স্ফুলিঙ্গ তার পাখায় পেল ক্ষণকালের ছন্দ : সার্ধশতবর্ষে বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর
জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর-পরিবারের উজ্জ্বল সব নক্ষত্রের ভিড়ে এক অস্ফুট প্রতিভা বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭০-১৮৯৯)। সাহিত্যক্ষেত্রে তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে শুরু করেছিলেন। তাই শুধু নয়, নিতান্ত কম বয়সেই একজন সফল উদ্যোগপতি হয়ে ওঠার সমস্ত সম্ভাবনা তাঁর মধ্যে দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু মাত্র উনত্রিশ বছর বয়সে অকালমৃত্যু এসে থামিয়ে দেয় তাঁকে। বাংলা সাহিত্যের মহত্তম অপচয়দের তালিকায় তাঁর নাম থাকবেই।
বলেন্দ্রনাথের জন্ম ১৯৭০ সালের ৬ নভেম্বর। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ পুত্র বীরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের একমাত্র সন্তান ছিলেন তিনি। ঠাকুরবাড়ির মতো অভিজাত পরিবারের ছত্রছায়া পেলেও তাঁর শৈশব বিশেষ সুস্থিত ছিল না। কারণ তাঁর জন্মের বছর দুয়েক আগেই বীরেন্দ্রনাথ মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিলেন। পরিবারের কারণে আর্থিক অনটনে ভুগতে হয়নি কখনও, কিন্তু একটি অভিজাত পরিবারের অভ্যন্তরেও নানারকম সমীকরণ কাজ করে, যার সবটা খুব সহজ-সরল নয়। প্রফুল্লময়ীর কার্যত দশ হাতে প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে বলেন্দ্রনাথকে মানুষ করেছিলেন। বলেন্দ্রনাথের নিজেরও সামান্য শারীরিক প্রতিবন্ধকতা ছিল। তাঁর একটি পায়ে সমস্যা ছিল। সে কারণেও ছোটোবেলায় পরিহাসের শিকার হতে হত তাঁকে। তবে সমস্ত সমস্যা কাটিয়ে উঠে খুব কম বয়সেই তিনি প্রখর নিজস্বতা ও প্রতিভার পরিচয় দিতে শুরু করেন। বালকবয়সেই পরিবারের সকলের প্রিয় হয়ে ওঠেন সপ্রতিভ বলেন্দ্রনাথ। পরিবারে তাঁর আদরের নাম ছিল ‘বলু’।
প্রফুল্লময়ী দেবী তাঁর ‘স্মৃতিকথা’-তে লিখেছেন, “যখন (সে) আট-নয় বছরের, সেই সময় আমাকে প্রায় বলিত যে, সে লেখাপড়া শিখিয়া ইঞ্জিনিয়ার হইবে। লেখাপড়া তাহার নিকট একটা প্রিয় বস্তু ছিল, কোনোদিন তাহাতে অবহেলা করে নাই। যখন ওর তেরো বছর বয়স, সেই সময় আমরা একবার শ্রীরামপুর যাই। সেখানে থাকিবার সময় একদিন একটা মাঝি নৌকায় চড়িয়া গান গাহিতে গাহিতে যাইতেছিল, ‘আমার খুড়ো-খুড়ি পায় না মুড়ি’ ইত্যাদি। এই গান শুনিবার পর হইতেই ওর মনে কী একরকম ভাব উপস্থিত হয়, তখন হইতে সে প্রায়ই এক-একটা প্রবন্ধ লিখিয়া আমাকে শোনাইত।” অর্থাৎ একেবারে শৈশব থেকেই তাঁর দানা বাঁধছিল সৃজনশীলতা। খুব কমবয়সে জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর সম্পাদনায় ‘বালক’ পত্রিকায় লেখক হিসেবে তাঁর প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে। পরে ‘সাধনা’ পত্রিকার প্রকাশেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। সীমিত জীবনকালে তাঁর তিনটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। চিত্র ও কাব্য (প্রবন্ধ-সংকলন, প্রকাশ ১৮৯৪ খ্রি), মাধবিকা (কাব্য, প্রকাশ ১৮৯৬ খ্রি), শ্রাবণী (কাব্য, প্রকাশ ১৮৯৭ খ্রি)। কবিতা-রচনায় সাবলীল হলেও তাঁর লেখনী গদ্য