উপন্যাস

সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (দ্বিতীয় পর্ব)

তপোব্রত ভাদুড়ি April 2, 2023 at 4:36 am উপন্যাস

....................

সাপ্তাহিক উপন্যাস 

প্রথম পর্বের পর

........................ 


—আজ্ঞে, মা কালীর দিব্যি ঘুমোইনি৷ চোখটা একটু বন্ধ করেছিলাম মাত্র। তার মধ্যেই যে কী করে এরম ঘটে গেল।

—চুপ করো। তুমি হচ্ছ একটা গবেটচন্দ্র। তোমার ওই চোখ আমি উপড়ে নেব। 

—দোহাই হুজুর৷ আপনি হলেন মা-বাপ। এবারকার মতো মাফ করে দিন।

—সাজা তোমাকে পেতেই হবে। না হলে বস আমাকে ছিঁড়ে খাবে। অ্যাই, তোমরা হাঁ করে দেখছ কী? গর্দভটাকে নিয়ে গিয়ে চোখদুটো তুলে নিয়ে ছেড়ে দাও। 

হুকুম শুনে অন্ধকার থেকে দুটো ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এল। লোকটাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে চলে গেল পাশের ঘরে। চাপা গোঙানির আওয়াজ ভেসে আসতে সর্দার কড়া ধমক লাগাল, ‘আঃ! হইচই করিস না। বসকে ফোন লাগাচ্ছি।’  

***

হৃষীকেশ অপুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এবার বলো, যে কারণে তোমাদের আবির্ভাব৷ কবে থেকে ফলো করছে তোমাকে? পুলিশে খবর দিয়েছ?’ 

তপু হাঁ হয়ে বলল, ‘তুমি কী করে জানলে?’

হৃষীকেশ গুনগুনিয়ে উঠলেন, ‘শুষ্কতাপের দৈত্যপুরে দ্বার ভাঙবে বলে, রাজপুত্র, কোথা হতে হঠাৎ এলে চলে। — আজ এগারোই জ্যৈষ্ঠ৷ এখন দুপুর আড়াইটে। তার ওপর উলটোদিকের ফুটপাথে দেখতে পাচ্ছি একটা লোক ঘণ্টাখানেক ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্যেই চারটে সিগারেট পুড়িয়ে ফেলেছে। লোকটাকে আগে এ তল্লাটে দেখিনি।’ 

অপু হেসে বলল, ‘এইজন্যই আমরা পুলিশের কাছে না গিয়ে তোমার কাছে এসেছি।’

হৃষীকেশ কাকু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ভয় পাওনি তো?’ 

অপু বলল, ‘ফুস্, ভয় পেতে বয়েই গেছে৷ ভয় তো ওদের। আমি শুধু জানতে চাই, ব্যাপারটা কী।’ 


অপুর মুখ থেকে সব কথা খুঁটিয়ে শোনার পরে হৃষীকেশ বললেন, ‘দেখো, আমি তো শ্রীভৃগু নই। গ্রহনক্ষত্রের যোগাযোগ এখনও পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারছি না। তবে কয়েকটা ব্যাপার জলের মতো পরিষ্কার। প্রথমত, তোমাকে যারা রাস্তায় হুমকি দিয়েছে বা পিছু নিয়ে এতদূর এসেছে, তাদের ঠিক সাধুপুরুষ বলা যায় না। তারা অসম্ভব বেপরোয়া। কিছু একটা তারা আড়াল করতে চায়। একটা কোনও অপরাধ। তার একটাই মানে দাঁড়াচ্ছে। ট্রেনের ওই লোকটার সুটকেসে যে কাগজখানা ছিল, সেটা মামুলি কোনও দলিল-দস্তাবেজ নয়। নয়তো কীসের কাগজ জিজ্ঞাসা করলে লোকটা খামোখা ওরকম চুপ করে যাবে কেন? আর পুলিশে রিপোর্ট করার কথাতেই বা বাবাজির এত ভয় কীসের?’  

তপু জিজ্ঞাসা করল, ‘এখন আমাদের কী করা উচিত?’ 

