সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (প্রথম পর্ব)
রাতের ট্রেনে একফোঁটা ঘুম আসে না অপরাজিতার। তার ওপরে আশেপাশে কম করে জনাদশেক লোক মিহি মোটা নানারকম সুরে একনাগাড়ে নাক ডেকে চলেছে। ঠিক যেন ব্যান্ডপার্টি। ট্রলিব্যাগটা নিচে দাঁড় করানো আছে। পৌনে এগারোটা থেকে সাড়ে তিনটে পর্যন্ত প্রায় চল্লিশবার ব্যাগের দিকে তাকিয়ে দেখেছে। গাড়ি এবার খড়গপুরে ঢুকল। অপরাজিতা আপার বার্থ থেকে নেমে এসে জানলা দিয়ে এক ভাঁড় চা কিনে খেল। তারপর গাছে চড়ার মতো আবার তরতর করে উঠে পড়ল উপরে।
শেষরাতের দিকে কখন যে টুপ করে চোখের পাতাটা লেগে এসেছিল, খেয়াল করেনি৷ ঘুমটা আচমকা ভেঙে গেল একটা লোকের হাউমাউ চিৎকারে। লোকটার সুটকেসখানা কেউ একজন নিয়ে হাওয়া হয়ে গিয়েছে। বেচারা! এইজন্যই ও রাতের ট্রেনে একদম ঘুমোতে পারে না। একটু অসাবধান হলেই কে যে কখন মালপত্র নিয়ে চম্পট দেবে, তার আর ঠিক নেই। অন্যান্য সহযাত্রী লোকটিকে ঘিরে ধরে সান্ত্বনা দিচ্ছে। অপরাজিতা ভিড় ঠেলে কাছে গিয়ে দাঁড়াল। সমবেদনার সুরে জিজ্ঞাসা করল, ‘টাকাপয়সা কিছু খোয়া যায়নি তো?’ লোকটা বলল, ‘টাকাপয়সা পকেটেই আছে। সুটকেসের মধ্যে খুব দরকারি একটা কাগজ ছিল।’ কীসের কাগজ জিজ্ঞাসা করতেই লোকটা একদম চুপ করে গেল। উলটে এমন একটা ভাব করল যেন প্রশ্নটা শুনতেই পায়নি। অপরাজিতা বলল, ‘হাওড়ায় নেমে রেলপুলিশে একটা ডায়রি করা উচিত।’ আরও কেউ কেউ কথাটায় সায় দিয়ে বলল, ‘ঠিক বলেছেন।’
ট্রেন হাওড়ায় ঢোকার মিনিট পাঁচেকের মধ্যে সবাই যে যার মতো নেমে গেল। লোকটা তখনও চুপ করে বসে ছিল। অপরাজিতার খুব মায়া লাগছিল। একটু ইতস্তত করে প্রশ্ন করল, ‘আমি কি আপনার সঙ্গে জিআরপি-তে যাব?’ লোকটি উত্তর দিল, ‘না, না, দরকার নেই। আমি একাই যেতে পারব।’ অপরাজিতা বলল, ‘আমার এক কাকা লালবাজারে চাকরি করেন। আপনি চাইলে আমি আপনার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে পারি।’ লোকটা তার কথার কোনও জবাব দিল না। অগত্যা ও ‘আসছি’ বলে পা বাড়াল।
প্রিপেড ট্যাক্সির বুকিং কাউন্টারে মস্ত লাইন। প্রায় আধঘণ্টা অপেক্ষা করার পরে একটা গাড়ি পাওয়া গেল। মে মাসের শেষে গরমটা দুঃসহ হয়ে উঠেছে। কবে যে কলকাতায় বর্ষা ঢুকবে! অপরাজিতা ভাবতে লাগল, বাড়িতে ঢুকে শাওয়ারের নিচে বসে থাকবে৷ রেড রোডে ট্রাফিক সিগন্যালে গাড়িটা দু-মিনিটের জন্য দাঁড়িয়ে ছিল। চলতে শুরু করতেই জানলা দিয়ে হঠাৎ একটা দলাপাকানো কাগজ এসে কোলের ওপর পড়ল। ও অবাক হয়ে কাগজটা খুলল। লাল কালিতে বড় বড় করে লেখা আছে, ‘নিজের চরকায় তেল দাও।’
***
‘অপু ওঠ্। শরবতটা খেয়ে নে।’— মায়ের ডাকে চোখ খুলে মোবাইলটা হাতে নিল অপরাজিতা। তিনটে মিসড কল। তর্পণ ফোন করেছিল। তর্পণ ওর মাসির ছেলে। অপুর সঙ্গে মিলিয়ে সবাই ডাকে তপু। ঘুরিয়ে ফোন করতেই তপু বলল, ‘নিদ্রা যায় কুম্ভকর্ণ কর্ণ নাহি নড়ে। ছোটোবেলায় ঠাম্মার মুখে শুনেছিলাম।’
অপু বলল, ‘কে কাকে বলছে! নিজে তো দশঘণ্টা ঘুমোস। ফোন করেছিলি কেন?’
