সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (দশম পর্ব)
[ আগে যা ঘটেছে : মুম্বই মেলে হাওড়ায় আসার পথে অপরাজিতার এক সহযাত্রীর সুটকেস চুরি হয়৷ লোকটিকে রেলপুলিশের কাছে ডায়রি করতে পরামর্শ দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে হুমকি চিরকুট পায় অপু৷ পরে হৃষীকেশ কাকুর কাছে গিয়ে অপু আর ওর মাসতুতো ভাই তপু জানতে পারে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মিলিটারি অফিসার ড্যানিয়েল রিচার্ডসনের ডায়রিতে লিপিবদ্ধ শাহ সুজার চিঠির কথা, যার মধ্যে ছিল সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধনের সংবাদ৷ এরই মধ্যে রায়পুরের সিমরন হেরিটেজ হোটেলে পাওয়া যায় ড্যানিয়েলের বংশধর ডেরেক রিচার্ডসনের লাশ৷ ড্যানিয়েলের বিষয়ে অনুসন্ধানের সূত্রে ডেরেকের বাবা ডেনিসের সঙ্গে হৃষীকেশ গুপ্তর সাক্ষাৎ হলে তিনি তাঁকে সুজার চিঠিটি দেখান৷ এদিকে রঘুবীরের কাছ থেকে বুরহানপুরের গুপ্তধনের খবর পেয়ে মিস্টার দারুওয়ালার মতো কুটিল মানুষও ব্যগ্র হয়ে উঠেছেন শাহি খাজানা লুঠ করার লোভে৷ ডেরেকের হত্যা সম্পর্কে কয়েকটা খটকা দূর করতে অপুরা এসেছে রায়পুরে৷ ]
....................
সাপ্তাহিক উপন্যাস
নবম পর্বের পর
.....................
পুলিশের সঙ্গে অপুদের ঢুকতে দেখে লম্বা একটা স্যালুট ঠুকল হোটেল সিমরনের দারোয়ান৷ ম্যানেজার রিসেপশন লাউঞ্জের একপাশে বসে ‘দৈনিক ভাস্কর’ পড়ছিলেন৷ অখিলেশকে দেখে ব্যস্ত হয়ে উঠে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ক্যা বাত হ্যায় স্যার? হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?’
অখিলেশ অপুদের দেখিয়ে বললেন, ‘কলকাত্তা সে আয়ে হ্যায়৷ উও যো মার্ডার হুয়া থা আপকে য়ঁহা, উসকে ফেরেন্ড৷ কুছ পুছতাছ অওর ছানবিন করেঙ্গে৷ কোঅপরেট করনা৷’
‘একবার বড়ে মালিক সে বাত কর লিজিয়ে স্যার৷’
‘জাদা টেইম নেহি হ্যায় মেরে পাস৷ ওকে … লগাইয়ে ফোন৷’
অপু আর তপু সোফায় এসে বসল৷ হৃষীকেশ কাকু মন দিয়ে উলটোদিকের দেয়ালের একটা রিলিফের কাজ দেখছিলেন৷ ফোনের ওপার থেকে ‘বড়ে মালিক’ কী বলছেন বোঝা না গেলেও অখিলেশকে বেশ কড়া গলায় বলতে শোনা গেল, ‘দেখিয়ে জনাব, ডিএসপি সাব কা অর্ডর হ্যায়৷ রুটিন ইনকোয়্যারি তো হো হি গ্যয়া হ্যায়৷ অব রহা ইনকি আতমা কি শান্তি৷ ঠিক হ্যায়? … হাঁ হাঁ, কোই সমস্যা নেহি হোগি৷ গরান্টি৷ লিজিয়ে৷ স্টাফ কো বতা দিজিয়ে তো জরা৷’
একটু পরেই ম্যানেজার এসে অপুদের ডাকলেন, ‘আপলোগ মেরে সাথ আইয়ে৷’
অখিলেশ বললেন, ‘ম্যাঁয় অব নিকাল রহা হুঁ৷ আপলোগ বেফিকর হো কে কাম কিজিয়ে৷ অগর জরুরত পড়ে তো মুঝে বস কল করনা৷ নম্বার রাখ লিজিয়ে৷ সেভেন সেভেন সেভেন থ্রি জিরো …’
অখিলেশ বেরিয়ে যেতে অপুরা রিসেপশন কাউন্টারে এসে দাঁড়াল৷ রিসেপশনিস্টকে অপু বলল, ‘রেজিস্টার দিখাইয়ে৷ চেক ইন কা ইনফর্মেশন দেখনা হ্যায়৷’
লোকটি বেশ বুদ্ধিদীপ্ত আর চটপটে৷ তাড়াতাড়ি রেজিস্টার খুলে আঠাশে মে তারিখের পাতাটা বার করে বলল, ‘সাড়ে বারা বাজে চেক ইন হুয়া থা৷ রুম নম্বর তিনশ সাত মে৷ অনলাইন বুকিং থা৷’
হৃষীকেশ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘উসকে সাথ কোই সুটকেস থা?’
