গণনাট্য সংঘের ফতোয়া ও সলিল চৌধুরী
বাংলা তথা ভারতীয় সংগীতের একজন প্রবাদপুরুষ তিনি। বামপন্থায় বিশ্বাসী ছিলেন। একেবারে ছাত্রবয়স থেকে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে ছিলেন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি ও বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে। পেশাদারভাবে কাজ শুরু করার আগে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের হয়ে একের পর এক অবিস্মরণীয় গণসংগীত উপহার দিয়েছেন তিনি। অথচ সেই কমিউনিস্ট পার্টিই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল সলিল চৌধুরীর বেশ কিছু গান। শুধু তাই নয়, তাঁর বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গ, প্রতিক্রিয়াশীল মনোভাব, ‘আন্দোলনকে ছুরি মারা’ - ইত্যাদি অভিযোগও তুলেছিল।
অবশ্য সলিল চৌধুরী একা নন, কমিউনিস্ট পার্টির এমন তুঘলকি ফতোয়ার শিকার হতে হয়েছিল সে সময়ের আরও অনেক শিল্পী-সাহিত্যিককে। কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক থাকাকালীন পূরণচাঁদ যোশী সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে কর্মসূচীর অন্যতম অঙ্গ হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। প্রগতি লেখক-শিল্পী গোষ্ঠী তাঁর সক্রিয় সমর্থনেই গড়ে উঠেছিল, যার অনিবার্য ফলশ্রুতি হিসেবে জন্ম নেয় ভারতীয় গণনাট্য সংঘ (Indian Peoples’ Theatre Association, সংক্ষেপে I.P.T.A.)। সে সময়ের প্রায় সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন শিল্পী-সাহিত্যিকদের এক ছাতার তলায় নিয়ে এসে সংস্কৃতিকে সমাজ-বদলের হাতিয়ার করে তুলতে চেয়েছিলেন যোশী। আইপিটিএ তখন আক্ষরিক অর্থে চাঁদের হাট। শম্ভু মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য, চিত্তপ্রসাদ, দেবব্রত বিশ্বাস, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, ঋত্বিক ঘটক, সলিল চৌধুরী, উৎপল দত্ত, সোমনাথ হোর, রবিশঙ্কর, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো ব্যক্তিত্বরা সকলেই কোনও না কোনও সময় এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কেউ সময়ের প্ররোচনায়, কেউ বা অন্তরের টানে। কিন্তু যোশী-জমানার পর দলের সম্পাদক হয়ে এলেন বি.টি. রণদিভে। তিনি এবং তাঁর গোষ্ঠীর নেতাদের না ছিল শিল্পবোধ, না ছিল শিল্পের প্রতি মমত্ব। সবকিছুকেই তাঁরা কঠোরভাবে ছাঁচে ঢেলে নিজেদের মত ও পথের উপযোগী করে নেওয়ায় বিশ্বাসী ছিলেন। শিল্পীকে পার্টি-লাইন অনুসরণ করে চলতে হবে, এমনই ছিল পার্টির নেতাদের দাবি। ঘটনা বা অর্ধসত্যকে বিকৃত করে কুৎসা রটানোয় তাঁরা ছিলেন সিদ্ধহস্ত। ফলে পার্টি-লাইন গলার বকলস হয়ে উঠে এই মহান শিল্পীদের প্রত্যেককেই একসময় আইপিটিএ ছাড়তে বাধ্য করেছে।
আরও পড়ুন : ফরাসি আকাদেমির সদস্যপদ দেওয়া হয়নি নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীকেও / অর্পণ পাল
প্রকৃত শিল্পী কখনও ‘ম্যানুফ্যাকচার্ড’ শিল্প সৃষ্টি করতে পারেন না। যা একান্ত আন্তরিক অনুভূতি থেকে উৎসারিত হয়, তাকে বাঁধ দিয়ে একটিমাত্র অভিমুখে পরিচালিত করতে চাইলে স্বাভাবিকভাবেই শিল্পীর দমবন্ধ হয়ে আসে। কমিউনিস্ট পার্টির ছকে দেওয়া সেই অভিমুখ ক্রমেই হয়ে উঠছিল হাস্যকর রকমের সংকীর্ণ। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের স্মৃতিচারণা থেকে জানতে পারি, সে সময় দুটো শব্দে বেঁধে দেওয়া হয়েছিল যাবতীয় শিল্পকাজকে - ‘Link up’ আর ‘Way out’। তিনি লিখছেন, “যা কিছু লিখি না কেন তাকে ‘Link up’ করতে হবে জাপানি ফ্যাসিবাদের সঙ্গে; যা কিছুই লিখি না কেন, দুর্ভিক্ষের হাত থেকে মুক্তির উপায়, ‘Way out’ হিসেবে বলতে হবে উৎপাদন বাড়ানোর কথা।” আরও অনেকের মতো সলিলও স্থূল বোধসম্পন্ন নেতাদের এই একগুঁয়ে নীতির শিকার হয়েছিলেন। গণনাট্যের সিংহভাগ বিখ্যাত গানের রূপকার তিনি। তাঁর লেখা কয়েকটি নাটকও গণনাট্যের