উপন্যাস

সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (একাদশ পর্ব)

তপোব্রত ভাদুড়ি June 3, 2023 at 6:35 pm উপন্যাস

[ আগে যা ঘটেছে : মুম্বই মেলে হাওড়ায় আসার পথে অপরাজিতার এক সহযাত্রীর সুটকেস চুরি হয়। লোকটিকে রেলপুলিশের কাছে ডায়রি করতে পরামর্শ দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে হুমকি চিরকুট পায় অপু। পরে হৃষীকেশ কাকুর কাছে গিয়ে অপু আর ওর মাসতুতো ভাই তপু জানতে পারে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মিলিটারি অফিসার ড্যানিয়েল রিচার্ডসনের ডায়রিতে লিপিবদ্ধ শাহ সুজার চিঠির কথা, যার মধ্যে ছিল সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধনের সংবাদ। এরই মধ্যে রায়পুরের সিমরন হেরিটেজ হোটেলে পাওয়া যায় ড্যানিয়েলের বংশধর ডেরেক রিচার্ডসনের লাশ। ড্যানিয়েলের বিষয়ে অনুসন্ধানের সূত্রে ডেরেকের বাবা ডেনিসের সঙ্গে হৃষীকেশ গুপ্তর সাক্ষাৎ হলে তিনি তাঁকে সুজার চিঠিটি দেখান। এদিকে রঘুবীরের কাছ থেকে বুরহানপুরের গুপ্তধনের খবর পেয়ে মিস্টার দারুওয়ালার মতো কুটিল মানুষও ব্যগ্র হয়ে উঠেছেন শাহি খাজানা লুঠ করার লোভে। ডেরেকের হত্যা সম্পর্কে কয়েকটা খটকা দূর করতে অপুরা এসেছে রায়পুরে। ]

....................

সাপ্তাহিক উপন্যাস 

দশম পর্বের পর 

..................... 

হোটেল ম্যানেজার মনিটরে চোখ রেখে বসে ছিলেন৷ অপুদের দেখে বললেন, ‘আইয়ে। রেকর্ডিং রেডি হ্যায়।’

অপু একটা চেয়ার টেনে নিয়ে স্ক্রিনের সামনে এসে বসল। হৃষীকেশ আর তপুকে রিসেপশনিস্ট দুটো প্লাস্টিকের টুল এগিয়ে দিল।

‘ইয়ে রিসেপসন কে ক্যামরে কা ফুটেজ হ্যায়। ইউজুয়ালি হম বারাহ সে পনদরা দিন কে অন্দর ওল্ড ফুটেজ ডিলিট কর দেতে হ্যায়। টু টিবি কা কার্ড হ্যায়। ঢাই দিন মে স্টোরেজ ফুল হো যাতা হ্যায়। অগর উসদিন ইয়ে হাদসা নেহি হোতা তো ইয়ে ভি কব ফরম্যাট হো যাতা।’

অপু বলল, ‘পহেলে আঠাইশ তারিখ কা ফাইল খোলিয়ে। দোপহর সওয়া বারাহ সে দেখনা হ্যায়।’

‘ঠিক হ্যায়।’ 


ম্যানেজার প্লেব্যাক শুরু করলেন৷ বারোটা ছাব্বিশ মিনিট তেত্রিশ সেকেন্ডে কলারওয়ালা লাল টিশার্ট আর নীল রঙের ডেনিম জিন্স পরে ডেরেকের এন্ট্রি৷ পিঠে শ্যাওলা সবুজ ব্যাকপ্যাক৷ তারপরে চেক ইন৷ বারোটা পঁয়ত্রিশ মিনিট উনত্রিশ সেকেন্ডে কাউন্টারে এসে দাঁড়াল বরমদেও৷ রিসেপশনিস্ট তার হাতে রুমের চাবি দিল৷ বারোটা সাঁইত্রিশ মিনিট ছেচল্লিশ সেকেন্ডে কাউন্টার ছেড়ে চলে গেল দুজনেই৷