রিসেপশনিস্ট একটু চিন্তা করে জবাব দিল, ‘ঠিক সে ইয়াদ নেহি আ রহা হ্যায়৷ বয় সে পুছকে বাতাতা হুঁ৷’ তারপরে একটি কর্মচারীকে বলল, ‘জরা বরমদেও কো বুলাও তো৷’
অপু রেজিস্টারের পাতাটা তপুকে দেখিয়ে বলল, ‘কীরকম বুঝছিস?’
তপু বলল, ‘এই তো৷ পরিষ্কার করে লিখেছে৷ নাম ঠিকানা৷’
‘সইটা দ্যাখ৷’
‘জাল সই?’
‘গোরু৷ ছোটহাতের লেটারগুলো দ্যাখ৷’
হৃষীকেশ কাকু কৌতূহলী হয়ে বললেন, ‘কই! দেখি৷’
তপু বলল, ‘আমিও এইভাবেই লিখি৷ নর্মাল৷ এর মধ্যে দেখার কী আছে?’
হৃষীকেশ বললেন, ‘এটাকে বলে প্রিন্ট হ্যান্ডরাইটিং৷ হোটেলের রুম থেকে ওর ঘোড়দৌড়ের যে নোটবুকটা পাওয়া গেছে, তাতে সব কার্সিভে লেখা৷ কন্টিনিউয়াস কার্সিভ৷ অ্যান্ড স্ল্যান্টেড টু রাইট৷’
অপু বলল, ‘নোটবুকের ডি রিচার্ডসন ইনি নন৷ ডেভিড৷ তোমার কাছ থেকে খোঁজখবর পেয়ে আমরা একদিন ওয়েলিংটনে গিয়েছিলাম৷ দত্ত ইলেকট্রিকাল এম্পোরিয়ামের মালিক রিচার্ডসনদের ভালো করেই চেনেন৷ ডেভিডের রেসের মাঠে যাতায়াতের কথা উনি জানতেন৷’
তপু হতভম্ব হয়ে বলল, ‘জোড়া খুন!’
রিসেপশনিস্ট ভয় পেয়ে প্রশ্ন করল, ‘ক্যা হুয়া ম্যাডাম?’