ব্যানারে অভিনীত হয়েছিল। তাঁর হাত ধরেই গড়ে উঠেছিল গণনাট্য সংঘের বেশ কয়েকটি শাখা। অথচ পার্টির নেতারা তাঁকে অন্যায় অভিযোগে বিদ্ধ করতে বা তাঁর দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে ছাড়লেন না। সংকীর্ণ রাজনীতির গণ্ডীতে আবদ্ধ থাকার মানসিকতা সলিলের ছিল না। পার্টি-লাইনের তাৎক্ষণিক চাহিদার চেয়ে চিরকালীন সংগ্রামী চেতনা তাঁর কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাঁর অমর সৃষ্টি ‘কোনও এক গাঁয়ের বধূ’ তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। কিন্তু নেতারা পার্টি-লাইনের অনুসরণ খুঁজে না পেয়ে সেই গান গণনাট্য সংঘে নিষিদ্ধ করলেন। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের বিখ্যাত কবিতা ‘পালকির গান’-এ সুরারোপ করেছিলেন তিনি। ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ তকমা দিয়ে নিষিদ্ধ করা হল সেই গানও। তবে সবচেয়ে হাস্যকর ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে, ধান দেব মেপে’ গানটিকে নিষিদ্ধ করার পিছনে পার্টির যুক্তি। এই গানে একটি লাইন ছিল “হায় বিধি বড়ই দারুণ”। নেতারা যুক্তি দিলেন, কমিউনিস্টরা কেন বিধাতার উল্লেখ করবেন? এ জিনিস প্রতিবিপ্লবী ছাড়া আর কী! সলিল প্রতিবাদ জানান। মনস্থ করেন, আইপিটিএ-র জন্য আর কিছু লিখবেন না বা সুর করবেন না। পার্টি তাঁর বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ তোলে। ১৯৫৩ সালে বিখ্যাত চলচ্চিত্র-নির্মাতা বিমল রায় সলিলের ‘রিকশাওয়ালা’ গল্প অবলম্বনে ‘দো বিঘা জমিন’ ছবি করবেন বলে মনস্থ করেন। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে সলিল মুম্বই যান। পার্টির নেতারা নির্দ্বিধায় রায় দেন, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পিঠে ছুরি মেরে সলিল নিজের কেরিয়ার গোছাতে বোম্বাই গেছেন। আলোচক অশ্রুকুমার সিকদার তাঁর ‘কিল মারার গোঁসাই’ বইতে এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন - “যখনই যে শিল্পী কমিউনিস্ট পার্টির বিশেষ সময়ের তত্ত্বের ছাচের মধ্যে বন্দী থাকতে চাননি, শিল্পের নিজস্ব আহ্বান যখনই আত্মবিকাশের জন্য তাঁকে বৃহত্তর ক্ষেত্রে ডেকে নিয়ে গিয়েছে, তখনই তাঁর বিরুদ্ধে কেরিয়ারিজমের, পেশাদার পশার-জমানোর অভিযোগ উঠেছে। যে নর্তক শম্ভু ভট্টাচার্যের কথা এর পরেই আমরা আলোচনা করব, তিনি সলিল চৌধুরী সম্বন্ধে বলেছিলেন, সলিল চৌধুরীকে কেরিয়ার তৈরি করতে হয়নি, তাঁর প্রতিভাই তাঁকে সলিল চৌধুরী করে দিয়েছে। জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে সলিল চৌধুরী হয়তো তাঁর অন্যতম আদিগুরু খগেন রায়চৌধুরীর কথার সত্যতা বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, শিল্পসৃষ্টি ব্যক্তির কাজ, দলবদ্ধভাবে তা হয় না।”
আরও পড়ুন : স্ফুলিঙ্গ তার পাখায় পেল ক্ষণকালের ছন্দ : সার্ধশতবর্ষে বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর / টিম সিলি পয়েন্ট
তবে ‘দো বিঘা জমিন’ বলিউডে সলিলের আসন পাকা করে দিয়েছিল। এরপর তাঁকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ফলে আইপিটিএ বা কমিউনিস্ট পার্টির সংস্রব থেকে অনেক দূরে একেবারে অন্য এক রূপকথা লিখতে শুরু করেন সলিল চৌধুরী। ঠিক সময়ে ‘কিল মারার গোঁসাই’-দের সংস্রব এড়াতে পেরেছিলেন বলেই ভারতীয় সংগীত এমন এক মহাপ্রতিভাকে পেয়েছিল।
ঋণ :
১) ‘জীবন উজ্জীবন’, সলিল চৌধুরী, প্রতিক্ষণ
২) ‘কিল মারার গোঁসাই’, অশ্রুকুমার সিকদার, দীপ প্রকাশন
৩) ‘গণনাট্য আন্দোলন’, দর্শন চৌধুরী, অনুষ্টুপ
#সলিল চৌধুরী #সুরকার #গীতিকার #ভারতীয় গণনাট্য সংঘ #গণসংগীত #পূরণচাঁদ যোশী #বি. টি. রণদিভে #শম্ভু মিত্র #ঋত্বিক ঘটক #উৎপল দত্ত #বিজন ভট্টাচার্য #দেবব্রত বিশ্বাস #চিত্তপ্রসাদ #হেমাঙ্গ বিশ্বাস #Salil Chowdhury #Music Composer #Music Director #Indian Peoples’ Theatre Association #I.P.T.A. #টিম সিলি পয়েন্ট