বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

হেডি ল্যামার: একই অঙ্গে ‘মাদার অফ ওয়াই-ফাই’ আর ‘বম্বশেল’ অভিনেত্রী

অর্পণ পাল June 8, 2021 at 4:39 am বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

অসাধারণ সুন্দরী বললেও কম বলা হয় তাঁকে। তিরিশ-চল্লিশের দশকে প্লাস্টিক সার্জারি করতে এগিয়ে আসতেন যে সব সুন্দরী-হতে-চাওয়া মহিলারা, তাঁদের অধিকাংশই চাইতেন তাঁর মতো মুখের আদল। একাধিক সিনেমায় অভিনয় করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন যুবসমাজের চোখের মণি। অন্তত দুটো পুতুলের মুখের গড়ন বানানো হয়েছিল তাঁর মতো করে— স্নো হোয়াইট আর ক্যাট-ওম্যান। এমজিএম প্রযোজনা সংস্থা তাঁকে আখ্যা দিয়েছিল ‘দ্য মোস্ট বিউটিফুল ওম্যান ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’।

এ তো সাফল্যের একটা দিক। অন্যদিকে ব্যক্তি-জীবনে তিনি প্রবল অসুখী, বিয়ে-থা করে সুন্দর জীবন কাটানোর স্বপ্ন অধরাই থেকে গিয়েছিল তাঁর কাছে। গত যুগের বিস্মৃতপ্রায় অভিনেত্রী হেডি ল্যামার-এর জীবন, রোমাঞ্চকর উপন্যাসের কোনও নায়িকা-চরিত্রের মতোই বহুমুখী এবং বিতর্কে ভরা। ঘন-কালো চুলের গোছা, উজ্জ্বল শুভ্র মুখশ্রী আর তীক্ষ্ণ সবুজ দুটো চোখে ছিল এক অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। নিজেই বলতেন বাহ্যিক সৌন্দর্য দিয়ে বিচার করা উচিত নয় মানুষকে, অথচ মাঝবয়সে পৌঁছে নিজেই প্লাস্টিক সার্জারি করে মুখের জ্যামিতি বদলেছিলেন একাধিকবার।

আবার এই দুটো দিকের পাশাপাশি আরও একটা দিক আছে, যেখানেও তিনি অনন্যা। সৌন্দর্যের পাশাপাশি বুদ্ধি আর মেধার আশ্চর্য মিশেল ছিল তাঁর মধ্যে। এরই প্রকাশ ঘটেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, যখন তিনি এমন এক ব্যবস্থা বানিয়েছিলেন যেটার ওপর ভিত্তি করে পরে গড়ে ওঠে আজকের দিনের চেনা এক প্রযুক্তি— ওয়াইফাই ব্যবস্থা। এরই পাশাপাশি ব্লুটুথ বা জিপিএস— এই সবকিছুরই মূল কথা বিনা তারে তথ্য-বার্তা চলাচলের ব্যবস্থা। আজ আমরা অহরহ যা দেখছি মোবাইল যন্ত্রের সীমানায়।

হেডি ল্যামারের জন্ম ১৯১৪-য়, অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায়। আসল নাম তাঁর যদিও হেডউইগ কিয়েসলার। ছোট থেকেই তিনি ভালোবাসতেন যন্ত্রের কারিকুরি। বাড়িতে যে যন্ত্র পেতেন, খুলে আবার জুড়ে ফেলতেন। কিন্তু প্রথাগত পড়াশুনো বেশিদূর করেননি, অল্প বয়সেই প্রথম বিয়েটা সেরে ফেলেন বয়সে বেশ কিছুটা বড় এবং ধনী এক যুদ্ধাস্ত্র-নির্মাতার সঙ্গে, তাঁরই সূত্রে হেডির বিভিন্ন আধুনিক অস্ত্র সম্বন্ধে জ্ঞান জন্মায়। এছাড়া তাঁদের বাড়িতে নিয়মিত ঝলমলে সব পার্টি হত, যেখানে আসতেন সে আমলের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা, বিজ্ঞানীরাও। তাঁদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয়ের মধ্যে দিয়ে ল্যামার পরিচিত হন তখনকার ইউরোপের অর্থনীতি বা রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গেও। তবে দুঃখের বিষয়, তাঁদের দাম্পত্যজীবন তাঁর পরবর্তী আরও বিয়েগুলোর মতোই, শান্তিপ্রদায়ী হয়নি। স্ত্রী সিনেমায় অভিনয় করুন, এটা একেবারেই মেনে নিতে পারতেন না তাঁর স্বামী, যা থেকে অশান্তির সূত্রপাত।