***
হৃষীকেশ বাড়িতে না থাকলে ফাল্গুনির ভালোমন্দ রাঁধতে ইচ্ছা করে না৷ একার জন্য ডাল-ভাত-আলু-কুমড়ো প্রেশার কুকারে ফেলে দুটো থেকে তিনটে সিটিই যথেষ্ট৷ দরকার হলে তার সঙ্গে চলতে পারে পোলট্রির ডিম৷ কিংবা আর কিছু না হোক কড়া দেখে দুটো কাঁচালঙ্কা৷
ডিমটা আজ দুপুরে খাবে না রাত্রে, এই নিয়ে চিন্তা করতে করতে ফাল্গুনি শোবার ঘরের ঝুল ঝাড়ছিল৷ হঠাৎ দরজায় কোকিল ডেকে উঠল৷ পড়িমরি করে গিয়ে দরজা খুলে ফাল্গুনি দেখল, রাস্তার ধারে একখানা কমলা রঙের গাড়ি৷ আর ছাইরঙের সুটপ্যান্টুল পরা একটা লোক দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে৷ লোকটার গলায় মোটা একখানা সোনার চেন৷ চোখে সোনালি ফ্রেমের কালো চশমা৷ গুছিয়ে ব্যাকব্রাশ করা চুল৷ তাতে একসপ্তাহের তেল জ্যাবড়া করে মাখা৷
অত বর্ণনায় যাওয়ার দরকার কী? মোদ্দা কথা হচ্ছে, সংসারে একেকটা লোক আছে, যাদের দেখলেই মনটা অস্বস্তিতে শিরশির করে ওঠে, যাদের চেহারার আড়াল থেকে উঁকি দেয় হায়েনার হ্যাংলামো আর শেয়ালের শয়তানি৷ লোকটা ঠিক সেইরকম৷
ফাল্গুনি খুব রুক্ষগলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘কাকে চাই?’
‘গুপ্তাজি হ্যায়?’
‘গুপ্তাজিটা কে আবার?’
‘আরে ওহি হৃষীকেশ গুপ্তা৷’
‘উনি এখন বাড়িতে নেই৷ পর্যটনে গেছেন৷’
হৃষীকেশের সঙ্গে থেকে ফাল্গুনি অনেক ভারী ভারী বাংলা শব্দ শিখে নিয়েছে৷ মোক্ষম সুযোগ পেলে ব্যবহার করতে ছাড়ে না৷ আর সত্যি কথা বলতে এইরকম ‘গুপ্তাজি হ্যায়’ টাইপের লোকের সঙ্গে ‘পর্যটন’ ‘নিরীক্ষণ’ ‘অকালকুষ্মাণ্ড’ ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’ জাতীয় খাঁটি বাংলা শব্দ বলে অন্তরে যে গভীর প্রশান্তি পাওয়া যায়, তার কোনো তুলনা নেই৷
‘পর্যটনে গেছেন মতলব?’
‘মতলব ঘুমাইতেছেন৷’
‘আচ্ছা, হি ইজ স্লিপিং৷ ক্যা ম্যাঁয় অন্দর আ সকতা হুঁ?’
‘আরে মহা মুশকিল হল দেখছি৷ বলছি তো উনি বাড়িতে নেই৷ বাহার হ্যায়৷’
‘আচ্ছা আচ্ছা, ম্যাঁয় সমঝ গ্যয়া৷ ঘুমনে গ্যয়ে হ্যায়৷ ঠিক হ্যায়৷ কোই বাত নেহি৷’
লোকটা পিছন ফিরে গাড়ির দিকে পা বাড়াতেই ফাল্গুনি জিজ্ঞাসা করল, ‘মশাই, আপনার নামটা তো জানা হল না৷’
লোকটা ঘাড় ঘুরিয়ে বিচ্ছিরিভাবে হেসে বলল, ‘দারুওয়ালা৷’
আর ঠিক তখখুনি ফাল্গুনি খেয়াল করল, লোকটার উপরের পাটির মাড়ির দাঁতটা সোনা দিয়ে বাঁধানো৷
***
বরমদেও এসে এককোণে জড়োসড়ো ভাবে দাঁড়িয়ে ছিল৷ রিসেপশনিস্ট বলল, ‘সাহাবলোগ পুছ রহে হ্যায়, তিনশ সাত মে উও জো মওত হুয়া থা, উস আদমি সাথ মে কোই সুটকেস উটকেস লায়া থা ক্যা?’
‘জি, সাথ মে তো সির্ফ ব্যাকপ্যাক থা৷ লেকিন —’
‘লেকিন ক্যা?’
‘দুসরে দিন এক সুটকেস লে কর আয়ে থে৷ বুলু কলার কা৷ ম্যাঁয়নে সিড়ি সে উপর যাতে হুয়ে দেখা৷’
হৃষীকেশ প্রশ্ন করলেন, ‘দুসরে দিন মতলব উনতিস কো? কিতনে বাজে দেখা আপনে?’
