বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

স্ত্রী-র আত্মহনন, মারণ গ্যাস ও এক নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী

সিদ্ধার্থ মজুমদার June 29, 2021 at 4:50 am বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

১৮৮০-এর শেষের দিক; ইউরোপে উচ্চশিক্ষার জগতে মেয়েদের পা রাখতে হলে সে সময় প্রচুর বাধার সম্মুখীন হতে হত। বাধা শুধু উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রেই নয়, স্কুল কলেজে পড়ার ক্ষেত্রেও। যদিও বা সে বাধা অতিক্রম করে কোনও মেয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছে, নানান বৈষম্যমূলক এবং মানহানিকর পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছে তাকে। এই পরিস্থিতি আরও ভালো করে বোঝা যাবে ওই সময়ের একজন বিশ্ববন্দিত পদার্থবিজ্ঞানীর বক্তব্য থেকে। তিনি বলছেন, “প্রকৃতি-মাতা নিজেই নারীদের ভূমিকা নির্দিষ্ট করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। নারীর ভূমিকা হবে মাতৃত্ব এবং গৃহিণী”। অন্য কেউ নন, একথা বলছেন স্বনামধন্য বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক। পরবর্তীকালে জানা গেছে, ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক তাঁর গবেষণার কাজে কোনও ছাত্রী নিতেন না। ১৯১২ সালে প্রথম লিজে মাইটনারকে শর্ত সাপেক্ষে অনুমতি দিয়েছিলেন, তাঁর ক্লাসে শুধু শ্রোতা হিসেবে বসতে পারার জন্যে।

অনেকটা এই রকমই পরিস্থিতির মধ্যে দিয়েই যেতে হয়েছে ক্লারা নামের জার্মান-ইহুদি মেয়েটিকে। অজস্র প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে হয়েছে।

কে এই ক্লারা? ক্লারা ইমেরহ্যার, কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি-প্রাপ্ত প্রথম জার্মান মহিলা। এটুকু বললে অবশ্য কিছুই বলা হয় না। মেধা ও যোগ্যতার নিরিখে যে সুযোগ বা সম্মান তাঁর প্রাপ্য ছিল, তার ছিটেফোঁটাও কপালে জোটেনি। সমসাময়িক আরেক প্রতিভা, মেরি কুরি, যেমন অনুকূল সাহচর্যে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়েছেন, ক্লারার ক্ষেত্রে হয়েছে ঠিক এর উল্টো। তাঁর নিজস্ব মেধা, যোগ্যতা, স্বপ্ন, কল্পনা – বিয়ের পর থেকে সব কিছু সংকুচিত হতে হতে সীমাবদ্ধ হয়েছে কেবলমাত্র ‘একজন খ্যাতনামা রসায়নবিদের স্ত্রী’ হিসেবে।

জার্মানির ব্রেসলউ শহরে (তদানীন্তন প্রুশিয়া বর্তমান পোলান্ড) ক্লারার জন্ম। বাবাও ছিলেন রসায়ন বিজ্ঞানে ডক্টরেট, একটি কেমিক্যাল কোম্পানির অধিকর্তা। ক্লারার মায়ের ছিল জামা কাপড়ের বেশ বড়ো ব্যবসা। ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের একটি মহিলাদের শিক্ষালয়ে একজন শিক্ষিকার অধীনে থেকে শুরু হল ক্লারার শিক্ষা। সেখানকার পাঠ শেষ করে ক্লারা গভর্নেসের এবং গৃহশিক্ষকতার কাজ নিলেন। পাশাপাশি ইউনিভার্সিটিতে ঢোকার জন্যে প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। কৃতিত্বের সঙ্গে সে পরীক্ষায় পাশ করলেও, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসগুলিতে কেবলমাত্র উপস্থিত থেকে শুনতে পাওয়ার অনুমতি পেলেন। পরে প্রি-ডক্টর‍্যাল স্তরের পরীক্ষায় বসলেন এবং সে পরীক্ষাতেও সাফল্যের সঙ্গে পাশ করলেন। ১৯০০ সালের ডিসেম্বরে ব্রেসলউ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রিতে ডঃ রিচার্ড অ্যাবেগের অধীনে ডক্টরাল ডিগ্রি পেলেন ক্লারা। অ্যাবেগের সঙ্গে এবং এককভাবে ক্লারা বেশ কয়েকটি উচ্চমানের গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। 