খুব স্বাভাবিকভাবেই হেডির প্রখর সৌন্দর্য প্রকাশ পেয়েছিল চলচ্চিত্রের রূপালি পর্দায়। সিনেমায় নামার আগেই তিনি নিজের নাম হেডউইগ থেকে ছোট করে হেডি করে নেন। জার্মান, চেক বা অস্ট্রিয়ান কিছু সিনেমায় অভিনয় করবার পর ১৯৩৭ সালে তিনি আমেরিকায় চলে যান এবং সেখানে মেট্রো-গোল্ডউইন-মেয়ারের হয়ে সিনেমায় অভিনয়ের চুক্তি করবার সময় তাঁদেরই পরামর্শে কিয়েসলার পাল্টে পদবি ল্যামার করে নেন। এই পদবিটি নেওয়া হয়েছিল নির্বাক যুগের এক খল-অভিনেত্রী বারবারা লা মার-এর নাম থেকে। হলিউডেই তাঁর খ্যাতি সর্বোচ্চ উচ্চতায় ওঠে।

এমজিএম-এর পাশাপাশি ইউরোপীয় সিনেমাতেও একই সময় অভিনয় করতেন ল্যামার আর সেখানেই প্রথমবার দেখা গেল তাঁর প্রখর রূপের বহিঃপ্রকাশ। ১৯৩৩ সালের ‘একস্ট্যাসি’ (Ecstasy) সিনেমায় অল্পবয়সী এক গৃহবধুর অবৈধ প্রেম আর নগ্নতাকে এক অন্য মোড়কে প্রকাশ করলেন হেডি, যা জন্ম দিল নতুন বিতর্কের। আমেরিকায় এই সিনেমা নিষিদ্ধ হল, অথচ গোপনে গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল ওই ছবি। পরে তিনি ‘জিগফিল্ড গার্ল’, ‘স্যামসন এন্ড ডেলিলা’র মতো হলিউডের আরও বেশ কিছু সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন, কিন্তু ওই ‘এস্ট্যাসি’র মতো বিতর্ক আর কিছুতেই হয়নি।

সিনেমায় অভিনয়ের সময়কালেই, অবসর পেলেই হেডি সময় কাটাতে ভালোবাসতেন যন্ত্রপাতি নিয়ে। যুদ্ধের সময় শত্রুপক্ষ যাতে কব্জা করতে না পারে এমন মিসাইলকে সুরক্ষিত করবার এক ব্যবস্থা উদ্ভাবন করেছিলেন তিনি। তাঁর তৈরি ওই ‘রেডিও-ফ্রিকোয়েন্সি ট্রান্সমিটার’ যন্ত্র দিয়ে চালিত করা এই মিসাইল বা টরপেডো জলের মধ্যে দিয়ে আঘাত হানতে পারত শত্রুর ঘাঁটিতে, আর একে চালনা করা যেত রেডিও-কম্পাঙ্কের তরঙ্গকে কাজে লাগিয়ে।

হেডি ল্যামার যে ব্যবস্থার জন্ম দিয়েছিলেন, সেটার পরিভাষাগত নাম ‘ফ্রিকোয়েন্সি হপিং স্প্রেড স্পেক্ট্রাম’ টেকনিক। রেডিও কম্পাঙ্কে থাকা তরঙ্গের মধ্যে মিশে থাকা একাধিক কম্পাঙ্কের তরঙ্গের মধ্যে থেকে দরকারিটুকু ছেঁকে নিয়ে তা থেকে বার্তা পড়ে নেওয়ার এ এক ব্যবস্থা, যাতে কোনও তৃতীয়পক্ষ ওই তরঙ্গকে আটকে দিলেও বুঝে ফেলতে না পারে। তিনি এবং তাঁর এক আমেরিকান বন্ধু জর্জ অ্যান্থেইল (এই পিয়ানোবাদক পরিচিত ছিলেন ‘দ্য ব্যাড বয় অফ মিউজিক’ নামে) মিলে এই ব্যবস্থার ডিজাইন তৈরি করেন। প্রেরক আর গ্রাহক দুই প্রান্তের মধ্যে কোনও বার্তা পাঠানোর জন্য একটি চ্যানেল বা পথ না বানিয়ে একাধিক পথ তৈরি করার এই ব্যবস্থায় প্রেরক আর গ্রাহক দু’পক্ষেরই আগে থেকে জানা থাকত কোন কোন চ্যানেল বার্তা-প্রেরণের জন্য কাজে লাগানো হবে, তাহলে তৃতীয়পক্ষ কোনোভাবেই সেই বার্তা মাঝপথে চুরি করে নিতে পারবে না। এটাই তাঁদের আবিষ্কারের মূল নীতি। অনেকটা পিয়ানোর চাবির সজ্জার ধাঁচে এই ব্যবস্থায় তাঁরা ৮৮টা চ্যানেল ব্যবহার করেছিলেন।