আঠাশ তারিখের রাত দশটা পর্যন্ত সবগুলো ফুটেজ আগুপিছু করে দেখা হল৷ তার মধ্যে বিকাল চারটে ছাব্বিশ নাগাদ ডেরেক একবারই বাইরে গেছে৷ ফিরে এসেছে সাতটা সাতান্ন মিনিট বারো সেকেন্ডে৷ 

অপু বলল, ‘অব উনতিস কা দেখুঙ্গি৷’


ফুটেজ দেখার কাজটা খুবই একঘেয়ে আর বিরক্তিকর৷ একনাগাড়ে মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মাঝে মাঝে মাথা ঝিম ধরে যায় আর চোখ দপদপ করে৷ হৃষীকেশ অপুকে বললেন, ‘একটু ব্রেক দাও৷ অনেকক্ষণ একটানা দেখছ৷’ 

অপু বলল, ‘ঠিক বলেছ৷ চোখে একটু জল দিয়ে আসি৷’


***

উনত্রিশ তারিখে বেলা এগারোটা ষোল মিনিট বেয়াল্লিশ সেকেন্ডে ডেরেক রিসেপশন কাউন্টারে এসে দাঁড়াল৷ গায়ে জলপাই রঙের হাফশার্ট৷ সঙ্গে সেই আগের দিনের ব্লু ডেনিম৷ 


রিসেপশনিস্ট অপুদের পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল৷ রেকর্ডিং দেখতে দেখতে বলে উঠল, ‘রেস্টোরান্ট কা বিল ভরনে আয়া থা৷’ 


মানিব্যাগ খুলে টাকা বার করতে গিয়ে তাড়াতাড়িতে একটা কাগজের টুকরো নিচে পড়ে গেল৷ ডেরেক অবশ্য সেটা খেয়াল করল না৷ টাকাপয়সা মিটিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে গেল এগারোটা ছাব্বিশ মিনিট উনষাট সেকেন্ডে৷ ফিরল প্রায় দু’ঘন্টা পরে৷ একটা বেজে সতেরো মিনিটের মাথায়৷ 


বিকাল চারটে সাতান্ন নাগাদ হঠাৎ করে গুচ্ছের লোকজন আসা শুরু হল৷ ম্যানেজার বললেন, ‘উস দিন য়ঁহা ব্যাঙ্কোয়েট থা৷’ 


অপু মনিটরের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল৷ পাঁচটা পঁচিশ মিনিট আট সেকেন্ডে দেখা গেল, কোথ্থেকে একটা ছোটখাটো নীল সুটকেস হাতে নিয়ে ডেরেক হোটেলে ফিরছে৷ পরনে খয়েরি রঙের ট্রাউজার আর হলুদ ফুলশার্ট৷ চোখে একটা চশমা৷ তপু উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল, ‘এই সুটকেসটাই তো সেই সুটকেসটা!’ 


কাঁটায় কাঁটায় সাতটা একত্রিশ মিনিটে ডেরেক আবার বাইরে বেরোল ব্যাকপ্যাক নিয়ে৷ আবার সেই সকালবেলার পোশাক৷ লাউঞ্জে তখন ভালো রকমের ভিড়৷ 


হৃষীকেশ বললেন, ‘খুনটা তো হয়েছিল সওয়া আটটা থেকে সাড়ে আটটার মধ্যে?’

‘পোস্টমর্টেমে তো তাই লিখেছে৷’ 

তপু বলল, ‘বেঁচে থাকাটা কী অ্যাবসার্ড, না? একঘন্টা আগেও মানুষটা কেমন হালকা চালে হাওয়া খেতে বেরিয়েছে!’ 


অপু ম্যানেজারকে বলল, ‘বাস৷ কাফি হ্যায়৷ আপ কো বহোত বহোত সুকরিয়া৷’

হৃষীকেশ বললেন, ‘গণ্ডগোলটা দেখলে?’

