়াল তোলা ছাতার মতো অনেক কালের বড় বড় গাছ৷ অর্জুন শিরীষ মেহগনি৷ আর বিকালবেলার কমলা রোদ৷


এ ঘরে রোদ ঢোকে না৷ মাঝে মাঝে ধারালো আলো জ্বলে ওঠে৷ আলো নিভে গেলেই লোমশ জন্তুর মতো আবার গুঁড়ি মেরে গিলতে আসে প্রকাণ্ড একটা অন্ধকার৷


***


রাত্তির এগারোটায় তপু ফোন করল৷

—জেগে আছিস?

—বল৷

—হৃষীকেশ কাকুকে ফোন করেছিলাম৷

—কী বললেন?

—ডেরেকের বাবার সঙ্গে পরশু দেখা হয়েছে৷ আগে একদিন দুপুরের দিকে গিয়ে ফিরে এসেছিলেন৷ ভদ্রলোক তখন ডাক্তারখানায় গিয়েছিলেন৷ পরে নিজেই ফোন করে ডেকেছেন৷

—আর কী বললেন?

—শাহজাহানের চিঠিটা ওঁদের বাড়িতেই আছে৷ কাকুকে দেখিয়েছেন৷

—ওটা সুজার চিঠি৷

—হ্যাঁ হ্যাঁ, সরি৷ বাপ-ছেলেতে গুলিয়ে গেছে৷

—এই?

—না৷ আরেকটা কথা বললেন ফোন রাখার আগে৷ 

—কী কথা? 

—রবীন্দ্র-সংগীতের লাইন একটা৷ 

—কোন্ লাইন? একটা কথা জানার জন্য তোকে চোদ্দটা প্রশ্ন করতে হয়৷ অদ্ভুত!

—আরে, ভুলভাল লাইন৷ শুভখন হঠাৎ এলে ভেসে আসে সুগন্ধ৷ বললেন, এটা একটা ধাঁধা৷ উত্তর দিতে পারলে পুরস্কার পাবে চোখের জল৷

—হা হা৷

—হাসছিস কেন?

—পাচ্ছে হাসি হাসছি তাই৷ চল, রাখ এখন৷ পড়তে বসব৷


***


অমল ফোন করল চারদিন পর৷ শুক্কুরবার৷ সন্ধ্যাবেলায় হৃষীকেশ বাংলা পৌরাণিক নাটকের ওপরে সাজঘর পত্রিকার জন্য একটা প্রবন্ধ লিখছিলেন৷ ফোন ধরতেই ওপার থেকে অমলকান্তি বলল, ‘ধ্যান ভাঙালাম নাকি, মাস্টারমশাই?’

হৃষীকেশ বললেন, ‘আরে ধুর্৷ বল৷ খবর কী?’

—হোমওয়ার্ক কমপ্লিট৷

—চটপট ঝেড়ে কাশ৷

—আমাদের পাড়ায় একটা ছেলে আছে, বুঝলি৷ মুজিবর৷ পার্টি করে৷ ছেলেটাকে ধরেছিলাম৷ ওদের কাছে ভোটার লিস্ট থাকে তো৷ মুজিবর আমাকে অদ্ভুত কথা বলল৷

—কী বলল?

—রিচার্ডসনরা এ পাড়ায় বেশিদিন হল আসে নি৷ আগে থাকত বো-ব্যারাকে৷ বুড়োর নাকি দুটো ছেলে৷ তবে একজন অনেক আগেই বেপাত্তা৷ আরেকটা থাকত বাপের কাছে৷ যেটা মার্ডার হয়েছে৷ দুভায়ের কেউই কখনও ভোট-ফোট দেয় নি৷ ওদের নামে ছাপ্পা পড়ে৷

—গুড বয়৷ তোকে দরকার পড়লে আবার জ্বালাব৷

—এনিটাইম ডার্লিং৷

হৃষীকেশ হেসে বললেন, ‘রাখছি এখন৷’


***


সকাল সকাল হৃষীকেশ কাকুর ফোন৷ ধরতেই উত্তেজিত গলায় বললেন, ‘তপু, তোমাদের লালবাজারের কাকুর কাছ থেকে একটা খবর জোগাড় করতে হবে৷ খুব আর্জেন্ট৷’

তপু বলল, ‘কী খবর কাকু?’

