উপন্যাস

সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (তৃতীয় পর্ব)

তপোব্রত ভাদুড়ি April 9, 2023 at 4:50 am উপন্যাস

......................

সাপ্তাহিক উপন্যাস 

দ্বিতীয় পর্বের পর 

.................. 

লালবাজারে অপুরা ঢুকল বিকাল পাঁচটায়। গত একটা দিন বাড়িতে বসে নানা দুর্ভাবনা আর অস্বস্তির মধ্যে কেটেছে। রিজওয়ানুর কাকু বড়বাজারে রুটিন ভিজিটে বেরিয়েছিলেন। ফিরলেন পৌনে ছটায়। অফিসে ঢুকে ওদের দেখে ছড়া কেটে বললেন, ‘নন্টে আর ফন্টে, ভালো খারাপ দুটো খবর, প্রথম শুনবে কোনটে?’ অপু বললো, ‘আগে ভালোটাই শুনি।’ রিজওয়ানুর চেয়ারে বসে বললেন, ‘গিরিশ পার্ক থেকে আমরা তিনজনকে অ্যারেস্ট করেছি। ওদের থেকে টিপ পেয়ে কাল আর-একটাকে তুলেছি দত্তপুকুর থেকে। সবগুলোই পুরোনো পাপী।’ 


এক ঢোক জল খেয়ে কাকু আবার বলতে লাগলেন, ‘দত্তপুকুরের লোকটাই তোর সঙ্গে মুম্বই মেলে ফিরেছে। ওর নাম মহাদেব মণ্ডল। দলের লোকেরা ওর চোখদুটো খুবলে তুলে নিয়েছে। মহাদেব রায়পুরে একটা মার্ডার করে এসেছে। প্রথমে ব্যাপারটা চেপে গেছিল। পরে জেরায় বেরিয়ে পড়েছে। আমরা ছত্তিশগড় পুলিশের সঙ্গে আজ দুপুরে ভেরিফাই করে নিয়েছি। খুনটা হয়েছে হোটেলে। ভিকটিমের বাড়ি কলকাতায়। ইলিয়ট রোডে। নাম ডেরেক রিচার্ডসন। লোকটার সুটকেসে একটা কোনো দামি কাগজ ছিল। সেটার জন্যই খুন। কীসের কাগজ তা অবশ্য এদের জানা নেই।’ 


‘আর খারাপ খবরটা কী?’, তপু ব্যগ্র ভাবে জিজ্ঞাসা করল। রিজওয়ানুর বললেন, ‘মহাদেবরা ভাড়াটে গুন্ডা। এরা মিডলম্যান মারফত রেট ঠিক করে কাজ করে। পার্টিকে এরা চোখে দেখেনি। অ্যাডভান্স পেমেন্ট হয়েছে এনএইচ সিক্সে শিবম হোটেলের কাছে একটা ভ্যাটে ব্যাগ ড্রপ করে।’

‘ফোনেও কথা হয়নি?’, অপু প্রশ্ন করল।

রিজওয়ানুর বললেন, ‘এদের গ্যাং-লিডার সুলতানের সঙ্গে পার্টির কথা হয়েছে মাত্র দুবার। সেটা সুপারি পাওয়ার আগে। পরে আর যোগাযোগ করা যায়নি। এখনও সিগন্যাল দিচ্ছে না। সুলতানের কললিস্ট থেকে আমরা নম্বরটা বার করতে পেরেছি। কিন্তু ও কোনো কাজের নয়।’ অপু বললো, ‘কেন? সিমটা কার?’ রিজওয়ানুর উত্তর দিলেন, ‘ডেরেক রিচার্ডসন’।   


***

—খাবার পড়ে আছে কেন?  

—আমাকে এভাবে আটকে রেখেছিস কেন? ছেড়ে দে আমায়।

—কদিন পরেই ছেড়ে দেব। কাজটা ভালোয় ভালোয় মিটে যাক।

—কোন্ কাজ? 

