প্লাস্টিকের বিকল্প হতে পারে শণ?
প্লাস্টিক আমাদের জীবনের সঙ্গে প্রায় এক হয়ে গেছে। নানা সময়ে বহু আইন করে কিছুদিনের জন্য এই পরিবেশ হন্তারককে দমিয়ে রাখা গেলেও আমাদের প্রশ্রয়েই তা বারবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আসলে যতদিন না মানুষ নিজে সচেতন হচ্ছে, ততদিন আইন করে কবেই বা কী রুখে দেওয়া গেছে! এমন সহজলভ্য ও সহজে ব্যবহারযোগ্য দ্রব্যের উপর একেবারে নিষেধাজ্ঞা আনা খুব সহজ কথা নয়। আর যে বিপদ তৎক্ষণাৎ দেখা দিচ্ছে না, অদূর ভবিষ্যতের জন্য দানা বাঁধছে - সেই ব্যাপারে আমরা যে একেবারেই সচেতন নই, তা প্লাস্টিক ব্যবহারের প্রভাবে আমাদের চারপাশের অবস্থা দেখলেই বোঝা যায়।
তাহলে একমাত্র পথ প্লাস্টিকের বিকল্প ব্যবস্থা। এই বিকল্প ব্যবস্থার কথা উঠলেই প্রথমেই আমাদের বিশেষ কিছু বিষয়ের উপর নজর দিতে হবে। সর্বপ্রথম আমাদের খুঁজে দেখতে হবে কেন প্লাস্টিকের চাহিদা এত বিপুল? এর প্রথম ও প্রধান কারণ হলো প্লাস্টিক polyethine পলিমার দ্বারা গঠিত হয় এবং তার ফলে তা হয় দীর্ঘস্থায়ী এবং অপচনশীল। প্লাস্টিকজাত জিনিসপত্রের মধ্যে সবচেয়ে বড় অভিশাপ নিঃসন্দেহে প্লাস্টিক থলি বা ক্যারিব্যাগ। ১৯৬০-এর দশকে স্টেন গুস্তাভ থুলিন নামে এক এঞ্জিনিয়ার প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগের এই সুবিধাজনক রূপটি তৈরি করেন এবং তার পেটেন্ট নেয় সেলোপ্লাস্ট কোম্পানি। অতি সুলভ, সহজে বহনযোগ্য এই আবিষ্কারটি তীব্র বেগে বাজার দখল করে নেয়। এরপর একে একে একবার ব্যবহারযোগ্য গ্লাস, প্লেট, স্ট্র ইত্যাদি দ্রব্য সারা পৃথিবী জুড়ে ঘরে ঘরে ঢুকে পড়ে। প্লাস্টিকের এই বৈশিষ্ট্যগুলি যেমন আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সুবিধা এনে দিচ্ছে তেমনি অন্যদিকে এই অপচনশীলতার কারণেই তা ধীরে ধীরে ক্ষতির বীজ বপন করে চলেছে পৃথিবীর বুকে। অতএব প্লাস্টিকের বিকল্প দ্রব্যের কথা আলোচনা করতে গেলেই আমাদের ভাবতে হবে এমন দ্রব্যের কথা যা হবে টেকসই বা দীর্ঘস্থায়ী, জলনিরোধক এবং যাকে প্রয়োজনে ধ্বংস করা যায় অর্থাৎ পচনশীল। তবেই তা পৃথিবীর বিপুল জনসংখ্যার কাছে হবে পাবে গ্রহণযোগ্যতা, এবং একইসঙ্গে হয়ে উঠবে পরিবেশবান্ধব।
এই বৈশিষ্ট্যগুলোকে বিবেচনায় রেখে বিকল্প ব্যবস্থার প্রসঙ্গে বলতে হবে সেলুলোজ-যুক্ত উদ্ভিজ্জের কথা। অর্থাৎ এমন উদ্ভিদের অংশ দিয়ে গঠিত কোনো বিকল্প দ্রব্য যা প্লাস্টিকের পরিবর্তে অনায়াসেই ব্যবহার করা যাবে। এমন উদ্ভিদ হল শণ। শণ পাতায় সেলুলোজের পরিমাণ থাকে প্রায় ৬৫-৭০ শতাংশ। আয়তনে বড়, শক্তপোক্ত, ভেষজগুণসম্পন্ন এবং সর্বোপরি, পচনশীল, অর্থাৎ পরিবেশ বান্ধব। কোনো স্থান বুজিয়ে সেখানে কোনো বাড়ি বা বিল্ডিং করতে গেলে অনেক সময় প্লাস্টিক বা প্লাস্টিকজাত দ্রব্য সেই স্থানে ফেলে টক্সিক বা বিষাক্ত কেমিক্যাল প্রয়োগ করে প্লাস্টিক গলানো হয়ে থাকে। সেই কেমিক্যাল পরবর্তীকালে পরিবেশের ক্ষতি করে। কিন্তু শণ গলানোর জন্য কোনো ভিন্ন বিষাক্ত কেমিক্যাল প্রয়োগ করার প্রয়োজন হয় না, যার ফলে এটি ধ্বংস করার ক্ষেত্রে পরিবেশের উপর কোন কুপ্রভাব পড়ে না। শণ নানারকম পরিবেশে জন্মাতে সক্ষম। ফলে লভ্যতার দিক থেকেও বিশেষ সমস্যা হওয়ার কথা না। বৃহত্তরভাবে এর থেকে প্লাস্টিকের সমস্ত গুণাবলীসম্পন্ন দ্রব্য বানানো অসম্ভব নয়।
দেখা গেছে বর্তমানে নানা জায়গায় সুপারিপাতা, ভুট্টাপাতা এমনকী কচুরিপানার পাতা থেকে তৈরি দ্রব্য প্লাস্টিকজাত দ্রব্যের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং বেশ সাফল্য পাচ্ছে। অবশ্য তারা জলনিরোধক নয়। তাই থলি (ক্যারিব্যাগ) বা জলের গ্লাসের উপকরণ হিসেবে প্লাস্টিকের বিকল্প হওয়া এদের পক্ষে সম্ভব না। সেদিক থেকে শণ সম্ভবত শ্রেষ্ঠ বিকল্প হতে পারে। অতএব বিকল্প ব্যবস্থা নানাভাবেই করা যেতে পারে এবং তা নিয়ে নানা জায়গায় ধীরে ধীরে কাজও চলছে। এবার সেসব নিয়ে আমাদের সচেতন হওয়ার পালা, সেগুলিকে গ্রহণ করার পালা।
[কভার ছবি : গুগল]