এরপরের অধ্যায় ১৯০১ সালে, দু’বছরের বড়ো রসায়নবিদ ফ্রিৎজ হেবারের (১৮৬৮-১৯৩৪) সঙ্গে একটি কনফারেন্সে গিয়ে আলাপ পরিচয় হল ক্লারার। যদিও এর আগে ক্লারা যখন স্কুলে পড়ে, তখন তাঁর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন হেবার। তারপর তাঁদের দুজনের দেখা হয় ওই বিজ্ঞান কনফারেন্সে, সেখান থেকেই প্রেম এবং বিয়ে। যোগ্যতা থাকলেও মেয়েদের পক্ষে স্বাধীনভাবে গবেষণা বা পড়ানোর সুযোগ পাওয়া যে খুবই কঠিন, ক্লারা তা ভালোই জানতেন। স্বাভাবিকভাবেই তিনি ভেবেছিলেন যে হবু স্বামী নিজে যেহেতু রসায়ন বিজ্ঞানের সঙ্গে জড়িত, তাই কিছু না-হলেও অন্তত স্বামীর সঙ্গে গবেষণার কাজ করার ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা হবে না।  

ক্লারার ভাবনার সঙ্গে বাস্তব বিন্দুমাত্র মিলল না। কী করেই বা মিলবে? হেবার একেবারেই চাননি ক্লারা ঘরের যাবতীয় কাজকর্ম ছেড়ে গবেষণাগারে যাক। বিয়ের পরে কয়েক মাস যেতেই হেবারকে জানিয়েও ছিলেন ক্লারা তাঁর রসায়ানাগারে ফেরার কথা। ক্লারার প্রস্তাবে হেবার জবাব দিয়েছিলেন, “যখন আমাদের হাতে লক্ষ লক্ষ টাকা হবে, যখন বাড়িতে কয়েকজন কাজের লোক রাখতে পারার মতন সাচ্ছল্য হবে আমাদের, তখন তুমি ঘরের বাইরে গিয়ে কিছু করার কথা ভাবতে পারো। তাছাড়া, আমি তো আমার বিজ্ঞানের কাজ জলাঞ্জলি দেওয়ার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারি না”।   

মেয়েদের সম্পর্কে কেমন ধারণা পোষণ করতেন হেবার, তা তাঁর কথা থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিয়ের আগে এক বন্ধুকে তিনি বলেছিলেন, “...[they] are like butterflies to me. I admire their colors and glitter, but I get no further”। 

এই উক্তির পরে জীবনের আর কীই বা বাকি থাকে! বিয়ের এক বছরের মধ্যেই ছেলে হারম্যানের জন্ম। সন্তানসম্ভবা ক্লারাকে ভুগতে হয়েছিল মাতৃত্বজনিত জটিলতায়। এরপর রুগ্ন সন্তানের দেখাশোনা করা, বাড়ির সব কাজকর্ম সামলানো, হেবার বাড়ি ফিরলে কিংবা স্বামীর কোনও বন্ধুবান্ধব এলে তাঁদের খাবার করে দেওয়া – এইসব করতেই সকাল থেকে রাত্রি কেটে যেত ক্লারার। রসায়নের সঙ্গে সম্পর্ক বলতে ছিল স্বামীর কয়েকটি গবেষণাপত্র ইংরেজিতে অনুবাদ করে দেওয়ার কাজ, কোনোরকম স্বীকৃতি ছাড়াই।   