এটা চল্লিশের দশকের ঘটনা। তখন পুরোদমে চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ল্যামার তাঁর এই আবিষ্কারের পেটেন্ট নিতে ভুল করেননি; ১১ই আগস্ট ১৯৪২-এ পেটেন্ট লাভ করেন, আর তারপরেই তিনি এই পুরো ব্যবস্থাকে আমেরিকাকে দান করেন, নাৎসি-বাহিনিকে কব্জা করতে যদি কাজে লাগে। এই পেটেন্টে প্রাপক হিসেবে ছিল তাঁর তখনকার নাম হেডি কিয়েসলার মার্কি, দ্বিতীয় স্বামীর পদবি মার্কি। কিন্তু তাঁর দুর্ভাগ্য, নৌসেনাদলের কর্মকর্তারা এই আবিষ্কারের গুরুত্ব বুঝতে পারেননি। অথবা তাঁর মতো এক সুন্দরী যে সত্যি সত্যিই তাঁদের কাজে লাগতে পারে এমন কিছু আবিষ্কার করে ফেলতে পারেন এ তাঁরা বিশ্বাসই করতে পারেননি। তাঁরা ল্যামারকে ফিরিয়ে দেন। গোটা বিশ্বযুদ্ধপর্বে তাঁর আবিষ্কার পড়ে থাকে অবহেলিত হয়ে। পরে বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে আরও বেশ কয়েক বছর বাদে ১৯৬২ সালে এই ব্যবস্থা প্রথমবার ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এই ব্যবস্থার সঙ্গে ওয়াইফাইয়ের কী সম্পর্ক? হ্যাঁ সম্পর্ক আছে। প্রথম যুগের ওয়াইফাই ব্যবস্থার মূল তত্ত্বই ছিল এই রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি হপিং টেকনিক। ১৯৯৭ থেকে ১৯৯৯ সালের মধ্যে যত ওয়াইফাই রেডিও তৈরি হয়েছিল, সেসবই এই টেকনিকের ওপর নির্ভরশীল ছিল।

ল্যামার সারা জীবন তাঁর এই বিশেষ গুণকে কখনওই জাহির করেননি। তবে কারমেলো আমারিনা নামে এক উদ্ভাবক তাঁর জীবনের শেষের দিকে তাঁর এক সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় টের পেয়েছিলেন ল্যামারের মধ্যে থাকা উদ্ভাবনীশক্তিকে। আর স্বীকৃতি? সেটাও তিনি পেয়েছিলেন, তবে বড্ড দেরী করে। জীবনের তিরাশিতম বছরে ১৯৯৭ সালে ইলেকট্রনিক ফ্রন্টিয়ার ফাউণ্ডেশন তাঁকে সম্মান প্রদান করে। কিন্তু তখন তাঁর শারীরিক অবস্থা এমন ছিল না যাতে নিজে গিয়ে সম্মান গ্রহণ করতে পারেন। বাড়িতে বসে তিনি একটি ধন্যবাদসূচক অডিও রেকর্ড করে পাঠিয়েছিলেন।

মোটামুটি মৃত্যুর পর থেকেই ল্যামার আলোচনায় উঠে আসতে শুরু করেন। তাঁকে নিয়ে নাটক তৈরি হয়, ‘ডিসকভারি’ আর ‘সায়েন্স’ চ্যানেলে তাঁকে নিয়ে শো দেখানো হয়, গুগল ডুডল-এ উঠে আসেন তিনি। আলেক্সান্দ্রা ডিন নামে এক পরিচালক বছর কয়েক আগে তাঁকে নিয়ে এক তথ্যচিত্র বানিয়েছিলেন ‘বম্বশেল: দ্য হেডি ল্যামার স্টোরি’ নামে। এখানেই তাঁর এই বিশেষ গুণটির কথা বহুদিন পর সকলের সামনে আসে। ২০১১ সালে বিখ্যাত বিজ্ঞান-সাহিত্যিক রিচার্ড রোডস লিখেছেন এক অসামান্য বই ‘হেডি’স ফলি: দ্য লাইফ এন্ড ব্রেকথ্রু ইনভেনশনস অফ হেডি ল্যামার, দ্য মোস্ট বিউটিফুল ওম্যান ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’, সেখানেও ধরা রয়েছে ল্যামারের জীবনের খুঁটিনাটি। বিস্মৃতির ধুলো সরিয়ে এঁরা আমাদের সামনে হাজির করেন হারিয়ে যাওয়া সোনালি যুগের এক অসাধারণ অভিনেত্রীকে, রূপের পাশাপাশি যার মধ্যে আশ্চর্য মিশেল ঘটেছিল গুণেরও। যিনি নিজের সৌন্দর্য সম্বন্ধে সচেতন হয়েও বলতে পেরেছিলেন: ‘Any girl can be glamorous, all you have to do is stand still and look stupid.’

আরও পড়ুন : গোটা একটা নক্ষত্র সম্প্রদায় আবিষ্কার করেও নোবেল-উপেক্ষিতা জোসেলিন বার্নেল / অর্পণ পাল


..........................................

#সিলি পয়েন্ট #ওয়েব পোর্টাল #Web Portal #বিজ্ঞান #প্রযুক্তি #Science and Technology #Hedy Lamarr #Actress #Scientist #Wifi #অর্পণ পাল #silly point

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

44

Unique Visitors

219187