এক সন্ন্যাসী প্রেমিকের গল্প : সুরমা ঘটককে পাঠানো ঋত্বিকের চিঠিপত্র
‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ সিনেমার শেষ অংশটা মনে আছে? আকণ্ঠ মদ্যপান করা নীলকণ্ঠ তখন পুলিশের গুলিতে মৃতপ্রায়। আর বলছে, “সব পুড়ছে। ব্রহ্মাণ্ড পুড়ছে, আমি পুড়ছি”। এ কি নীলকণ্ঠের কথা? নাকি নীলকণ্ঠের মত সারা জীবন বিষ পান করে যাওয়া ঋত্বিক ঘটকের নিজের কথা। যার জীবনে বুলেটের ক্ষতের থেকেও বেশি যন্ত্রণাদায়ক ব্যর্থতা ও হতাশার দাগ। নিজের বিশ্বাস, নিজের আদর্শের কাছে সৎ থাকার জন্য তিনি পালিয়ে বেড়িয়েছেন, পথ খুঁজেছেন, আশ্রয় চেয়েছেন। একমাত্র আশ্রয়ের নাম ছিল সুরমা ঘটক, তাঁর সহধর্মিনী, তাঁর লক্ষ্মী, তাঁর ‘Das kapital’। তাঁকেও তিনি ধরে রাখতে পারেননি। ‘separation is essential’—বিচ্ছেদ হয়ে গেল দুজনের। বাউন্ডুলে ঋত্বিক, মদ্যপ ঋত্বিক, অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ঋত্বিক অসংখ্য ব্যর্থতা সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশের মায়ের কোলে শেষ আশ্রয় নিলেন। সুরমা ঘটককে পাঠানো তাঁর চিঠিগুলি এক অসহায় প্রেমিকের দমবন্ধ পরিস্থিতির আর্তনাদের সাক্ষী হয়ে রইল।
অথচ জীবনটা এভাবে শুরু হয়নি। পদ্মাপারের ছেলে ঋত্বিক তখন গণনাট্যের অভিনেতা-সংগঠক, পার্টির সক্রিয় কর্মী; পরিচালিত ছবি ‘নাগরিক’-এর মুক্তি নিয়ে তাঁর তখন অনেক স্বপ্ন। সেই সময়ে ১৯৫২ সালে ঋত্বিকের সঙ্গে সুরমার আলাপ। “ওরে আমারও একদিন নবীনত্ব ছিল। অনেক আশা, অনেক বিশ্বাস, অনেক উৎসাহ পুঁজি করে... প্রেমে পড়ে গেলাম।” নেপথ্যে বেজে উঠল শিলং পাহাড়ে যুবক নীলকন্ঠ ও দুগগার কণ্ঠে গান ‘আমার অঙ্গে অঙ্গে...’। সাহিত্য, নাটক, রাজনীতি, সিনেমা নিয়ে আলোচনা কখন যেন ব্যক্তিগত আলাপের জায়গায় চলে আসে। এদিকে ‘নাগরিক’ রিলিজ করা গেল না, ‘বেদেনি’-র কাজ টাকার অভাবে বন্ধ করে দিতে হল। গণনাট্য আর পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হল। কিছুদিন পরেই আদিবাসীদের নিয়ে সিনেমা তৈরির কাজে ঋত্বিক রাঁচী চলে যান। সেখান থেকে সুরমার উদ্দেশ্যে আসতে থাকে একের পর এক চিঠি। যেখানে ব্যক্তিগত হতাশা-ক্ষোভ, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, রাজনীতি ছাড়াও ছিল প্রেম। একটি চিঠিতে তিনি প্রতিজ্ঞা করছেন, “আমাদের অতীতের পাঁচ ছয় বছরের সঙ্গে সব সম্পর্ক সত্যি সত্যি চুকিয়ে দিতে হবে। যা কিছু আমার টাকার জের, তাঁদের দায়িত্ব থেকে এবার মুক্ত করব নিজেকে।” বেকার জীবনের ধিক্কার, ‘নাগরিক’-এর ব্যর্থতা পেরিয়ে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা। দূর সমুদ্রে পথ হারানো নাবিক ডাঙা দেখে নোঙর প্রস্তুত করছেন। আমি থেকে আমরা হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। চিঠিতে লিখছেন, “জীবনে নোঙর ছিল না। তোমার সঙ্গ আমার নিজের মধ্যে সেই নোঙর দেখাল। হাজার বক্তৃতাবাজি আর পড়াশুনো আমার একেবারে ভেতরের এই বেপরোয়াভাব মোছাতে পারেনি। আজ সেটা হয়েছে। এখন থেকে এইটেই আমার প্রাপ্তি।”