বা প্রবন্ধের ক্ষেত্রে বেশি ক্ষুরধার ছিল। প্রবন্ধের বিষয়-নির্বাচনে বিচিত্রগামী ছিল তাঁর দৃষ্টি। সাহিত্য, সমাজ, প্রকৃতি, ললিতকলা, ভ্রমণ, দেশীয় ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান ইত্যাদি বিবিধ বিষয়ে ছিল তাঁর অনায়াস দখল। সংস্কৃত সাহিত্য এবং মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বিশেষ আগ্রহ ছিল তাঁর। কালিদাস বা শূদ্রকের সাহিত্যকর্ম নিয়ে তাঁর মনোজ্ঞ আলোচনায় যে অন্তর্দৃষ্টির সন্ধান পাওয়া যায়, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর মতো প্রাজ্ঞ সমালোচক তা এত কম বয়সে অতি দুর্লভ বলে মনে করেছেন। বাংলায় শিল্প-সমালোচনার ধারাটি, অনেকে মনে করেন, যথাযথভাবে শুরু হয় তাঁর হাত ধরেই। রবিবর্মা, কোণারক, নগ্নতার সৌন্দর্য, দিল্লীর চিত্রশালিকা ইত্যাদি এ বিষয়ে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। বারাণসী, খণ্ডগিরি, প্রাচীন উড়িষ্যা ইত্যাদি প্রবন্ধে দেশীয় ঐতিহ্যের প্রতি অনুরাগের পাশাপাশি গভীর সমাজবোধের পরিচয় বহন করে। প্রাচ্য প্রসাধনকলা, ‘নিমন্ত্রণ সভা’-র মতো প্রবন্ধে এই সমাজবোধের প্রকাশ আরও স্পষ্ট। অপরাধ-বিজ্ঞান নিয়ে তাঁর মূল্যবান দুটি প্রবন্ধ (রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ক্রিমিনাল-তত্ত্বের প্রয়োগ, ক্রিমিনাল মানব-তত্ত্ব) অবাক করে আমাদের। এমন বিষয় নিয়ে সে সময় অন্য কেউ প্রবন্ধ লিখেছেন কিনা সন্দেহ। এছাড়া বলেন্দ্রনাথ কিছু ব্রহ্মসংগীতও লিখেছিলেন।
আরও পড়ুন - গ্রুপ থিয়েটারই ধাত্রী, গ্রুপ থিয়েটারই মৃত্যুবাণ : স্মরণে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়
রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীই সম্ভবত প্রথম সমালোচক, যিনি বলেন্দ্রনাথকে নিয়ে আলাদাভাবে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলেন। ‘চরিত কথা’ গ্রন্থের ‘বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর’ নামে নিবন্ধে তিনি বলেন্দ্রনাথের গদ্যের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন - “শুনিয়াছি, বলেন্দ্রের ভাষা তাঁহার সাধনার ফল। শিক্ষানবিসি অবস্থায় কাটিয়া ছাঁটিয়া পালিশ করিয়া তিনি ভাবের উপযোগী ভাষা গড়িয়া লইয়াছিলেন। তিনি অলঙ্কারের বোঝা চাপাইয়া ভাষাকে অস্বাভাবিক উজ্জ্বলতা দেবার চেষ্টা করিতেন না; কিন্তু শব্দগুলিকে বিশেষ বিবেচনার সহিত বাছিয়া লইয়া কোথায় কোনটি বসিলে ভাল মানাইবে, তাহা স্থির করিয়া ও গাঁথনির দৃঢ়তার দিকে নজর রাখিয়া তিনি যত্নের সহিত শব্দের মালা গাঁথিতেন। কাজেই তাঁহার ভাষা কারিগরের হাতের অপূর্ব কারুকার্য হইয়া দাঁড়াইয়াছিল।"
রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই ভ্রাতুষ্পুত্রটিকে বিশেষ পছন্দ করতেন, ভরসাও করতেন। পত্রিকা পরিচালনা বা ব্যবসা নানা ব্যাপারেই তিনি ‘বলু’-র ওপর অনেকটা নির্ভর করতেন। সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথের সর্বগ্রাসী প্রভাব সে সময়ের বাকি সাহিত্য-চর্চাকারীদের মতো তাঁকেও প্রভাবিত করেছিল। উপরি পাওনা হিসেবে পারিবারিক সম্পর্কের খাতিরে রবীন্দ্রনাথের স্নেহময় সান্নিধ্য পাবার সৌভাগ্যও তাঁর হয়েছিল। