বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

আশ্চর্যের নাম প্লাস্টিক

অনিন্দ্য পাল Sep 21, 2021 at 3:51 am বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

১৮৬৯ সাল। পৃথিবীর ইতিহাসে ঘটে গেল একটা অন্যরকম বিপ্লব। সেই বিপ্লবের নেপথ্যে কোনো বোমা-গুলি-বন্দুক, সিংহাসনের টানাপোড়েন ছিল না। ছিল না কোনো রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। তবুও সেই বিপ্লবের ফলে একদল সর্বগ্রাসী জীবের আগ্রাসন থেকে রক্ষা পেয়েছিল অনেক নিরপরাধ এবং অবলা প্রাণ। এই সর্বগ্রাসী জীব কারা? হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, মানুষ। আর যারা বেঁচে গেল, কিছুটা হলেও যাদের অনবরত খুন হয়ে যাওয়া বন্ধ হল, তারা কারা? তারা সেই সবুজ উদ্ভিদ আর বন্যপ্রাণী। তবে এর মধ্যেও, তাৎক্ষণিক ভাবে সেই সময় লাভবান হয়েছিল হাতি। ব্যাপারটা তাহলে খুলেই বলা যাক।

সেই সময় বিলিয়ার্ড খেলার যথেষ্ট প্রচলন ছিল ইউরোপের অভিজাত মহলে। হঠাৎ হল কী, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে শুধু ইউরোপ নয়, অন্যান্য দেশেও বিলিয়ার্ড বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠলো। আর যত এর জনপ্রিয়তা বাড়ল, ততই খুন হতে লাগল বন্য দাঁতাল হাতি। কেন? কারণ বিলিয়ার্ড খেলা হত আসলে আইভরি বল দিয়ে। মানে সেই বল বানানো হত হাতির দাঁত দিয়ে! আর হাতির দাঁত পাওয়ার জন্য হাতি হত্যা করতেই হত। একটা সময় এমন দাঁড়াল যে অসংখ্য হাতি মেরেও বলের ঠিকঠাক যোগান দেওয়া গেল না। সেই পরিস্থিতিতে নিউইয়র্কের এক ব্যবসায়িক সংস্থা ‘দ্য নিউইয়র্ক বিলিয়ার্ড কোম্পানি’ ঘোষনা করল, যদি কেউ এই আইভরির যথাযথ বিকল্প কিছু তৈরি করতে পারে, তাকে তাদের পক্ষ থেকে ১০০০০ ডলার পুরস্কার দেওয়া হবে। সেই সময় জন ওয়েসলে হায়াৎ নামে এক ছাপাখানা কর্মী ঠিক এই জিনিসটা নিয়েই কাজ করছিলেন, সঙ্গে ছিলেন তাঁর ভাই ইসাইয়া হায়াৎ। এই পুরস্কারের বিজ্ঞাপন ওয়েসলে হায়াৎ-কে উৎসাহিত করে তুলল। তিনি আরো গভীর মনোযোগের সাথে এই বিকল্প পদার্থের খোঁজে মেতে উঠলেন। এই গবেষণা চলতে চলতেই এমন একটা ঘটনা ঘটল যাতে এই বিকল্প আবিষ্কারের পথ আরো মসৃণ হয়ে গেল। একদিন হঠাৎ ওয়েসলে হায়াৎ-এর হাত থেকে একটা কলোডিওন ভর্তি বোতল পড়ে গেল মেঝেতে। বোতল ভেঙে মেঝেতে ছড়িয়ে পড়লো সেই কলোডিওন। আর কয়েক মুহূর্ত পর, হায়াৎ অবাক হয়ে দেখলেন যে সেই ছড়ানো কলোডিওন জমাট বেঁধে বেশ শক্ত আর রবারের মত এক পদার্থ তৈরি হল। হায়াৎ এই পদার্থটি দিয়েই বানালেন বিলিয়ার্ড বল। তবে সেই বল খুব একটা কাজের হল না। আসলে সমস্যাটা হল, বিলিয়ার্ড খেলার সময় এই বলগুলো ঠোকাঠুকি হলেই ফেটে যেত। সাময়িক এই ব্যর্থতা আর হতাশাতেও হায়াৎ দমে গেলেন না। তিনি গবেষণা চালাতে লাগলেন নিজের মত করে এবং কিছুদিনের মধ্যেই এই সমস্যার সমাধানও করে ফেললেন। কী ভাবে? তিনি ওই কলোডিওনের সঙ্গে মেশালেন কর্পূর। তৈরি করলেন প্রথম বাণিজ্য-সফল বিকল্প ‘সেলুলয়েড’। তারপর এই সেলুলয়েড দিয়েই তৈরি হওয়া শুরু হল বিলিয়ার্ড বল। হাতির দাঁতের এই বিকল্পকেই বলা যায় মানুষের তৈরি প্রথম ‘প্লাস্টিক’। এই একবিংশ শতাব্দীতে আমরা প্লাস্টিক বলতে অনেক ধরনের জিনিস বুঝি। কিন্তু প্লাস্টিকের ঠিকঠাক অর্থ হল, “নমনীয় এবং যাকে ইচ্ছামত আকার দেওয়া যায়”। আবার বর্তমানে ব্যবহার হয় যে সমস্ত পলিমার, যেমন পলিইথিলিন বা পলিথিন, পিভিসি, টেফলন – এরাও প্লাস্টিক। তবে পলিথিন মাত্রই প্লাস্টিক হলেও, সব প্লাস্টিক কিন্তু পলিথিন নয়। আর এই প্লাস্টিকের প্রায় সবটাই মানুষের তৈরি, প্রকৃতি শুধুমাত্র এর কাঁচামাল সরবরাহ করে, সরাসরি প্লাস্টিকের স্বরূপ প্রকৃতিতে অমিল। 