আরও কয়েক বছর পরের কথা। ফ্রিৎজ হেবার তখন খ্যাতনামা রসায়নবিদ, অ্যামোনিয়া তৈরি করার পদ্ধতি আবিষ্কারে তাঁর সাফল্য অভাবনীয়। একশো পঁচিশ বছর আগে জানা গেছে, অ্যামোনিয়াতে এক পরমাণু নাইট্রোজেন এবং তিন পরমাণু হাইড্রোজেন আছে। কিন্তু তারপর থেকে পৃথিবীর অনেক নামজাদা রসায়নবিদ চেষ্টা করেছেন কী ভাবে রসায়নাগারে হাইড্রোজেন ও নাট্রোজেন থেকে অ্যামোনিয়া সংশ্লেষণ পদ্ধতি আবিষ্কার করা যায়, কিন্তু কেউই সক্ষম হননি। এমনকি ব্যর্থ হয়েছেন আরেক নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী অসওয়াল্ড। বিক্রিয়ার শর্ত পরিবর্তন করে এবং যথাযথ অনুঘটক ব্যবহার করে মেধাবী ভৌতরসায়নবিদ হেবার ১৯১০ সালে সফল হলেন সেই কাজে। ‘হেবার পদ্ধতি’তে অ্যামোনিয়া উৎপাদন আবিষ্কারের জন্যে হেবার চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। উদ্ভিদের পক্ষে অপরিহার্য পুষ্টি হল নাইট্রোজেন, কিন্তু উদ্ভিদজগত বায়ুমণ্ডল থেকে সরাসরি গ্যাসীয় নাইট্রোজেন গ্রহণে অক্ষম। হেবার-বশ পদ্ধতিতে অ্যামোনিয়াম সালফেট উৎপাদন সারা বিশ্বে কৃষি জগতে এক যুগান্তকারী সাফল্য। উৎপাদিত হল নাইট্রোজেন-ঘটিত সার যা কৃষিক্ষেত্রে জোয়ার নিয়ে এল। মানুষ অনিবার্য খাদ্য সংকট থেকে মুক্তি পেল। এই কাজের সাফল্য হেবারকে তৎকালীন জার্মান বিজ্ঞানের একদম প্রথম সারিতে জায়গা করে দিল, কয়েক বছরের ব্যবধানেই নোবেল পুরস্কার পাবেন তিনি। এতকিছুর মধ্যে হেবার জড়িয়ে পড়েছেন এক মারণ খেলায়। তিনি এখন যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুদের মারার জন্যে বিষাক্ত রাসায়নিক গ্যাস তৈরি করার গবেষণায় ব্যস্ত। নিজে ইহুদি হওয়ায় দেশপ্রেমিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হেবার জার্মানিকে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। তাই শত্রুপক্ষের সেনাদের বিষাক্ত গ্যাস অস্ত্রে হত্যা করার চেষ্টায় নিয়োজিত করেছিলেন নিজেকে।




ক্লারা বরাবরই ছিলেন শান্তি ও মহিলাদের অধিকার সুরক্ষার একজন সক্রিয় কর্মী। বস্তুত, হেবারের এই কাজের কথা আঁচ করতে পেরে তিনি বারণ করেছিলেন স্বামীকে। বলেছিলেন এ কাজ বিজ্ঞানীর নয়, এ হল “perversion of the ideals of science” এবং “ a sign of barbarity, corrupting the very discipline which ought to bring new insights into life”। বাড়িতে স্বামীর সহকর্মী বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনায় ক্লারা বুঝতে পারছিলেন তাঁর স্বামীর সাধনা আর মানবকল্যাণে নিয়োজিত নেই। বুঝতে পারছিলেন যুদ্ধের নামে গণহত্যার বীভৎসতার মূল নায়ক ফ্রিৎজ হেবার। এই নিদারুণ যন্ত্রণা ক্লারা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না।