‘জি, করিবন সওয়া পাঁচ-সাড়ে পাঁচ বাজে৷’
অপু বলল, ‘ওকে থ্যাঙ্কস৷ জরুরত হোনে পর আপ সে দোবারা বাতচিত করেঙ্গে৷ অব আপ যা সকতে হ্যায়৷’
তপু জিজ্ঞাসা করল, ‘নীল সুটকেসটা তো মহাদেব বলে সেই খুনিটা মুম্বই মেলে নিয়ে ফিরছিল৷ ব্যাকপ্যাকটা তাহলে গেল কোথায়?’
অপু ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, ‘ব্রিলিয়ান্ট! তোর ফ্রন্টাল লোব তো চমকাচ্ছে৷’
হৃষীকেশ বললেন, ‘সিসিটিভি ফুটেজটা এবার দেখলে হয়৷’
‘হ্যাঁ কাকু৷ সব দেখব৷ তার আগে চলো খেয়ে নিই৷ পেটে আগুন জ্বলছে৷’
তপু বলল, ‘হবে না? সকাল থেকে শুধু চা-বিস্কুট খেয়ে আছি৷’
হোটেল ম্যানেজার বিনীতভাবে বললেন, ‘অব তো বারাহ বাজনেবালে হ্যায়৷ আপলোগ ইধারই লাঞ্চ কর লিজিয়ে৷ বঢ়িয়া খানা মিলেগা৷’
হৃষীকেশ বললেন, ‘সেই ভালো৷ বাইরে যাওয়ার আর দরকার নেই৷ একেবারে কাজ সেরে বেরোব৷’
‘হাঁ হাঁ, আপলোগ আ যাইয়ে৷ হম মেমরি কার্ড নিকাল কে রাখতে হ্যায়৷’
***
রেস্তোরাঁতে ঢুকে অপু বলল, ‘আমি কিন্তু ভাত খাব৷ দুপুরবেলায় চাইনিজ অসহ্য লাগে৷’
তপু মেনুকার্ড দেখতে দেখতে বলল, ‘এখানে অনেক রকমের ভাত আছে৷ বাসমতী কা খাজানা৷’
‘দেখি’, বলে তপুর হাত থেকে মেনুকার্ডটা ছোঁ মেরে ছিনিয়ে নিয়ে অপু বলল, ‘এই তো৷ স্টিমড ঘি রাইস৷ আমি এইটা নিচ্ছি৷’
হৃষীকেশ বললেন, ‘ঘি ভাতই ভালো৷ দুটো নিলেই আমাদের তিনজনের হেসেখেলে হয়ে যাবে৷’
তপু বলল, ‘দ্যাখো কাকু, রাইসটা কমপেনসেট করার জন্য কিন্তু মুর্গ লবাবদার নেওয়া উচিত৷’
‘আচ্ছা বেশ, মুর্গ লবাবদার৷ একটা না দুটো? এক প্লেটে ক-পিস থাকে কে জানে!’
‘ক-পিস কিছু লেখেনি৷ শুধু লিখেছে— টেন্ডার পিসেস৷ আহা!’
অপু বলল, ‘আর একটা কড়াই চিকেন নিয়ে নাও৷ আর স্যালাড৷’
ধোঁয়া ওঠা ঘি-ভাতে গরম মুরগির ঝোল মাখতে মাখতে তপু বলল, ‘জীবন কী অদ্ভুত! আমরা এখন হাসতে হাসতে মাংস-ভাত খাচ্ছি৷ আর ক-দিন আগে এইখানেই একটা মার্ডার হয়ে গেছে৷ জাস্ট ভাবাই যায় না৷’
অপু বলল, ‘মার্ডার বললে কম বলা হয়৷ রুথলেস মার্ডার৷ ব্রুটাল৷ খুনের চেয়েও খুনের ফন্দিটা৷’
(চলবে)
আগের পর্বগুলি পড়ুন :
১) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (প্রথম পর্ব)
২) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (দ্বিতীয় পর্ব)