এ এক অন্য ঋত্বিক ঘটক। যিনি নিজের ক্লেদাক্ততাকে ধুয়ে নিতে চাইছেন অন্য এক মানুষের পবিত্রতার ঝর্ণায়। সুরমা ভট্টাচার্যকে লিখছেন, “কর্ণ জন্মেছিলেন সহজাত কবচকুণ্ডল নিয়ে তুমি জন্মেছ সহজাত শুচিতা নিয়ে।… তুমি মানুষটি শরৎকালের মত। চিরকালের শিশু, অথচ চিরগভীর।” তার কদিন পরেই সুরমা ভট্টাচার্য সুরমা ঘটক হলেন। কয়েকদিন পরেই মুম্বইয়ের ‘ফিল্মিস্থান’-এ চাকরির অফার। আশা করেছিলেন, “একটি stroke–এ অতীতকে দুহাতে মুছে ফেলা যাবে”। যে দায়বদ্ধতা নিয়ে তিনি রাজনীতি শুরু করেছিলেন, গণনাট্যের সক্রিয় কর্মী হয়ে উঠেছিলেন; তার চেয়েও অনেক দায়বদ্ধতা, শক্তি, তাগিদ নিয়ে তাঁর সাংসারিক জীবনের যাত্রা শুরু। পাড়ি দিলেন মুম্বই। কিন্তু সেখানকার কাজে তৃপ্তি পেলেন না। ভালোবাসার কাছে অসহায়ের মতো আত্মসমর্পণ করে চিঠি লিখলেন, “তোমাকে না পেলে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যেতাম।”
অতঃপর ফিরে আসা ও ফিরে আশা। কিন্তু এখানেও ব্যর্থতা। ‘অযান্ত্রিক’, ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ ফ্লপ করল। ‘কত অজানারে’ পরিত্যক্ত হল। ‘কোমল গান্ধার’ ব্যর্থ হল, ‘সুবর্ণরেখা’র মুক্তি পিছিয়ে গেল। একমাত্র সাফল্য বলতে ‘মেঘে ঢাকা তারা’। মদ্যপানের মাত্রা বাড়তে থাকল। মদ্যপান করে ফুটপাথে পড়ে থাকা শুরু হল। অথচ এই মানুষটাই ছেলেকে রাজকাহিনীর গল্প বলে ঘুম পাড়াচ্ছেন। রবিশংকরের থেকে সুর করে নিয়ে আসছেন ঘুমপাড়ানি গান। সুরমা ঘটক লিখছেন “যাঁর মনে এত স্নেহ ভালোবাসা ও দরদ, তিনি কেন জীবনের ওই আবর্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেন না ভেবে পাই না।”
১৯৬৪-৬৫ নাগাদ পুণে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের ভাইস প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পেলেন। তার আগে ‘আরণ্যক’, ‘বগলার বঙ্গদর্শন’, ‘নকশি কাঁথার মাঠ’-এর কাজ টাকার জন্য ভেস্তে গেছে। ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁকে নিয়ে বানানো ডকুমেন্টারিটার যোগ্য সম্মান পেলেন না। অথচ কলকাতার পরিবেশ ছেড়ে পুনেতে আসতেই তিনি আবার অন্য মানুষ। তাঁর কাঙ্ক্ষিত সম্মান ও মর্যাদাও তিনি এখানে পাচ্ছেন। আবার স্বপ্ন, আবার নতুন করে অগোছালো ঘরটাকে গুছিয়ে তোলার আশা। টেলিগ্রাম করছেন “it is always darkest before dawn.” চিঠিতে লিখছেন যে তিনি মদ্যপান ছেড়ে দিয়েছেন। “ইচ্ছে আছে আর খাবও না। এভাবে আমাদের সবার জীবন নষ্ট হতে দেব না। একবার শেষ চেষ্টা করে দেখি”। কিন্তু এই সময়ে কেন্দ্রীয় সরকারের আপত্তিতে ‘সুবর্ণরেখা’ ছবিটি কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শিত হওয়ার সুযোগ হারায়। প্রতিবাদ জানিয়ে ঋত্বিক পুনের চাকরি ছেড়ে কলকাতায় ফিরে এলেন। সোজা কথা- লোকের কাছে ভিক্ষা করব না, মাথা নীচু করব না। পরিত্যক্ত ‘রঙের গোলাম’ ছাড়া ঋত্বিক তখন সম্পূর্ণ বেকার। একাধিক সিনেমার ব্যর্থতা, পার্টি ও ঘনিষ্ঠ কমরেডদের বিশ্বাসঘাতকতা, প্রবল মাত্রায় মদ্যপান, অসংখ্য অসমাপ্ত কাজ, দীর্ঘসময় কর্মহীনতা। ডাক্তার জানালেন ‘ইনফ্যান্টাইল ও ডবল পার্সোনালিটি’। শেষ ঠিকানা হয়ে দাঁড়াল গোবরা মেন্টাল হাসপাতাল।