—অত তোমার জানার দরকার নেই। পেঁয়াজি না করে চুপচাপ খেয়ে নাও।

—না, খাব না। বাইরে যাব আমি।

—না খেলে নিজেই পস্তাবে। 

—আমায় এভাবে কষ্ট দিস না। 

—চুপ করো। এখানেই তোমাকে থাকতে হবে। 

—আমার দম আটকে আসছে এখানে। তোর কি একটুও দয়ামায়া নেই?

—না, নেই। শোনো, খাবে তো খাও। নইলে মরো। আমার অনেক কাজ আছে৷ তোমার নাকি-কান্না শোনার সময় নেই আমার। 

দরজাটা দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল। চাবি ঘোরানোর শব্দটা মিলিয়ে যেতেই দশ বাই বারো ফুটের এক চিলতে কামরার মধ্যে নেমে এল হাড়হিম নৈঃশব্দ্য। 


***

অক্ষয় বোস লেনের নিতাই সামন্তর কাছে হৃষীকেশ আজ বারো বছর ধরে যাতায়াত করছেন। নিতাই পুরোনো বইপত্র বেচাকেনা করে৷ বইয়ের ভালো সমঝদারও বটে। পুরোনো বই বেচে আয়পয় হলেও মাঝে মাঝে সে আক্ষেপ করে, ‘বুজলেন স্যার, এখনকার জেনারেসন বইয়ের কদর জানে না। বাপ চোখ বুজলেই ছেলেপুলে আলমারি ভর্তি গোল্ড মাইন বেচে দেয়। আমাকে আবার বলে কী — যা হোক একটা দাম ধরে দিন।’ 


নিতাইয়ের কাছ থেকে হৃষীকেশ বহু দুষ্প্রাপ্য বই জোগাড় করেছেন। তার মধ্যে অনেকগুলোই প্রথম মুদ্রণ। তবে কপাল ভালো থাকলে কখনও কখনও বইয়ের সন্ধানে এসে হঠাৎ দেখা মেলে চমকপ্রদ সব অ্যান্টিক সামগ্রীর। ড্যানিয়েল রিচার্ডসনের ডায়রিটাও সেভাবেই পাওয়া। নিতাই নিজেই তাঁকে ডায়রিটা দেখিয়ে বলেছিল, ‘আপনি তো কোম্পানির আমল নিয়ে কাজ করছেন। নিয়ে যান। গ্যারান্টি জিনিস।’


নিতাই আজ বাড়িতেই ছিল। হৃষীকেশকে দেখে খুশি হয়ে বলল, ‘আসুন স্যার। টাটকা কিছু মাল এসেছে। আপনার জন্যে রেখে দিয়েছি।’ হৃষীকেশ ঘরে ঢুকে তক্তাপোশের উপরে বসে বললেন, ‘তোমার কাছে অন্য একটা দরকারে এসেছি। বই পরে দেখব।’ নিতাই অবাক চোখে তাকিয়ে বললো, ‘কী ব্যাপার বলুন তো?’ হৃষীকেশ একটু থেমে বললেন, ‘তুমি আমাকে একটা ডায়রি দিয়েছিলে, মনে পড়ছে?’

‘আজ্ঞে, সেই গোরা সাহেবের ডায়রি?

'হ্যাঁ।'

'কেন বলুন তো?’, নিতাই বলে উঠল।

‘ডায়ারিটা তোমাকে কে বিক্রি করেছিল, নামঠিকানা কিছু মনে আছে?’, হৃষীকেশ জিজ্ঞাসা করলেন।

‘নাম একটা বলেছিল বটে৷ হ্যাঁ, মনে পড়েছে … রিচার্ডসন।’, নিতাই জবাব দিল।

‘পুরো নাম কী?’, হৃষীকেশ আবার প্রশ্ন করলেন।

‘পুরো নাম তো জানা নেই স্যার। ওইটুকুই বলেছিল। ঠিকানাও বলেনি। খুব তাড়ার মধ্যে ছিল লোকটা। এসেই বললো, “এই ডায়রিটা আমাদের ফ্যামিলির জিনিস। এইটটিন ফর্টি টুর৷ কত দিতে পারবেন বলুন।’

