উপন্যাস

সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (সপ্তম পর্ব)

তপোব্রত ভাদুড়ি May 6, 2023 at 7:27 pm উপন্যাস

[ আগে যা ঘটেছে : মুম্বই মেলে হাওড়ায় আসার পথে অপরাজিতার এক সহযাত্রীর সুটকেস চুরি হয়৷ লোকটিকে রেলপুলিশের কাছে ডায়রি করতে পরামর্শ দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে হুমকি চিরকুট পায় অপু৷ পরে হৃষীকেশ কাকুর কাছে গিয়ে অপু আর ওর মাসতুতো ভাই তপু জানতে পারে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মিলিটারি অফিসার ড্যানিয়েল রিচার্ডসনের ডায়রিতে লিপিবদ্ধ শাহ সুজার চিঠির কথা, যার মধ্যে ছিল সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধনের সংবাদ৷ এরই মধ্যে রায়পুরের সিমরন হেরিটেজ হোটেলে পাওয়া যায় ড্যানিয়েলের বংশধর ডেরেক রিচার্ডসনের লাশ৷ ডেরেকের বাবা ডেনিস রিচার্ডসনের সঙ্গে হৃষীকেশ গুপ্তর সাক্ষাৎ হলে ডেনিস তাঁকে সুজার চিঠিটি দেখান৷ ইলিয়ট রোডের বাসিন্দা মুজিবর হৃষীকেশের বন্ধু অমলকান্তিকে জানায়, নিহত ডেরেকের আরেক ভাই বহুবছর বেপাত্তা৷ রিচার্ডসনদের সম্পর্কে খবর নিতে তাঁদের পুরোনো পাড়া বো-ব্যারাকে উপস্থিত হন স্কুলফেরত হৃষীকেশ৷]

....................

সাপ্তাহিক উপন্যাস 

ষষ্ঠ পর্বের পর 

..................... 

শিবকৃষ্ণ দাঁ লেন ধরে খানিক দূর এগোলেই মোড়ের মাথায় বেদান্ত ডেভেলপার্সের ঝকঝকে অফিস। বাইরে ছোট কেবিন। ঠাকুরের ফোটোর সামনে ভুরভুরে চন্দনধূপ জ্বলছে। দুটো কাস্টমার ফ্ল্যাটের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছে। তাদের সুপার-বিল্ট এরিয়ার হিসাব বোঝাচ্ছিল পুরোনো কর্মচারী নরিন্দর।


ভিতরের ঘরটা দিওয়ান-ই-খাস। বেশ বড়। কার্পেট এরিয়া একশ আশি স্কোয়্যার ফিট। কথা বলতে বলতে উঠে এসে নরিন্দর দরজায় টোকা দিল।

‘হাঁ, আ যা’, ভিতর থেকে সাড়া দিলেন মিস্টার দারুওয়ালা।

নরিন্দর দরজা ঠেলে মুখ বাড়িয়ে বলল, ‘রঘু।’

—উসে অন্দর ভেজ।


ভিতরে ঘাপটি মেরে তিনটে আড়কাঠি বসে ছিল। রঘুবীরকে ঢুকতে দেখে দারুওয়ালা তাদের বললেন, ‘তুমলোগ অব যাও। বাদ মে বাত করেঙ্গে। আর ওই যে বিধওয়াটা … ওই প্রোপার্টিটা তুরন্ত সেটিং করো। ওইখানে আমি সুইমিং পুল বানাব। ভুলিয়ে ভালিয়ে দেখো। নইলে উঙ্গলি টেরা করতে আমি জানি।’ 

ওরা চলে যেতেই দারুওয়ালা বললেন, ‘আও রঘু, ব্যয়ঠো।’

—রাম রাম সাহিব। 

—রাম রাম। ... খবর পাক্কি?

—হান্ড্রেড পরসন্ট। ম্যাঁয় উধার হি খড়া থা। আপনে কানোঁ সে সুনা হ্যায়। 

দারুওয়ালা রাইটিং প্যাডটা টেনে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘জগাহ কা নাম?’