১৯১৫ সাল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে, ছেলের বয়স তখন তেরো বছর। ১লা মে হেবারের বাড়িতে অতিথি-অভ্যাগতরা এসেছেন, তাদের অনেকেই সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্তা। দিন কয়েক আগেই হেবার উদ্ভাবিত বিষাক্ত ক্লোরিন গ্যাস আক্রমণের প্রথম সাফল্য এসেছে, যার জন্যে হেবারকে ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত করা হয়েছে। প্রায় দশ হাজার ফ্রেঞ্চ সেনানী ক্লোরিন গ্যাসের বিষাক্ত ধোঁয়ায় লুটিয়ে পড়েছে, কাশতে কাশতে যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে মারা যাচ্ছে। জার্মান সেনা, হেবার – সবার জন্য সে এক উদযাপনের মুহূর্ত। 

মধ্য রাত্রি পেরিয়ে গেছে। পার্টি ভেঙ্গেছে অনেক আগেই, হেবার তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। স্বামীর সার্ভিস পিস্তলটি নিয়ে ক্লারা ধীর পায়ে বাগানের দিকে এগিয়ে গেলেন। তারপর ট্রিগারে একটা চাপ দিয়ে অনুশোচনায় দগ্ধ জীবন শেষ করে দিলেন। মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে ক্লারা হারিয়ে গেলেন। যাদের জীবন হতে পারত পিয়ের আর মেরি কুরির মতন সাফল্যোজ্জ্বল, তাদের দাম্পত্য পড়ে রইল ঘাসের উপর। নিথর, নিঃস্পন্দ।  

আরও পড়ুন : “I DIED FOR BEAUTY” – সুন্দরের খোঁজে এক বিস্মৃত গণিতজ্ঞ / সিদ্ধার্থ মজুমদার

সকালে উঠেই হেবার খবর পেলেন ক্লারার আত্মঘাতী হওয়ার। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে ক্লোরিন গ্যাস সংক্রান্ত পরীক্ষার মাঝে এসব ছন্দপতন একেবারেই প্রশ্রয়যোগ্য নয়। অবিচল হেবার বেরিয়ে গেলেন বাড়ি থেকে। ক্লারার দেহ পড়ে থাকল বাগানে। খবরের কাগজে লেখা হল অজানা কারণে মৃত্যু হয়েছে দেশের কৃতী বিজ্ঞানীর স্ত্রী’র। কীর্তি ও সুনাম বজায় রাখা হল জার্মানির নায়কের। না ছিল কোনো সুইসাইড নোট, না হয়েছিল ক্লারার দেহের পোস্ট-মর্টেম। মৃত্যুর চার দশক পরে ক্লারার লেখা চিঠিপত্র এবং পরিচিত কয়েকজনের থেকে জীবনীকাররা জেনেছেন আরও বহু অজানা ইতিহাস। যার প্রতিটি অক্ষরে লেখা আছে ক্লারার হতাশা আর যন্ত্রণা আর কান্না, অন্যদিকে হেবারের অমানবিক ভয়ংকর রূপ। 

আরও পড়ুন : হেডি ল্যামার: একই অঙ্গে ‘মাদার অফ ওয়াই-ফাই’ আর ‘বম্বশেল’ অভিনেত্রী / অর্পণ পাল

গত বছর আমরা পেরিয়ে এসেছি ক্লারা ইমেরহ্যার হেবারের (১৮৭০-১৯১৫) জন্মের ১৫০ বছর, এই কদিন আগে ২১শে জুন পেরিয়ে এলাম তাঁর জন্মদিন। পিতৃতন্ত্রের শেকল আর পাশবিক বিজ্ঞানচর্চার বিরুদ্ধে ক্লারার নিরুচ্চার প্রতিবাদকে যেন তাঁর জন্মদিনের মতোই আমরা ভুলে না যাই! 

................................................
#সিলি পয়েন্ট #web portal #ওয়েবজিন #বিজ্ঞান #Fritz Haber #Clara Helene Immerwahr #ফ্রিৎজ হেবার #ক্লারা ইমেরহ্যার #সিদ্ধার্থ মজুমদার

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

18

Unique Visitors

183965