হৃষীকেশ চুপ করে শুনলেন। তারপর কোনো কথা না বলে চিন্তিত মুখে বেরিয়ে এলেন। 


***

স্নান করে বেরিয়েই অপু দেখলো, রিজওয়ান কাকুর মিসড কল। ঘুরিয়ে কল করতেই ফোনের ওপ্রান্ত থেকে ভেসে এলো কাকুর গলা, ‘শোন, তিনটে আপডেটস আছে। ইলিয়ট রোডে রিচার্ডসনের বাড়িতে হোমিসাইডের অফিসার গিয়েছিল। ফ্যামিলি বলতে শুধু ফাদার। সেভেনটি টু ইয়ার্স ওল্ড। ভদ্রলোক সব শুনে খুব ভেঙে পড়েছেন। ছেলের ডেডবডি আর দেখতে চাননি। কনসেন্ট নিয়ে আমরাই যা করার করে দিয়েছি। দুনম্বর কথা হল, ওখান থেকে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পাঠিয়েছে। গলায় ফাঁস দিয়ে খুন। তিন নম্বরটা সিক্রেট। কাউকে বলবি না। আর হ্যাঁ, তোর ওই ভাইটা — কী যেন নাম? দর্পণ না তর্পণ? ওকেও বলবি, ব্যাপারটা যেন পাঁচকান না করে। ডেরেক রিচার্ডসনের একটা নোটবুক পাওয়া গেছে। হোটেলের ঘর থেকে। সেটা দেখতে পারিস। জানি না কদ্দুর কী কাজে লাগবে। কাল ফার্স্ট আওয়ারেই চলে আয়। এখানেই ক্যান্টিনে লাঞ্চ করে নিবি।’

অপু বললো, ‘নোটবুকটা তুমি কি — ’ প্রশ্নটা শেষ করার আগেই কাকু বললো, ‘এখন রাখছি। মিটিং আছে একটা।’ অপু কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকার পরে তপুকে কল করল। 

—হ্যাঁ, বল।

—তুই কোথায় এখন?

—এই তো — একটু বেরিয়েছি রে। একটা বন্ধুর সঙ্গে।

—বন্ধু না বান্ধবী?

—বন্ধুই। মানে বান্ধবী।

—বুঝলাম।

—ধুর্, তুই যা ভাবছিস, ওরম কিছু নয়। 

—তুই আজকাল থট রিডিংও করছিস নাকি?

—ধুর্ ব্যাঙ, কী বলবি বল না।

—আচ্ছা শোন, রিজওয়ানুর কাকু কল করেছিলেন। কাল একবার লালবাজারে যেতে বলেছেন। একটা দরকারে। সকালের দিকে। তোর সময় হবে? নাকি আমি একাই চলে যাবো?

—একাই যাবি মানে? আমিও তো যাব।

—বেশ। আরও কয়েকটা খবর আছে। ফোনে এত বকতে পারছি না।

—তাহলে?

—তাহলে আবার কী? তোমার ঘোরাঘুরি শেষ হলে একবার পদধূলি দিয়ে ধন্য করো। চল। ফোনটা কাট। 


***

‘এ তো দেখছি পুরোটাই ফাঁকা’, ডেরেকের পকেট নোটবুকটার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে অপু বলে উঠল।

রিজওয়ানুর বললেন, ‘মনে হয় নতুন কেনা। সবে ব্যবহার করতে শুরু করেছিল।’

‘এগুলো কী?’— মাঝখানের একটা পাতায় চোখ আটকে গেছে ওর। তপুকেও দেখাল ও। খাতাটা হাতে নিয়ে তপু বিড়বিড় করে পড়তে লাগলো, ‘এ স্টার ইজ বর্ন … দ্য প্রোটেক্টর … ডান্ডি সত্যাগ্রহ … ডিভাইন চক্র … সান গড … অ্যাগনস্টিক … লেজেন্ড রিটার্নস … অ্যারাবিয়ান কুইন — এ যে দেখছি হেঁয়ালি।’