—বুরহানপুর। আহুখানা।

—ঠিক সে সুনা তুমনে?

—জি বিলকুল। মাস্টারজি খুদ বাতায়া। 

—নকশা কিসকে পাস হ্যায়? 

—নকশা কে বারে মেঁ কুছ নেহি সুনা হ্যায়। 

—পতা করো। য্যয়সে হাম সাইট কা প্ল্যান বানাতে হ্যায় না... য়হাঁ কিচেন ওহাঁ ডাইনিং, ওয়সে ওয়হ লোগ ভি খজানা ছুপানে কে লিয়ে ড্রয়িং ডিজাইন কুছ বানায়া হোগা। আচ্ছা, ইয়ে বাতাও, ওয়হ মাস্টারজি কহাঁ রহতে হ্যায়। 

—অ্যাড্রিস তো আভি নেহি হ্যায় মেরে পাস। বাদ মেঁ দে সকতা হুঁ৷ 

—ঠিক হ্যায়। ইয়ে পাঁচশ লে যাও। মুহ মিঠা করো। 

—জি, ইতনি মেহন্নত কি। থোড়া অউর কুছ বঢ়হা দিজিয়ে সাহিব। 

—আ রে, রাখ লো ভাই। পহলে কাম হো জায়ে। মুঁহভরি রকম দুঙ্গা। 

—শুকরিয়া সাহিব।


***

‘শান্তিলতারা আমাদের পাশের বাড়িতেই থাকত। ডেরেক আর ডেভিড তো ছোটবেলায় আমাদের এখানেই পড়ে থাকত সারাদিন। ডেনিসও আসতেন৷ আমার হাজব্যান্ডের সঙ্গে ব্রিজ খেলতে। সেবাস্টিয়ান বেঙ্গল কেমিক্যালে কাজ করতেন।’, অ্যাঞ্জেলা বললেন। 

হৃষীকেশ প্রশ্ন করলেন, ‘ওঁরা ইলিয়ট রোডে কত বছর হল গিয়েছেন?’

অ্যাঞ্জেলা বললেন, ‘তা হয়ে গেল প্রায় বছর পনেরো। শান্তিলতা চলে যাওয়ার পরেই। ডেনিস আমাদের বলতেন, বাড়িতে আর মন লাগছে না। খুব ভাব ছিল তো দুজনের। বো-ব্যারাক ছেড়ে চলে যাওয়ার সময়ে ওঁকে বলেছিলেন, এখানে থাকলে পাগল হয়ে যাব।’

হঠাৎ লোডশেডিং হয়ে গেল। অ্যাঞ্জেলা বললেন, ‘এই এক শুরু হয়েছে জ্বালা। দাঁড়ান। আলো নিয়ে আসি।’

ভিতরের ঘর থেকে একখানা সেজবাতি নিয়ে এসে টেবিলের উপরে রেখে অ্যাঞ্জেলা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কি আমাদের অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কমিউনিটি নিয়ে কোনো রিসার্চ করছেন?’

হৃষীকেশ উত্তর দিলেন, ‘না, আমি কাজ করছি কোম্পানির আমল নিয়ে। মানে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। রিচার্ডসনদের এক পূর্বপুরুষ কোম্পানির মিলিটারি অফিসার ছিলেন। ওঁর ব্যাপারে অনুসন্ধান করতে গিয়েই ডেনিস রিচার্ডসনের সঙ্গে আমার পরিচয়।’ 

হৃষীকেশ ডেরেকের খুন হওয়ার খবরটা ইচ্ছা করেই চেপে গেলেন। অ্যাঞ্জেলা সম্ভবত এখনও জানেন না। বাড়ি বয়ে এসে ভগ্নদূতের কাজ করতে হৃষীকেশের বাধল। 

অ্যাঞ্জেলা বললেন, ‘পুরোনো অনেক ছবি ছিল আমাদের। ওঁদের সঙ্গে। এখন অন্ধকারের মধ্যে খুঁজে বার করা মুশকিল। না হলে দেখাতাম।’

হৃষীকেশ প্রশ্ন করলেন, ‘মিস্টার রিচার্ডসনের ছেলেরা কি সেন্ট জর্জেসেই পড়ত?’