তপু বলল, ‘আজ নন্দনে সোয়া ছটায় অ্যাডভেঞ্চার্স অফ টিনটিন দেখতে যাবি? তাহলে টিকিট কাটব।’
অপু বলল, ‘তপু, আমি বাচ্চা নই যে টিকিট কেটে টিনটিন দেখব।’
তপুকে অপু মাঝেমধ্যেই ঘুরিয়ে বাচ্চা বলে। আর বাচ্চা বললেই তপু ভয়ানক মুষড়ে পড়ে। ফোনের মধ্যে দুবার ফোঁসফোঁস শব্দ শুনে অপু বলল, ‘তুই সোজা আমাদের এখানে চলে আয়৷ খবর আছে।’ ‘খবর আছে’ শুনেই তপু চাঙ্গা হয়ে উঠল। বলল, ‘এখখুনি বেরোচ্ছি। মাসিকে বল চাট্টি ডালভাতের ব্যবস্থা করতে।’ ‘চাট্টি ডালভাত’ বলতে তপু ঠিক কী বোঝাতে চাইল, অপুর বুঝতে অসুবিধা হল না। তপু একটু খেতে ভালোবাসে। তবে বড় মুখচোরা। খেতে বসে কোনও পদ ভালো লাগলেও দ্বিতীয়বার মুখ ফুটে চাইবে না। তাই কোড ল্যাঙ্গুয়েজে বলতে বলল, ‘চাট্টি ডালভাত’। বুঝ লোক যে জান সন্ধান।
দুপুরে খাওয়ার পরে ঘরে এসে তর্পণকে কাগজের টুকরোটা দেখাল অপরাজিতা। তপু দেখেই চোখ বড় বড় করে চেঁচিয়ে উঠল, ‘এ তো পরিষ্কার হুমকি দিয়েছে। এখখুনি থানায় গিয়ে ডায়রি কর।’ অপু বলল, ‘চুপ। আস্তে কথা বল। মা বাবা জানতে পারলে আমার বাড়ি থেকে বেরোনোই বন্ধ হয়ে যাবে। তোকে বলাই ভুল হয়েছে। ভীতু কোথাকার।’ শেষের খোঁচাটাতে আহত হয়ে তপু বলল, ‘তুই সবসময়ে এমন একটা ভাব দেখাস যেন আমার থেকে কত বড়। আমারও নাইনটি ফোরে জন্ম। ভুলে যাস না৷’ অপু বলল, ‘বড়ই তো। তোর সাতই জুলাই আর আমার তিরিশে জুন। নে, পেন্নাম কর।’
বিছানা থেকে উঠে পায়চারি করতে করতে অপু বলল, ‘হুমকি দিয়েছে, সেটা নিয়ে ভাবছি না। ভাবছি, হুমকিটা দিল কেন। হুমকি কখন দেয় মিস্টার ওয়াটসন?’ তপু বলল, ‘ভয় দেখানোর জন্য।’ অপু বলল, ‘না। হুমকি দেয় ভয় পেলে। চিরকুটটা যেই দিক, সে ভয় পেয়েছে।’ তপু বলল, ‘ঠিক। কিন্তু কেন?’ অপু বলল, ‘ভয়ের কারণ হল, সে একটা কিছু লুকোতে চায়। তার চিন্তা হয়েছে, আমি ব্যাপারটা জেনে ফেলব। মানুষ কখন কিছু লুকোতে চায়, বলতে পারিস?’ তপু বলল, ‘যখন সে অপরাধ করে।’ অপু বলল, ‘নির্ভুল। তাহলে ব্যাপার দাঁড়াচ্ছে এইরকম। কেউ একটা অপরাধ করেছে। আর আমি না চাইতেও তার সঙ্গে জড়িয়ে গেছি। অপরাধটা কী, সেটা না জানা পর্যন্ত আমার শান্তি হবে না, তপু।’
তপু বলল, ‘তাহলে কী করবি?’
অপু বলল, ‘পুলিশকে এখনই জানাতে চাইছি না। ব্যাপারটা পাঁচকান হলে অপরাধী সাবধান হয়ে যাবে। তোর সেই হৃষীকেশ কাকু এখন কোথায় আছেন?’
