অস্পৃশ্যতার শরীর, নাকি শরীর ভোগের অস্পৃশ্যতা?
উত্তরপ্রদেশের চিত্রকূট নামক বেআইনি খনি-অঞ্চলে গ্রামের দলিত নাবালিকার দিনের পর দিন ধর্ষণের ঘটনা জাতীয় স্তরে প্রিন্ট মিডিয়ায় আসার পরেও দেশ মোটামুটি নিশ্চুপ রইল। এই সেই দেশ, যেখানে প্রিয়াঙ্কা রেড্ডি গণধর্ষণ মামলার, কাঠুয়া, উন্নাও এবং নির্ভয়া কাণ্ডের পর জনগণ মোমবাতি মিছিল থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তুলেছিল। কিন্তু এটা আসলে সেই অগ্রগামী উন্নয়নশীল ভারতবর্ষ নয়, বরং মধ্যযুগীয় পশ্চাৎগামী ব্রাহ্মণ্যবাদী দেশ, যাকে এখনও কুরে কুরে খায় অস্পৃশ্যতার মতো ভয়াবহ অভিশাপ। এ সেই দেশ, যেখানে দলিত শ্রেণির সংখ্যা ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী প্রায় আটত্রিশ কোটির কিছু বেশি, যা মোট জনসংখ্যার ত্রিশ শতাংশের কাছাকাছি, কিন্তু সেই ত্রিশ শতাংশ মানুষের ভাগ্য আজও তথাকথিত ‘উঁচু’ জাতের হাতে।
আজকাল অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করতে চান না যে দলিতদের উপর এখনও এই ধরনের অত্যাচার হয়ে থাকে। এত বড়ো দেশের এত বিপুল জনসংখ্যার নিরিখে হাতে গোনা ঘটনাই প্রচারের আলোয় আসে, যা মানুষের সামাজিক দায়বদ্ধতার পরিসরকে বাড়তে দেয় না। যা নজরে আসে, সেগুলোও জাতি, রাজ্য, ধর্ম, ভাষা বা শ্রেণিবিন্যাসের মতো হাজারো ফ্যাক্টরের পাল্লায় পড়ে দৃশ্যত এত সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয় যে অতীব ভদ্র সমাজের মাথাটিও মুখ ফসকে বলে ফেলেন যে, “এসব তো ওসব নিচু জাতির মধ্যে হামেশাই হয়!” কিন্তু এই ভয়াবহ ধর্ষণের ঘটনায় মানুষের মানসিক বৈকল্য বা ধর্ষকামী মানসিকতা ছাড়াও আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিহিত আছে। তা হল জাতিভেদ প্রথার আড়ালে দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত নারীর দেহ ভোগের অবাধ ফরমান। সামাজিক অনুষ্ঠানে দলিত নারী ঠিক যতখানি অস্পৃশ্যতার শিকার, তার থেকেও বেশি তাদের উঁচু জাতের পুরুষের লালসার শিকার হতে হয়। সেটা জাতিগত বৈষম্য থেকে শুরু হয়ে শ্রেণিগত বৈষম্যের আকার ধারণ করে, ক্ষমতা-কাঠামোর অঙ্গীভূত হয়ে গিয়ে অক্সিজেন জোগায় এরকম হাজার হাজার ধর্ষণের ঘটনাকে। দলিত জাতির ধর্ষণের ক্ষেত্রে আরও একটি ভয়ানক বিষয় এই যে, তাদের বেশিরভাগই ঘটনাচক্রে নাবালিকা। এর মূল কারণ নিয়ে আলোচনা করা দরকার।
আরও পড়ুন : ধর্ষণের একটি গল্পের নাম!
মেপলক্রফট-এর গবেষণার তথ্য অনুযায়ী নারী-পাচার চক্রে ভারত সপ্তম স্থানে রয়েছে। এর পাশাপাশি , NCRB-এর তথ্য অনুযায়ী দেশে গড়ে ৩০,০০০ ধর্ষণের লিখিত অভিযোগ করা হয়। এটি আসলে মাত্র মোট সংখ্যার মাত্র কয়েক শতাংশ, কারণ ৯৩.৯ শতাংশ ধর্ষণ পারিবারিকভাবে পরিচিত মানুষের দ্বারা হয়। এ ছাড়া রাজনৈতিক দলের নেতার চাপে, লোকলজ্জার ভয়ে, বেশি ক্ষমতাশালী লোকের বিরুদ্ধে, বিয়ে হবে না এরকম ধারণায় এবং পারিবারিক অসম্মানের ভয়ে বেশির ভাগ ঘটনা চাপা দিয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া অন্ধ্রপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা এবং আরও বেশ কয়েকটি রাজ্যে সালিশি সভার মাধ্যমে অর্থের বিনিময়ে ক্ষতিপূরণ অথবা বিয়ের মাধ্যমে এই ধরনের ঘটনার বিচার হওয়ায় তা সরকারি হিসাবে আসে না। National campaign on Dalit Human Rights , NGO-এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ভারতে ২৩ শতাংশ দলিত নারী ধর্ষিত হন, লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে, যা একটা সমাজের কাছে যথেষ্ট উদ্বেগের। এ ছাড়া মেপলক্রফট-এর তথ্য অনুযায়ী প্রতি লাখে ৭,২০০ নাবালিকা পাচার হয়।
কীভাবে আমরা ধরে নিতে পারি যে এই পাচার জাতিভেদের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত?