তবে হায়াৎ-এর আগেও প্লাস্টিক নিয়ে গবেষণা হয়েছে। প্রাকৃতিক পলিমার (এরা আসলে অনেক বড় শৃঙ্খলে যুক্ত কার্বনের জৈবযৌগ অণু) ব্যবহার করে প্লাস্টিক তৈরির চেষ্টা প্রথম কে করেন তা সঠিক ভাবে বলা না গেলেও ১৮৫৫ সালে ইংরেজ গবেষক আলেকজান্ডার পার্কস প্লাস্টিকের একটা প্রাথমিক রূপ তৈরি করেছিলেন। যাই হোক, হায়াৎ-এর তৈরি প্লাস্টিক (সেলুলয়েড) যে শুধু বিলিয়ার্ড বল তৈরিতে কাজে লাগল তা কিন্তু নয়। এই সেলুলয়েড দিয়েই তৈরি হল ফটোগ্রাফির ফিল্ম, চলচ্চিত্রের ফিল্ম। 

এরপর প্লাস্টিকের দুনিয়ায় পা রাখলো বেকেলাইট। ১৯০৭ সালে এই বিকল্প পদার্থটি তৈরি করেন লিও বেকল্যান্ড। এটা তৈরি হয়েছিল এক ধরনের রেজি‌ন থেকে। এদেরকে একবার তাপ এবং চাপের সাহায্যে একটা নির্দিষ্ট আকৃতি দিয়ে দিলে সেটাই বজায় থাকে, তা আর বদলায় না। এরা তাপ সহ্য করতে পারে, অল্প চাপে ভেঙে পড়ে না, বিদ্যুৎ নিরোধক, সূর্যের আলোতে এদের রঙের কোন পরিবর্তন হয় না – এককথায় এদের অনেক গুণ। অনেক কাজেও ব্যবহার হতে লাগলো এই বেকেলাইট। ইলেকট্রিকের সুইচ থেকে জলের পাত্র, সবকিছু বেকেলাইট দিয়ে তৈরি হতে লাগল। আজও বেকেলাইট যথেষ্ট ব্যবহার হয়। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই বেকেলাইট দিয়ে অস্ত্রও বানানো হয়েছিল। 