অ্যাঞ্জেলা বললেন, ‘ওরা প্রথমটায় বছরচারেক বোধহয় পড়েছিল ডন বস্কোতে। শান্তিলতার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পরে ডেনিস ওদের সেন্ট জর্জেসে এনে ভর্তি করেন।’

হৃষীকেশ অবাক হয়ে বললেন, ‘ডেরেক আর ডেভিড শান্তিলতার ছেলে নয়?’

অ্যাঞ্জেলা জবাব দিলেন, ‘ডেনিস আপনাকে বলেন নি? ছেলেরা তো প্রথম পক্ষের। ডেনিসের প্রথম স্ত্রী এমিলি যখন মারা যান, ছেলেদুটো তখন একেবারেই ছোট৷ শান্তিলতার নিজের কোনো ছেলেমেয়ে হয়নি। ওসব কথা তুললেই আমাকে বলত, ছেলেদুটোর মা নেই। আবার একটা বাচ্চা হলে ওদের অভিমান হবে। যারা ভিতরের কথা জানত না, সবাই মনে করত ওরা ওর পেটের ছেলে। এত টান।’

হৃষীকেশ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা, আজ উঠি তাহলে। আপনার সঙ্গে আলাপ করে খুব ভালো লাগল৷’

অ্যাঞ্জেলা বললেন, ‘আসবেন আবার৷ লোডশেডিং হয়ে গেল বলে আপনাকে একটু চা-ও করে খাওয়াতে পারলাম না৷ কী যে খারাপ লাগছে৷’


জুতোতে পা গলিয়ে হৃষীকেশ বাইরে এসে দাঁড়াতেই অন্ধকার পাড়াটা হঠাৎ ঝলমল করে উঠল৷ সেই সঙ্গে পিছন থেকে ভেসে এল অ্যাঞ্জেলার গলা, ‘থ্যাঙ্ক ইউ গড ফর অল ইয়োর ব্লেসিংস৷’  


***

তপু শান্তিনিকেতন থেকে ফিরেছে গতকাল সন্ধ্যায়৷ বিকালবেলা অপুর সঙ্গে দেখা করে দুজনে মিলে এল সুকিয়া স্ট্রিটে৷ হৃষীকেশ কাকু সবে ফিরেছেন৷ ফাল্গুনি কাকা রান্নাঘরে বেগুনি ভাজতে ভাজতে গান গাইছেন, ‘রাজা হবার সাধ নাই মাগো দু বেলা যেন পাই মা খেতে’৷ 


অপুরা গিয়ে বসল পড়ার ঘরে৷ একটু পরেই হৃষীকেশ এসে প্রশ্ন করলেন, ‘কী খবর তোমাদের? পড়াশোনা কেমন চলছে?’ 

অপু উত্তর দিল, ‘কাজ অনেকটা হয়ে এসেছে৷ থিসিস লেখাও চলছে৷ ফেব্রুয়ারিতে ভাবছি সাবমিট করব৷’ 

তপু বলল, ‘আমরা এখন বর্ষামঙ্গলের রিহার্সাল করছি৷’ 

কাকু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার গবেষণার বিষয় কী, তর্পণ?’ 

তপু বলল, ‘আমার টাইটেল হচ্ছে, হিন্দি চিত্রগীতিতে রবীন্দ্রকাব্যের প্রেরণা ও পরিণাম৷’ 

অপু বলল, ‘যথা?’