তপু বলল, ‘হৃষীকেশ কাকু তো কলকাতাতেই আছেন। বাড়ি ছেড়ে সচরাচর বেরোন না। যাবি?’ অপু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমি দশ মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে আসছি। ’
***
সুকিয়া স্ট্রিটে ঢুকে ডান হাতের ছটা বাড়ি ছেড়ে সাত নম্বর বাড়িটাই ‘খেয়াল খোলা’। দরজার বাইরে ঝকঝকে নেমপ্লেটে লেখা ‘হৃষীকেশ গুপ্ত’। বেল বাজাতেই হৃষীকেশ কাকুর সর্বক্ষণের সঙ্গী ফাল্গুনী কাকা দরজা খুলে দিলেন। তপুদের দেখে বেজায় খুশি হয়ে বলে উঠলেন, ‘এসো, এসো, জিবেগজা বানাচ্ছি।’ জিবেগজার নাম শুনেই তপুর জিভে জল চলে এল। অপু সেটা বুঝতে পেরে গলা নামিয়ে বলল, ‘হ্যাংলাথেরিয়াম’।
হৃষীকেশ কাকু ওঁর পড়ার ঘরে পাতলা একখানা বই থেকে কিছু একটা নোট করছিলেন। অপু দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ডাকল, ‘কাকু, আসব?’ কাকু মুখ তুলে বললেন, ‘আরে! ফেলু আর তোপসে! ভিতরে এসো!’ অপু আর তপু ঘরের ভিতরে ঢুকে দুটো চেয়ার টেনে নিয়ে কাকুর কাছে বসল। হৃষীকেশ বইটা বন্ধ করে রাখলেন। তপু টেবিলের ওপরে ঝুঁকে বইটার নাম দেখার চেষ্টা করছিল। ‘সাউথ পার্ক স্ট্রিট সেমেট্রি– রেজিস্টার অফ গ্রেভস অ্যান্ড স্ট্যান্ডিং টম্বস’।
‘কবরখানায় কী খুঁজছ?’ তপু কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করল।
হৃষীকেশ উত্তর দিলেন, ‘মিউটিনির সময়কার একজন সাহেবের সম্পর্কে একটু খোঁজখবর নিচ্ছি।’
অপু বলল, ‘এইট্টিন ফিফটি সেভেনের গ্রেট মিউটিনি?’ হৃষীকেশ বললেন, ‘হ্যাঁ। তবে সাহেব তার পরেও আড়াই বছর বেঁচে ছিলেন। আর মৃত্যু হয় এই কলকাতায়।’
হৃষীকেশের কথা শেষ হতে না হতেই ফাল্গুনী কাকা বড় বড় প্লেটে লুচি আলুর দম আর জিবেগজা নিয়ে ঢুকে পড়লেন। অপু আঁতকে উঠে বলল, ‘বাপরে! আমি এত খেতে পারব না।’ তপু বলল, ‘চিন্তা করিস না। আমি তো আছিই।’ ফাল্গুনী কাকা জলের গেলাসগুলোয় ঢাকনা দিতে দিতে বললেন, ‘খেয়ে নাও। খেলে বুদ্ধি খুলবে।’ হৃষীকেশ কাকু এখন চা ছাড়া অন্য কিছু খাবেন না। চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে তিনি আবার বলতে শুরু করলেন, ‘ড্যানিয়েল রিচার্ডসন ল্যাঙ্কাশায়ার রেজিমেন্টের মিলিটারি অফিসার ছিলেন। কিছুদিন আগে তাঁর একটা ডায়ারি আমার হাতে এসেছে। ড্যানিয়েল সেখানে লিখেছেন, তাঁর মা মেরি রিচার্ডসন এইট্টিন থার্টি এইটে ক্যালকাটায় পরলোকগমন করেন। তাঁকে বেরিয়াল গ্রাউন্ড রোডে ড্যানিয়েলের বাবা হোরেশিও রিচার্ডসনের পাশে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। বেরিয়াল গ্রাউন্ড রোড হচ্ছে এখনকার পার্ক স্ট্রিট। সাউথ পার্ক স্ট্রিট সেমেট্রিতে হোরেশিও আর মেরির কবর আছে। সেইসঙ্গে আছেন ড্যানিয়েল। ডায়েড ইন এইট্টিন সিক্সটি অ্যানো ডমিনি।’
চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে আলমারি থেকে ছোট্ট একটা ডায়রি বার করলেন হৃষীকেশ। অপুর খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল। হাতমুখ ধুয়ে এসে কাকুর হাত থেকে মরক্কো চামড়ায় বাঁধানো ডায়রিটা নিল। হৃষীকেশ বললেন, ‘দ্য মোস্ট ইন্ট্রিগিং পার্ট অফ ইট ইজ্ রিটন অন দ্য নাইনটিনথ্ অক্টোবর। ইটস্ অ্যাবাউট আ ট্রেজার। রয়াল ট্রেজার।’
‘গুপ্তধন!’ তপুর মুখ থেকে জিবেগজাটা প্লেটের ওপর খসে পড়ল। অপু ততক্ষণে ডায়রির পাতা উলটে অক্টোবরের উনিশ তারিখে পৌঁছে গেছে। সেখানে ছোট ছোট অক্ষরে নীল কালিতে লেখা— “অ্যান ওল্ড লেটার রিটন বাই মুঘল প্রিন্স সুজা অন ওয়ান থাউজ্যান্ড অ্যান্ড ফরটি ওয়ান হিজরি হ্যাজ কাম টু মাই হ্যান্ড। সুজা রোট দিস লেটার টু দারাশিকোহ ফ্রম বুরহানপুর। ইট ইজ রিটন ইন পার্সিয়ান হুইচ সেজ্, ‘দ্য ট্রেজার অফ দ্য থ্রোন ইজ প্রোটেক্টেড ইন দি আহুখানা অফ দ্য শাহি কিলা নিয়ার দ্য রিভার তাপ্তি’।”
(চলবে)
...........................
[অলংকরণ : বিবস্বান]