অপু মুচকি হেসে জবাব দিল, ‘ওইজন্যই তো বললাম, আর কিছু দেখার দরকার নেই৷’

তপু উৎকন্ঠিত ভাবে প্রশ্ন করল, ‘কী হয়েছে? আমাকেও বল৷’

‘বলব না৷’

‘এগুলো কিন্তু খুব খারাপ৷’

অপু মুখ বেঁকিয়ে বলল, ‘খারাপ তো খারাপ৷’

‘কাকু তুমি বলো তো৷’

হৃষীকেশ মজা করে বললেন, ‘আচ্ছা, বলছি৷ শুধু যাওয়া … আসা৷ বিচিত্র পর্যায়৷ কাহারবা৷ এর বেশি কিচ্ছু জানি না৷’ 


রিসেপশনিস্ট হঠাৎ বলল, ‘অওর এক চিজ হ্যায়।’

তিনজনেই ঘাড় ঘুরিয়ে কৌতূহলী ভাবে তাকাল৷ ভিতরের দেরাজ থেকে লোকটা একটা কার্ড বার করে বলল, ‘উসকে পর্স সে গির গ্যয়া থা৷ পোলিসকো বাতানা চাহিয়ে থা৷ মিস হো গ্যয়া৷ উস ওয়ক্ত বহোত টেনসন মে থে হমলোগ৷’ 


অপু কার্ডটা হাতে নিয়ে দেখল৷ শ্রী মারুতি কুরিয়র সার্ভিসেস প্রাইভেট লিমিটেড৷ তলায় ব্র্যাকেটে লেখা — মহেন্দর সার্ভিসেস৷ ঠিকানা — স্টেশন রোড, রায়পুর৷ অপোজিট পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক৷ 


চেয়ার থেকে উঠে অপু বলল, ‘দুপুর থেকে মাথাটা পুরো ধরে গেছে৷ বেরিয়ে কোথাও একটা কড়া করে চা খেতে হবে৷’

হৃষীকেশ বললেন, ‘এবারে তো বেরোলেই হয়৷’

‘দাঁড়াও, আর ছোট্ট দুটো কাজ আছে৷ বরমদেওয়ের সঙ্গে আরেকবার কথা বলতে চাই৷ আর দু-একটা জিনিসের ছবি দরকার৷ … তপু, রেজিস্টার থেকে ডেরেকের চেক ইনের একটা ফোটো তুলে নে তো৷ পুরোটা একসঙ্গে না এলেও হবে৷ হাফ হাফ করে তোল৷’

তপু মোবাইল ফোন বার করে ছবি তুলতে লাগল৷ 

অপু রিসেপশনিস্টকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আইডি প্রুফ ক্যা দিখায়া থা?’

‘ড্রাইভিং লাইসেন্স৷’

‘কালার্ড কপি হ্যায় আপকে পাস?’

‘জি৷’


ড্রাইভিং লাইসেন্সের ফোটোকপিটা হাতে নিয়ে তপুকে অপু বলল, ‘মুখটা ভালো করে স্ক্যান করে তুলে নে তো৷ রেজলিউশন যেন ভালো আসে৷’ 

তপু মিটমিট করে হেসে বলল, ‘ঘরে বাঁধিয়ে রাখবি?’

‘তোর বন্ধুর বদন৷ তুই রাখিস৷’


হোটেল থেকে বেরোনোর আগে বরমদেওকে আরেকবার ডেকে পাঠানো হল৷ অপু বলল, ‘আপ সে এক আখরি সওয়াল পুছনা থা৷’

‘জি কহিয়ে৷’

‘উনতিস তারিখ সাম কো উও যব সুটকেস লেকর আয়া থা … যব উসে সিড়ি সে উপর যাতে হুয়ে আপনে দেখা …. কুছ অজিব মেহসুস হুয়া?’

‘জি৷’

‘ক্যা হুয়া থা?’

‘সাহাব কো অপনা কমরা ইয়াদ নেহি থা৷ উনহোনে মুঝ সে পুছা কি তিনশ সাত কঁহা হ্যায়৷’ 


***

মহেন্দর সার্ভিসেস মোটামুটি বড়সড় দোকান৷ কুরিয়র ছাড়াও রেল-বাস-বিমানের টিকিট বুকিং আর গাড়ি ভাড়া দেওয়ার হরেকরকমবা৷ দোকানের লোকটি বেশ স্মৃতিধর৷ ডেরেকের ছবি দেখা মাত্র বলল, ‘হাঁ, ইয়াদ হ্যায়৷ কলকত্তা মে কুরিয়র ভেজা থা৷’ আঠাশে মে তারিখের বুকিং স্লিপের কপি বার করে দেখা গেল কুরিয়রটা পাঠানো হয়েছে বারো নম্বর যতীন বাগচী রোডে শেরখান কোম্পানির স্টক ব্রোকার রাধামুকুন্দ মনসুখানিকে৷’ 


দোকান থেকে বেরিয়ে অপু বলল, ‘আর ভাল্লাগছে না৷ চলো, একটু চা খাই৷’

হৃষীকেশ বললেন, ‘তারপরে কী? নগর পরিভ্রমণ?’