তপু বলল, ‘যথা? একটা ক্লাসিক উদাহরণ হল চোর মচায়ে শোর ছবিতে ঘুঙরু কি তরাহ বজতা হি রহা হুঁ ম্যায়৷ মন দেয়া-নেয়া অনেক করেছি, মরেছি হাজার মরণে — নূপুরের মতো বেজেছি চরণে চরণে। নৌশাদ উবাচ৷ কিংবা আর একটু হালকা করে, তুঝ মেঁ রাব দিখতা হ্যায় ইয়ারা ম্যাঁয় ক্যা করুঁ৷ তোমাতে হেরিব আমার দেবতা, হেরিব আমার হরি৷’

অপু মৃদু হেসে গুনগুন করে উঠল, ‘তু হি দিল কি হ্যায় রৌনক, তু হি জন্মোঁ কি দৌলত … বড্ড ভালো গানটা৷’


ফাল্গুনি কাকা গরম বেগুনি আর মুড়িমাখা দিয়ে গেলেন৷ তপু বলল, ‘এত বড় বেগুন কোথায় পেলে গো?’


ওরা যে বইদুটো সেদিন নিয়ে গিয়েছিল, পড়া শেষ হয়ে গেছে৷ আজ ফেরত দিতে গিয়ে অপু বলল, ‘আচ্ছা, মুমতাজ মারা যাওয়ার পরে শাহজাহান আবার বিয়ে করেছিলেন, এরকম কোথাও একটা যেন দেখেছিলাম৷ এখানে তো সেসব কিছু পেলাম না৷’ 

তপু বলল, ‘শাহজাহান মুমতাজের বোনকে বিয়ে করেছিলেন৷ আমি জানি৷’

হৃষীকেশ হেসে উঠে বললেন, ‘এগুলো গাঁজাখুরি রটনা৷ ফেক নিউজ৷ ইনায়ত খানের শাহজাহান-নামা পড়ো কিংবা মুহম্মদ ওয়ারিসের বাদশনামা অথবা আমল-ই-সালিহ — কোথ্থাও এসব পাবে না৷’

অপু বলল, ‘কী যা-তা কাণ্ড!’

হৃষীকেশ বললেন, ‘মুমতাজের অকালমৃত্যুর পরে শাহজাহানের চুলদাড়ি সাদা হয়ে গিয়েছিল৷ কেঁদেকেটে চোখ খারাপ করেছিলেন৷ শাহজাহানই প্রথম ভারতীয়, যিনি চশমা পড়েন৷ সম্ভবত ষোলশ বত্রিশে৷ খেয়ে নাও৷ সব ঠান্ডা হয়ে গেল৷’ 

তপু তিন নম্বর বেগুনিটা শেষ করে বলল, ‘বর্ষার দিন তো৷’

খাওয়া শেষ করে হাতমুখ ধুয়ে ওরা ফিরে এল কাকুর কাছে৷ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে হৃষীকেশ প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা, লালবাজার থেকে ডেরেকের লাস্ট কল লোকেশনটা জানতে পেরেছিলে?’

অপু বলল, ‘হ্যাঁ, রায়পুর৷ কলটা হয়েছে উনত্রিশ তারিখ৷ সন্ধ্যা সাতটা বেয়াল্লিশে৷ পোস্টমর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী, মার্ডার হওয়ার আধঘণ্টা আগে৷’ 

হৃষীকেশ বললেন, ‘টাকা দিল ডেরেক৷ খুনিকে ডাকল ডেরেক৷ খুনও হল ডেরেক৷ ইমপসিবল৷’   

তপু বলল, ‘আমার সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে৷’

অপু একটু ভেবে বলল, ‘আমার মনে হয়, আমাদের একবার রায়পুরে যাওয়া দরকার৷’

‘সিমরন হেরিটেজ’, হৃষীকেশ বিড়বিড় করে উঠলেন৷


(চলবে)


আগের পর্বগুলি পড়ুন : 

১) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (প্রথম পর্ব)

২) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (দ্বিতীয় পর্ব)

৩) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (তৃতীয় পর্ব)

৪) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (চতুর্থ পর্ব)

৫) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (পঞ্চম পর্ব)

৬) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (ষষ্ঠ পর্ব) 

.....................

[অলংকরণ : বিবস্বান]  



#ধারাবাহিক উপন্যাস #রহস্য উপন্যাস #তপোব্রত ভাদুড়ি #Bengali Thriller #সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন #silly পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

51

Unique Visitors

215833