অপু বলল, ‘আমাদের চলাফেরার ব্যাপারে ওরা যেমন খবর রাখছে, আমরাও যদি ওদের ওপর নজর রাখতে পারতাম, ভালো হত।’

‘ঠিক বলেছ। অন্তত এদের ডেরাটা কোথায় জানা দরকার।’ হৃষীকেশ কাকু বললেন।

‘একটা কথা কিন্তু মাথায় রাখতে হবে। ট্রেনে যে লোকটার সুটকেস চুরি হয়েছে আর কাগজটা এখন যাদের হাতে পৌঁছেছে, তারা নিশ্চয়ই দুটো আলাদা গ্যাঙের লোক।’ অপু বলল। 

তর্পণ বলল, ‘সত্যি! একটা সাধারণ কাগজের জন্য এতগুলো লোক এমন হন্যে হয়ে উঠেছে, বিশ্বাস হয় না। একবার রিজওয়ানুর কাকুকে জানিয়ে রাখলে ভালো হত না?’

হৃষীকেশ বললেন, ‘রিজওয়ানুর কে?’ 

অপু উত্তর দিল, ‘আমাদের তিনটে বাড়ি পরে থাকেন। রিজওয়ানুর রহমান। আইপিএস। লালবাজারে এনফোর্সমেন্ট ব্র্যাঞ্চে আছেন।’ 


হৃষীকেশ কাকু হাঁক দিলেন, ‘ফাল্গুনি!’ ফাল্গুনি কাকা দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন, ‘আবার চা?’ হৃষীকেশ বললেন, ‘চা লাগবে না। তুই চট করে জামাটা গলিয়ে নে তো। উলটোদিকের ফুটপাথে একটা লোক দাঁড়িয়ে বাড়ির দিকে নজর রাখছে। ওরা বেরোলে হয়তো পিছু নেবে। তুই লোকটার ওপর নজর রাখবি। দেখে আসবি, শেষ পর্যন্ত কোথায় যায়। এই নে৷ এই আড়াইশ টাকা সঙ্গে রাখ।’


অপু আর তপু উঠে পড়ল। হৃষীকেশ বললেন, ‘চললে কোথায়? তপু এতদিন পরে শান্তিনিকেতন থেকে এসেছে। আগে একটা গান শোনাক। হাওয়াটা বেজায় থমথমে হয়ে উঠেছে।’ অপু হাসল। তপু কাঁচুমাচু মুখে বলল, ‘কী গান?’ হৃষীকেশ বললেন, ‘তোমাদের সঙ্গীত ভবনে নতুন কী শিখেছ, তাই একখানা গাও।’ তপু বলল, ‘একটা আগমনী শিখেছি বাড়ি আসার আগে। শুনবে?’ অপু বলল, ‘এই মে মাসে আগমনী?’ হৃষীকেশ বললেন, ‘বেশ তো। শোনাক না।’ তপু চোখ বন্ধ করে রিনরিনে গলায় গান ধরল, ‘গিরিরানি, রানি এই নাও তোমার উমারে।’ অপু পাশ থেকে চাপা গলায় বলল, ‘বাঃ! এইভাবেই গাও। চ্যাঁচায়ো না।’

***

—ব্রেকিং নিউজ বল।

—ধানি পটকা সুকিয়া স্ট্রিটে একজনের সঙ্গে দেখা করতে গেসলো। সঙ্গে একটা ছুঁচোবাজিও ছিল। আমি ফুল টাইম ফলো রেখেছিলাম। 

—কার সঙ্গে দেখা করতে গেছিল? কী করে মালটা? নাম কী?

—যা! কেলো করেছে। সেইটা তো জানা হয়নি। আমি আসলে রাস্তার এদিকটায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। বাড়ির সামনে গেলে যদি কেউ দেখে ফেলে।

—কেউ দেখেনি তো?

—না না। দেখেনি। 

—মেয়েটাকে আরও কিছুদিন চোখে চোখে রাখতে হবে। আর ওই ছোঁড়াটার ওপরেও নজর রাখবি। আচ্ছা, এখন ফোট্। 

***

সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ হৃষীকেশ কাকু কল করলেন৷ লোকগুলো গিরিশ পার্কের কাছে থাকে। দুনম্বর নন্দ মল্লিক লেন। ফাল্গুনি কাকা গিয়ে দেখে এসেছে৷ কাকু ফোন রাখতেই অপরাজিতা তপুকে বলল, ‘চল, রিজওয়ানুর কাকুর কাছে যেতে হবে।’ 