—ডেরেক রিচার্ডসনের কললিস্ট থেকে দেখতে হবে, সুলতান নামের সেই ভাড়াটে খুনিটার সঙ্গে শেষ কলটা কখন হয়েছে আর কোথা থেকে হয়েছে।  

—আচ্ছা কাকু। আমি আসলে শান্তিনিকেতনে এসেছি দিনকয়েক আগে। আগামীকাল ফিরব। অপুকে ফোন করে এখুনি বলে দিচ্ছি।

—ঠিক আছে। … আর শোনো, ফিরে এসে দেখা কোরো শিগগির৷ এদিকে অনেক কাণ্ড হয়েছে। 

—হ্যাঁ হ্যাঁ, আগেই যেতাম আমরা। এই বর্ষামঙ্গলটা সব গণ্ডগোল পাকিয়ে দিল।

‘আচ্ছা, ভালো থেকো’ বলে কাকু ফোন কেটে দিলেন৷

***


স্কুল ছুটির পরে বাড়ির দিকে না গিয়ে হৃষীকেশ আজ বো-ব্যারাকে গেলেন৷ মহাযুদ্ধের সময়ে তৈরি সারি সারি একই ঢঙের বাড়ি৷ শহরের অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের পুরোনো ঠিকানা৷ এখন অবশ্য অনেক বাড়িই হাতবদল হয়ে গেছে৷ এ পাড়ায় আজকাল পাঞ্জাবি গুজরাটি সিন্ধ্রি নানা পরিবারের বাস৷ পুরোনো বাসিন্দাও পড়ে আছেন কেউ কেউ৷ প্রিয়জনের স্মৃতি আঁকড়ে৷ সেরকমই একজনকে খুঁজছিলেন হৃষীকেশ৷ দু-চারটে জায়গায় খোঁজ করার পরে শেষমেশ সন্ধ্যার মুখে দেখা হল অ্যাঞ্জেলা বিশ্বাসের সঙ্গে৷ ডেনিস রিচার্ডসনের নাম শুনে খুব খুশি হয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ চিনি৷ ওঁর ওয়াইফ শান্তিলতা আমার বুজম ফ্রেন্ড ছিল৷ সেন্ট জর্জেস স্কুলে আমরা টুয়েলভ ইয়ার্স একসঙ্গে চাকরি করেছি৷’ হৃষীকেশও স্কুলে পড়ান শুনে অ্যাঞ্জেলা বললেন, ‘ভিতরে আসুন না, স্যার৷’


গৃহকর্ত্রীর আন্তরিক আহ্বান উপেক্ষা করতে না পেরে হৃষীকেশ ঘরে ঢুকে বসলেন৷ ছোট্ট কামরা৷ নিপুণ হাতে ঝকঝকে তকতকে করে গোছানো৷ আসবাব সামান্যই৷ সামনের দেয়ালে যিশুর একটা ছবি৷ এল গ্রেকো৷  

(চলবে)


আগের পর্বগুলি পড়ুন : 

১) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (প্রথম পর্ব)

২) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (দ্বিতীয় পর্ব) 

৩) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (তৃতীয় পর্ব) 

৪) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (চতুর্থ পর্ব) 

৫) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (পঞ্চম পর্ব)


........................... 

[অলংকরণ : বিবস্বান] 





#ধারাবাহিক উপন্যাস #রহস্য উপন্যাস #তপোব্রত ভাদুড়ি #Bengali Thriller #সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন #silly পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

52

Unique Visitors

215838