‘একশোবার৷’

তপু বলল, ‘জানো তো, এখানে খুব বড় বড় জিলিপি পাওয়া যায়৷’


***

ঘুমিয়ে পড়লে ফাল্গুনির আর জ্ঞানগম্যি থাকে না৷ তার মানে এই নয় যে, ফাল্গুনি ঘুমের ওষুধ খায়৷ ফাল্গুনির ওসব দরকারই হয় না৷ এক ঘুমে রাত কাবার৷ 


ছোটবেলায় ঠাকুমা একটা ছড়া বলত৷ প্রথম প্রহরে প্রভু ঢেঁকি অবতার, দ্বিতীয় প্রহরে প্রভু ধনুর টঙ্কার, তৃতীয় প্রহরে প্রভু কুকুরকুণ্ডলী, চতুর্থ প্রহরে প্রভু নুনের পুঁটুলি৷ আজ তৃতীয় প্রহরে ফাল্গুনি যখন গুটিসুটি হয়ে ঘুমোচ্ছিল, হঠাৎ যেন মনে হল, বইয়ের ঘর থেকে একটা আওয়াজ আসছে৷ 


ফাল্গুনি তখন চমৎকার একটা স্বপ্ন দেখছিল৷ বনবিবির স্বপ্ন৷ একটা বাঘের পিঠে চড়ে বনবিবি ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন৷ বাঘটা আবার পায়ে খড়ম পড়ে আছে৷ তাই খটখট করে শব্দ হচ্ছে৷ তারপর বনবিবি বাঘ সব মিলিয়ে গেল৷ কিন্তু খড়মের আওয়াজটা বন্ধ হল না৷ শেষে খটখট থেকে সেটা যখন ঠাস ঠাস দ্রুম দ্রাম হয়ে দাঁড়াল, ঘুমের ঘোরে ফাল্গুনি প্রথমে ভাবল, বাঘ নয়, জানলার ছিটকিনি খোলা পেয়ে হয়ত বেড়াল ঢুকেছে৷


ঠিক তখখুনি কাচ ভাঙল ঝনঝন করে৷ ফাল্গুনি ধড়মড় করে উঠে বসে হাঁক পাড়ল, ‘কে রে?’ সঙ্গে সঙ্গে দুপদাপ করে কারা যেন দৌড় মারল বইয়ের ঘর থেকে৷ ফাল্গুনি আলো জ্বালিয়ে ছুটে গিয়ে দেখল, সর্বনাশ৷ জানলার গ্রিল কাটা৷ সারা ঘরে বইপত্র লণ্ডভণ্ড৷ বইয়ের আলমারির কাচ ভেঙে চৌচির হয়ে ছড়িয়ে আছে মেঝেতে৷


(চলবে)


আগের পর্বগুলি পড়ুন : 

১) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (প্রথম পর্ব) 

২) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (দ্বিতীয় পর্ব) 

৩) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (তৃতীয় পর্ব) 

৪) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (চতুর্থ পর্ব) 

৫) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (পঞ্চম পর্ব) 

৬) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (ষষ্ঠ পর্ব)  

৭) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (সপ্তম পর্ব) 

৮) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (অষ্টম পর্ব) 

৯) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (নবম পর্ব) 

১০) সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (দশম পর্ব) 

........................ 

[অলংকরণ : বিবস্বান]  

#ধারাবাহিক উপন্যাস #weekly novel #রহস্য উপন্যাস #Thriller #সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন #তপোব্রত ভাদুড়ি #silly পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

50

Unique Visitors

182690