১৯৭০ নাগাদ সুরমা ঘটক শিক্ষকতার কাজ পেয়ে সাঁইথিয়া চলে যান। সংসার জীবনের ইতিই বলা যেতে পারে। ঋত্বিক চিঠিতে লিখছেন, “তবু মাঝে মাঝে দেখতে দিও। আমার জীবন কেটে যাবে, যে করে হোক।” দূর সমুদ্রে পড়ে রইল প্রেম, বিয়ে, সংসার, সন্তান, সম্পর্ক। শিলং পাহাড়, রবীন্দ্রসঙ্গীত, দাস কাপিটাল হয়ে গেলো অতীতের ছায়া। আশা-প্রত্যাশা-স্বপ্নের মধ্যে পদ্মার উথাল ঢেউ। যেন নিজের ভবিতব্য বুঝতে পেরে সম্পর্ক থেকে একপ্রকার নির্লিপ্ত হয়ে গেলেন তিনি। কাটা কাটা কথায় চিঠি লিখলেন, “ভালোবাসি। টয়েনক্সকে, বাবুলকে, বাবুইকে। বোধহয় তোমাকেও। আসছি। চার পাঁচদিন জ্বালাব। না, শান্তিনিকেতনে থাকব। একবার করে দেখে যাব। তারপর রামপালান পালাব। চিরকালের মত। দেখি পারি কিনা”। নিচের সম্বোধন ‘ঘৃণা- ঋত্বিক’।
আরও পড়ুন : ঋত্বিক ঘটকের অসম্পূর্ণ ছবি / বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য
এরপর অপরিমিত মদ্যপানে অসুস্থ হয়ে এই সময়ে বারবার হাসপাতালে ভর্তি হওয়া শুরু হল। গলায় টিউমার ধরা পড়ল। তারপরেও একাধিক ছবির কাজে হাত দিলেন আর ব্যর্থ হলেন। ‘তিতাস’ এদেশে এল না, ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ মুক্তি পেল না। ঠাকুরমার ঝুলি থেকে একটি গল্প, ‘সেই বিষ্ণুপ্রিয়া’, ‘লজ্জা’ ছবির পরিকল্পনা অর্থ ও অসুস্থতার কারণে পূর্ণ হল না। অসুস্থতা দিনকে দিন তাঁকে মৃত্যুর কাছাকাছি নিয়ে আসছে। সারাজীবনের ভুল তিনি আর শুধরানোর সুযোগ পাবেন না। আত্মবিশ্লেষণের পর তিনি বুঝেছেন এই পাপচক্রে পরিবারের ক্ষতি করার কোনো অধিকার তাঁর নেই। চিঠিতে তিনটি ছবির স্বত্বাধিকার সুরমা ঘটকের নামে লিখে দিলেন।
আরও পড়ুন : গণনাট্য সংঘের ফতোয়া ও সলিল চৌধুরী / টিম সিলি পয়েন্ট
সম্পর্কে পলি পড়ে—যৌবনের উন্মাদনা স্তিমিত হয়ে আসে পরবর্তী কালে। কিছু স্বপ্ন পূর্ণ হয়, কিছু পূর্ণ হয় না। অভ্যাসের মতো করে থাকা-খাওয়া-বেঁচে থাকার সঙ্গে একটা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে মানুষ। এরই মধ্যে একটা পূর্ণতা খুঁজে নেয় প্রেম। ঋত্বিকও চেষ্টা করেছিলেন। ঋত্বিক সুলভ পাগলামিটা নিয়ে রাজার মতো ফিরে আসতে চেয়েছিলেন, খড়কুটো যা পেয়েছিলেন তাতেই সর্বস্ব দিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু বার বার ব্যর্থতার আঘাতে তিনি হার মেনেছেন, পালাতে চেয়েছেন। এই সর্বস্বান্ত সময়ে যে মানুষটি তাঁকে আবার শক্তি, সাহস, সান্ত্বনা দিতে পারত, তাঁর থেকেই তিনি দূরে সরে গেলেন। চিত্র পরিচালক হিসেবে প্রাপ্য সম্মান হয়তো পরে পেলেন। কিন্তু কিছু বোতল আর একটা কালো জহর কোট ছাড়া ব্যক্তি ঋত্বিকের পরিচিতি কিছুই রইল না। কে বলবে তিনিও একদিন স্বপ্ন দেখেছিলেন, “দুটি অসহায় ছেলেমেয়ে দূরে দূরে থেকে মার খেয়েছে বাড়ি খেয়েছে, কাতরেছে, এখন হাত ধরাধরি করে তাঁর হাঁটবে, সুদৃঢ় পদক্ষেপ হবে। আবার মার খাবে, আবার পড়বে, আবার উঠবে, কাঁদবে, কাতরাবে, কিন্তু অসহায় আর থাকবে না। এটা থাকবে তফাৎ, ওরা একটা social unit হয়ে গেছে”।
এই ঋত্বিকও কি ভাবায় না, ভাবা প্র্যাক্টিস করায় না?
................................
ঋণস্বীকার : ১) ‘ঋত্বিক’, সুরমা ঘটক।
২)‘পদ্মা থেকে তিতাস’, সুরমা ঘটক।