আরও পড়ুন: প্লাস্টিকের বিকল্প হতে পারে শণ? / টিম সিলি পয়েন্ট

এরপর আসে আরেক মজার আবিষ্কারের গল্প। একদিন সুইডেনের টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার ডক্টর ব্রান্ডেনবার্গার একটা রেস্তোরাঁতে বসে আছেন। পাশের টেবিলে এক খদ্দের জলখাবার সারছেন। হঠাৎ সেই পাশের টেবিলের ভদ্রলোক দিলেন তরকারির বাটি একেবারে উল্টে। টেবিলে তরকারি পড়ে একাকার কাণ্ড; শেষে ওয়েটার সেই টেবিলক্লথ পাল্টে দিতে তবে শান্তি। এই ঘটনাটি ব্রান্ডেনবার্গারকে চিন্তিত করল। তিনি ভাবলেন এমন একটা টেবিলক্লথ যদি বানানো যায়, যার উপর তরকারি বা ওই জাতীয় কিছু পড়লে সেটাকে একবার পরিষ্কার কাপড় দিয়ে মুছলেই দাগটা উঠে যাবে, তবে এই সমস্যার সমাধান করা যাবে। যেমন ভাবা, তেমনি কাজ। চেষ্টা চলতে থাকল। ১৯১৩ সাল নাগাদ তিনি কাপড়ের উপর ভিসকোজ নামে একটা প্রলেপ দিলেন, কিন্তু সেটা হয়ে গেল খুব কঠিন আর ভঙ্গুর, যার ফলে সেটা ঠিক কাজে লাগল না। হাল ছাড়ার পাত্র তিনি নন। এবার তিনি নিজের তৈরি একটা যন্ত্রের সাহায্যে ওই ভিসকোজকেই খুব পাতলা চাদরের আকার দিলেন। এবার সাফল্য এল, কারণ সেই পাতলা চাদরটা হল খুব স্থিতিস্থাপক আর জলনিরোধী। একেবারে ব্রান্ডেনবার্গার যা চাইছিলেন ঠিক তাই। ব্রান্ডেনবার্গারের আবিষ্কৃত এই বস্তুটি আজও বহুল ব্যবহৃত, আমরা তাকে চিনি সেলোফেন নামে। 

আবার ওয়ালেস হিউম ক্যারোদার্স তৈরি করলেন নাইলন। ওয়ালেস ছিলেন পশ্চিম ভার্জিনিয়ার চার্লসটনের ‘ডুপন্ট’ নামে একটা কোম্পানির গবেষক। ১৯৩৫ সাল নাগাদ নাইলন প্রথম তৈরি হয়। তখন পশুর রোম বা চুল থেকে তৈরি হত টুথব্রাশের ব্রিসলস। ১৯৩৮ সালে এই নাইলনের ব্রিসলস দেওয়া ব্রাশ বাজারে এলে বেশ ভালোই সাড়া পড়ে গেছিল। ১৯৩৯ সালে প্রথম যেদিন নাইলনের তৈরি মোজা বাজারে আসে, শোনা যায়, সেই দিনই ক্রেতারা সমস্ত মোজা কিনে নিয়েছিলেন‌। এরপর ১৯৩৮ সালে ডুপন্ট কোম্পানির কর্মী রয় প্লাঙ্কেট খানিকটা আকস্মিক ভাবেই আবিষ্কার করেন টেফ্লন, যা দিয়ে বাসনপত্রের উপর প্রলেপ দেয়া হয়। আবার ১৯৩৩ সালেই মোটামুটি পলিথিন এর শিল্প উৎপাদন শুরু হয়ে যায়। আর পলিথিনের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয় ১৯৪৪ সালে। এর নেপথ্যেও কিন্তু সেই ডুপন্ট, যদিও তার সঙ্গে টেক্সাসের বেটেলি কর্পোরেশনও যুক্ত ছিল।

এইভাবেই প্লাস্টিকের জয়যাত্রা এখনও অব্যাহত। প্লাস্টিকের আবিষ্কার সভ্যতার অগ্রগতিকে যেমন সাহায্য করেছে তেমনি বৃক্ষ নিধন, নির্বিচারে বন্য প্রাণী হত্যার মতো ঘটনাকে কিছুটা হলেও প্রশমিত করেছে। তবে সহজে নষ্ট হয় না এমন প্লাস্টিক, যেমন পলিথিন, এখন সভ্যতার মাথাব্যাথার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পলিথিন ভয়ংকর দূষকই শুধু নয়, ড্রেনেজ সিস্টেম আটকে ফেলে তা ভয়াবহ বন্যা সৃষ্টির কারণও বটে। এমনকি গভীর সমুদ্রে সামুদ্রিক জীবের পেটেও এই পলিথিনের অস্তিত্ব মিলেছে, যা বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বজায়ের প্রসঙ্গে যথেষ্ট চিন্তার। 

(প্রচ্ছদঋণ: ইন্টারনেট)


***************** 



#প্লাস্টিক # আবিষ্কার # বিজ্ঞান #নাইলন # টেফলন # পলিথিন # সেলোফেন # সভ্যতা # বিলিয়ার্ড # অনিন্দ্য পাল # সিলি পয়েন্ট # বাংলা পোর্টাল # ওয়েবজিন # বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি #web portal

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

132

Unique Visitors

183782