ভারতে অস্পৃশ্যতা বিষয়টা বর্ণভেদ ব্যবস্থার কল্যাণে সেই মনুর সময়কাল থেকে এই আধুনিক যুগ পর্যন্ত সমান দাপটের সঙ্গে বহমান। প্রাচীনকালে ব্রাহ্মণরা অলৌকিক ক্ষমতার নামে, পূজার্চনা বা যাগযজ্ঞের নামে, মানুষের সরল দৈব-বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে সুদীর্ঘ সময় ধরে দেশের অধিকাংশ সম্পত্তি অধিকার করেছেন। এ ছাড়া ইংরেজ শাসনের শুরুর সময় থেকেই তাদের মোসাহেবি করে, বা তাদের সঙ্গে ব্যবসা করে বেশির ভাগ উচ্চশ্রেণির মানুষ প্রভূত জমির স্বত্ব ও সম্পত্তি লাভ করেন। এছাড়া শিক্ষা-দীক্ষা লাভের মাধ্যমে তারা কিছু কিছু প্রশাসনিক ক্ষমতাও অধিকার করেন। তথাকথিত ‘নিচু’ জাতদের তখন কোনোরকম শিক্ষালাভের সুযোগ দেওয়া হয়নি। শ্রমসাধ্য পেশায় নিযুক্ত থেকে নিয়ত জীবনযুদ্ধের ময়দানে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মানুষগুলোও শিক্ষালাভের জন্য কোনওরকম আগ্রহ আদিবাসীরা দেখাননি। ফলস্বরূপ আমাদের সামাজিক অসাম্য ক্রমাগত ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়েছে। আজও দেশের ৯০ শতাংশ সাংসদ এবং বর্তমান সরকার-অধিষ্ঠিত দলের ৯৯.৬ শতাংশ সাংসদ তথাকথিত ‘উঁচু’ জাত। প্রাচীনকাল থেকে জমির অধিকার, ইংরেজ আমলে সরকারি আমলাতন্ত্রের অধিকার ও জমিদারীর সুযোগ এবং পরবর্তীকালে সরকারি ক্ষমতা উঁচু জাতগুলোকে আর্থিকভাবে যতই পুষ্ট করেছে, ততটাই আর্থিকভাবে ভিখারির দশায় নামিয়ে এনেছে দলিতদের।
আমাদের সমাজব্যবস্থায় দলিত নারীরা সেই মনুবাদের সময় থেকে সামাজিক বিধানের স্বীকৃতিতেই ধর্ষণের শিকার হয়ে আসছে। দক্ষিণ ভারতের মন্দিরগুলোতে দেবদাসী প্রথা তারই প্রমাণ। এখানে দলিত নারীদের, বিশেষ করে নাবালিকাদের পুরোহিতের সেবায় জীবন অতিবাহিত করতে হয়। এ ছাড়া নিচু জাতের নারীদের যোগিনী করে রাখার প্রচলন আছে পাঞ্জাব সহ কিছু রাজ্যে। দলিত জাতির মধ্যে মেয়ে জন্মালেই তা উঁচু জাতির ভোগের জন্য, এমন অলিখিত রীতিও রয়ে গেছে কোথাও কোথাও । প্রাচীন ব্যবস্থার পাশাপশি আধুনিক যুগে এক ভয়ানক সামাজিক রীতি তৈরি হয়েছে অধিকারভুক্ত ধর্ষণের ঘটনার। ২০১১-এর জনগণনা অনুযায়ী, মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ দলিত নারী এই ৮০ শতাংশ সম্পত্তির অধিকারী জাতের অধীনে গৃহকর্মের সঙ্গে যুক্ত। বাকি ৬০ শতাংশের বেশিরভাগ নারীরা ইট ফ্যাক্টরি এবং বেআইনি খনিতে দিনমজুর হিসাবে কাজ করে থাকেন। চিত্রকূটে বেআইনি খাদানে কর্মরত নাবালিকার কাজের পর পাওনা টাকা পাবার জন্য কন্ট্রাক্টরের কাছে দেহ বিক্রি করতে বাধ্য হবার ঘটনা প্রমাণ করে যে এমন ঘটনা দেশে খুব অস্বাভাবিক নয়। এইসব ঘটনা সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণিকে তেমন বিচলিত করতে পারে না, যতটা তাদের বিচলিত করে উঁচু জাতের উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারের নারীর ওপর অত্যাচার। আবার এই ঘটনা এটাও প্রমাণ করে যে সমাজের উঁচু জাতের কাছে দলিত নারীরা সাধারণভাবে অস্পৃশ্য হলেও উঁচু জাত তাদের ধর্ষণ করতে দ্বিধাবোধ করে না। তুতিকোরিনের কালিভিলা গ্রামে আট বছরের দলিত মেয়ে উঁচু জাতের বাড়ি টিভি দেখতে গিয়ে ধর্ষিত হয়। শানবাগের দলিত সেবিকা, উন্নাও-এর দলিতের স্ত্রী, কিংবা পশ্চিমবঙ্গের চোপড়ায় মাম্পি সরেন - তালিকাটা নেহাত ছোটো না। এ দেশে বিভিন্ন পর্ন সাইটে ‘দলিত মেইড’ পর্নের ট্রেন্ড চলে। সোজা কথায় বলতে গেলে, সমাজে দলিতরা অস্পৃশ্য হলেও দলিত নারীদের দেহের ক্ষেত্রে সে নিয়ম নাস্তি। নারীমাংসের আবার কোনও জাত হয় নাকি?
তথ্যসূত্র:
১) মেপলক্রফট রিপোর্ট
২) ২০১১ জনগণনার উইকি রিপোর্ট
৩) ইন্ডিয়া টুডে অনলাইন নিউজ রিপোর্ট,২০২০, জুন ৮.
৪) এনসিআরবি 2018, তথ্য
৫) Caste and Prostitution in India: Politics of Shame and of Exclusion: Jha, Divyendu and Sharma, Taniya.
[পোস্টার ডিজাইন : অর্পণ দাস]