কাকুর বাড়িতে গিয়ে বেল বাজাতেই দাদি দরজা খুললেন। অপুকে দেখে বললেন, ‘কত বড় হয়ে গেছিস তুই। আয়, ভিতরে আয়৷ তোর চাচা একটু আগেই ফিরল।’ অপুরা বসার ঘরে অপেক্ষা করতে লাগল। একটু পরে দাদি ঠান্ডা বেলের পানা দিয়ে গেলেন। রিজওয়ানুর কাকু নিচে নামলেন মিনিট দশেক পরে। অপুকে দেখেই বললেন, ‘আবার কী ঝামেলা পাকিয়ে এসেছিস? সঙ্গে এটা কে?’ অপু বলল, ‘আমার মাসির ছেলে। তপু।’ রিজওয়ানুর তপুকে বললেন, ‘কী করা হয়?’ তপু জবাব দিল, ‘গানবাজনা নিয়ে পড়াশোনা করছি। বিশ্বভারতীতে।’ 

‘আর তুই তো কেমিস্ট্রিতে মাস্টার্স করছিলি?’ রিজওয়ানুর কাকু অপুকে জিজ্ঞাসা করলেন।

অপু বলল, ‘মাস্টার্স তো কবেই শেষ হয়ে গেছে। এখন রিসার্চ করছি টিআইএফআরে।’ 

কাকু বললেন, ‘কী নিয়ে রিসার্চ?’ 

অপু উত্তর দিল, ‘আমার কাজটা কেমিকাল বায়োলজির। আয়ন চ্যানেল ব্লকারের ওপর। মূলত পটাশিয়াম চ্যানেলের ব্লকার নিয়ে।’ 

‘আচ্ছা। এবার বল, আমার কাছে কী দরকারে এসেছিস?’, রিজওয়ানুর প্রশ্ন করলেন। 


অপু গোড়া থেকে বলতে শুরু করল৷ মাঝেমধ্যে তপু দুটো-একটা কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। রিজওয়ানুর পুরো ব্যাপারটা শুনে বললেন, ‘বাড়ি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়। আজ রাত্রেই সবকটাকে জালে তুলে নেব। গিরিশ পার্ক থানায় এখুনি জানাচ্ছি না। আমাদের টিম রেড করতে গেলে ওদের ডেকে নেব।’ 

অপু বলল, ‘তোমার সঙ্গে তাহলে কাল একবার দেখা করি?’ 

রিজওয়ানুর বললেন, ‘কাল না। পরশু বিকালের দিকে আয়। লালবাজারে। কালকের দিনটা হাতে রাখছি জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। জেরায় কিছু বেরোলে হয়তো আরও কোথাও হানা দিতে হবে। নন্দ মল্লিক লেনের লোকগুলো মনে হয় বোড়ে। আসল চাঁই আড়ালে আছে।’ 

অপুরা উঠে পড়ল। রিজওয়ানুর দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসে তপুকে বললেন, ‘ঠান্ডা মাথায় বসে তোমার গান শুনব পরে একদিন।’


বাড়ির পথে হাঁটতে হাঁটতে অপু বলল, ‘বেশি অহংকার করিস না। এমন কিছু ভালো গলা নয় তোর।’


***

বরমদেও প্রসাদের দেশের বাড়ি ভানুপ্রতাপপুরে। গত সেপ্টেম্বরে রায়পুরের সিমরন হেরিটেজ হোটেলে কাজে ঢুকেছে। রাতের দিকে ম্যানেজারকে সে খবর দিল, তিনশো সাত নম্বরের সায়েব দুদিন ধরে দরজা খোলেনি। ঘর সাফ করার জন্য আজ অনেকক্ষণ ধরে ডোরবেল বাজানোর পরেও সাড়াশব্দ না পেয়ে ফিরে এসেছে। ম্যানেজার একটু সাতপাঁচ ভেবে বলল, ‘চলো, দেখতে হ্যায়।’ 


ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে ঘর খোলা হল৷ গুমোট বাতাসে একটা চাপা দুর্গন্ধ। ধবধবে বিছানার উপরে হাতদুটো মুঠো করে উপুড় হয়ে পড়ে আছেন উনচল্লিশ বছরের ডেরেক রিচার্ডসন। 

(চলবে)

আগের পর্ব পড়ুন : সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (প্রথম পর্ব) / তপোব্রত ভাদুড়ি

..................

[অলংকরণ : বিবস্বান] 


#উপন্যাস #সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন #তপোব্রত ভাদুড়ি #silly পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

44

Unique Visitors

219457