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ তাঁর ‘পিতৃস্মৃতি’ গ্রন্থে জানাচ্ছেন, “বলুদাদাকে বাবাও অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তাঁর সাহিত্যচর্চার একনিষ্ঠতা দেখে বাবার খুব ভালো লাগত।… বলুদাদার যখনই কোনো প্রবন্ধ লেখা শেষ হত বাবাকে দেখাতে নিয়ে আসতেন। ভাব ও ভাষা দুদিক থেকেই তন্ন তন্ন করে বিচার করে বাবা তাঁকে বুঝিয়ে দিতেন কি করে বিষয়টি লিখতে হবে। বলুদাদা পুনরায় লিখে নিয়ে এলে যে-দোষত্রুটি বাবার তখনো চোখে পড়ত সেগুলি সংশোধন করে নিয়ে আসতে বলতেন। যতক্ষণ-না সম্পূর্ণ মনঃপূত হত, বাবা ছাড়তেন না, বলুদাদাও অসীম ধৈর্য সহকারে লেখাটি বারবার অদলবদল করে নিয়ে আসতেন। এইরকম কঠোর শিক্ষার ফলে বলুদাদার লেখার মধ্যে ভাব ও ভাষার আশ্চর্য বাঁধুনি দেখতে পাওয়া যায় – না আছে একটুও অতিরঞ্জন, না আছে অনাবশ্যক একটি কথা।”
আরও পড়ুন - “ভালোবাসা! তুমি এখন কেমন আছো!” : শতবর্ষে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
সাহিত্য-চর্চার বাইরেও বহুধাবিস্তৃত ছিল বলেন্দ্রনাথের কাজের পরিধি। এখনকার ভাষায় যাকে ‘অন্ত্রপ্রণর’ (Entrepreneur) বলে, বলেন্দ্রনাথের কর্মোদ্যোগ ছিল সেই প্রকৃতির। বিপুল প্রাণশক্তি ছিল তাঁর। সঙ্গে ছিল কাজের নেশা। নিছক ব্যবসা-বুদ্ধি না, তাঁর মধ্যে ছিল বৃহত্তর গঠনমূলক ভাবনাচিন্তা। নিজের উদ্যোগে তিনি স্বদেশী কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেছিলেন, যাতে রবীন্দ্রনাথ ও সুরেন্দ্রনাথ যুক্ত ছিলেন। শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মবিদ্যালয়ের সার্বিক পরিকল্পনায় বলেন্দ্রনাথেরও মস্তিষ্ক ছিল। ব্রহ্মবিদ্যালয়ের খসড়া নিয়মাবলী তিনিই প্রণয়ন করেছিলেন। কিন্তু তার রূপায়ণ শেষপর্যন্ত দেখে যেতে পারেননি তিনি। ছাব্বিশ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়েছিল সাহানা দেবীর সঙ্গে। জীবনের শেষদিকে বলেন্দ্রনাথ পঞ্জাবের আর্যসমাজের সঙ্গে ব্রাহ্মসমাজের যোগাযোগ স্থাপনে সচেষ্ট হয়েছিলেন, তার জন্য প্রভূত পরিশ্রমও করছিলেন। সাহিত্যরচনার পাশাপাশি এই নানাবিধ বিচিত্র ও পাহাড়প্রমাণ কর্মোদ্যোগের পরিশ্রমের কারণে স্নানাহারের অনিয়ম ছিল রোজকার ব্যাপার। সব মিলিয়েই ভেঙে পড়ছিল তাঁর শরীর। কিন্তু সেই নিয়ে তিনি সচেতন হননি। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২০ আগস্ট মাত্র উনত্রিশ বছর বয়সে তাঁর অকালমৃত্যু ঘটে। এ বছর প্রায় নীরবেই সার্ধশতবর্ষে পা দিলেন তিনি। এই বিরল অস্ফুট প্রতিভাকে নিয়ে যতটা আলোচনা হবার কথা ছিল, ততটা হল না বোধহয়।
ঋণ : ১) প্রশান্তকুমার পাল/ রবিজীবনী (প্রথম, তৃতীয় ও চতুর্থ খণ্ড)
২) রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী / চরিত কথা
৩) প্রফুল্লময়ী দেবী / স্মৃতিকথা
৪) রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর / পিতৃস্মৃতি
৫) শোভন সোম / রবীন্দ্রনাথ ও বলেন্দ্রনাথ
#বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর #সার্ধশতবর্ষ #শ্রদ্ধা #ঠাকুর পরিবার #রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর #বীরেন্দ্রনাথ ঠাকুর #প্রফুল্লময়ী দেবী #সাহানা দেবী #শান্তিনিকেতন #ব্রহ্মবিদ্যালয় #টিম সিলি পয়েন্ট