অপু ওর হাত থেকে নোটবুকটা ফেরত নিয়ে পাতাটার ছবি তুলে নিল। কয়েকপাতা পরে আর-একজায়গায় শুধু ‘অ্যারাবিয়ান কুইন’ কথাটা লিখে আবার কেটে দেওয়া হয়েছে। পাশে ছোট করে লেখা ‘দ্য প্রোটেক্টর’। ‘ডান্ডি সত্যাগ্রহ তো লবণ সত্যাগ্রহ। গান্ধির। আর সান গড মানে হচ্ছে সূর্যদেব। বাকিগুলো কেমন যেন ধোঁয়াটে’, তপু একটু ভেবে বলল।

রিজওয়ানুর কাকু বললেন, ‘লেজেন্ড রিটার্নস কথাটাও কিন্তু আবছা ধরতে পারা যাচ্ছে। ডান্ডি মার্চ বললে যদি মহাত্মা গান্ধি বোঝায়, তাহলে ওই লেজেন্ড কথাটার একটাই অর্থ হয়। ওয়ান অ্যান্ড অনলি বোস। আর দ্যাখ, বলছে লেজেন্ড রিটার্নস। মানে হচ্ছে গুমনামি। সৃজিতের।’

অপু জিজ্ঞাসা করলো, ‘দেখেছো মুভিটা?’ ‘আমি দেখেছি’, তপু তড়বড়িয়ে বলে উঠলো৷ ‘আমিও দেখেছি।’,

রিজওয়ানুর বললেন৷ ‘উফ্ বীভৎস! কেন যে এত ট্র্যাশ তৈরি হয় আমাদের এখানেই!’, বলেই অপু ফিক করে হেসে ফেলল।


নোটবুকের মধ্যে আর কোথাও কিছু নেই। একেবারে প্রথম পৃষ্ঠায় শুধু নামটুকু লেখা। ডি. রিচার্ডসন। অপু সেটারও একটা ছবি তুলে নিয়ে কাকুর হাতে খাতাটা ফিরিয়ে দিয়ে বললো, ‘এটা আর লাগবে না। স্ক্যানড কপি প্রিন্ট করিয়ে নেব।’

রিজওয়ানুর বললেন, ‘চল, তাহলে লাঞ্চ করে নিই।’

তপু উঠে পড়লো৷

অপু বললো, ‘আমার আর-একটা জিনিস চাই। রিচার্ডসনদের অ্যাড্রেস আর সম্ভব হলে ফোন নম্বর।’

রিজওয়ানুর বললেন, ‘লিখে নে। ষোল বাই দুই ইলিয়ট রোড। কল্পতরু অ্যাপার্টমেন্ট৷ ফ্ল্যাট নম্বর থ্রি এ। বাবার নাম ডেনিস রিচার্ডসন৷ অ্যাংলো ইন্ডিয়ান৷ ফোন নম্বরটা তোকে পরে পাঠিয়ে দিচ্ছি। হোমিসাইড সেকশন থেকে জোগাড় করে।’

অপু ওর ডায়ারিতে লিখে নিয়ে বললো, ‘ফাইন।’

বাইরে কড়া রোদ। কলকাতা যেন মূর্ছা গেছে। তপু রাস্তায় বেরিয়ে বললো, ‘খাবারগুলো দারুণ ছিলো, বল!’ 


(চলবে)


আগের পর্বগুলি পড়ুন :

১) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (প্রথম পর্ব)  

২) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (দ্বিতীয় পর্ব) 

........................ 

[অলংকরণ : বিবস্বান] 



#উপন্যাস #সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন #তপোব্রত ভাদুড়ি #silly পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

5

Unique Visitors

219107