নিবন্ধ

ধর্ষণের একটি গল্পের নাম!

শ্রাবস্তী ঘোষ Oct 14, 2020 at 5:57 am নিবন্ধ

একটা ধর্ষণ নিয়ে লিখতে বসলেই মনে পড়ে যায় আগেরটার কথা, বা কখনও ঠিক আগেরটা মনে পড়েও না। ঘটনার ভিড়ে বা বলা ভালো ধর্ষণের ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যায়। কোনটা কতটা বেশি নৃশংস তার একটা হিসেবনিকেশ করতে থাকি বাজারে ব্যথার তুল্যমূল্য ওজন মেশিনে। দেড় বছরের ভ্যাজাইনার আলপিন, সত্তর বছরের সিস্টার বা কুড়ি বছরের গমখেত– এই প্রত্যেকটা ঘটনাতেই জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মেয়েরা একটা জায়গায় এসে দাঁড়ায়।

আসিফাকে যখন পাওয়া গেছিল, তার থেকে পাক্কা দুটো বছর কেটে গেছে। করোনা, লকডাউন আমাদের জড়ত্বকে আরও বাড়িয়েছে, সুযোগ নিয়েছে রাষ্ট্র। ক্রমাগত সুযোগ নিয়েই গেছে, নানান খবর দিয়ে ভুলিয়ে রেখেছে আমাদের। আমরা এক-একবার শিউরে উঠে আবার পাতা উল্টেছি। তবে, ধর্ম- বর্ণ-জাত-পাত নির্বিশেষে সবের কমন ফ্যাক্টর থেকে গেছে মেয়েরা। কখনও ডাইনি বলাতে, কখনও মি-টু অস্বীকারে, বা, কখনও জিভ কেটে দেওয়ায়। আর, কখনও দলিত মেয়ে, মুসলমান মেয়ে, ঘটনার পরত বদলে বদলে দিয়েছে।

এই লেখা যখন চলছে, তখন সংবাদ শিরোনামে আছে হাথরাস আর বলরামপুর। মনে হয় একটু থেমেও গেছে শোরগোল। এর মধ্যেও আরও ঘটনা ঘটে গেছে, যা যা আমাদের কাছ পর্যন্ত এসে পৌঁছয়নি। মহেন্দ্র সিং ধোনির কম রানের শাস্তি হিসেবে তাঁর মেয়েকে ধর্ষণের হুমকি দিয়েছে একদল।

আরও পড়ুন : ধর্ষণ, ক্ষমতায়ন এবং বিচারের বাণী : গোবিন্দ নিহালনির ‘আক্রোশ’ / রোহন রায়

হাথরাসে ঠিক কী হয়েছিল, কীভাবে হয়েছিল, সে বর্ণনা বা পর্যালোচনাতে যাব না, কারণ তা অতি চর্চিত আপাতত। “উয়ো ক্যায়া জ্বল রহা হে”-এর আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে এই ঘটনাও ছাই হয়ে যাওয়ার আগে যে আলোচনা বারবার করা দরকার, ধর্ষণ কেন হয়। আর হয় যখন তখন একদল কেন ঘটনার অস্তিস্ত্ব অস্বীকার করতে এত তৎপর হয়ে ওঠে? 


আমরা যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে বাস করি, তার শিকার নারী-পুরুষ লিঙ্গ-নির্বিশেষে সকলে। সেই সমাজে একদম ছোট বয়স থেকে মেয়েদের পা ঢেকে, জামা নামিয়ে বসতে বলা হয়, বাড়ির ‘পুরুষদের’ সামনেও। এই সহবত শিক্ষার আড়ালে আসলে মেয়েটির যৌনাঙ্গ ঢেকে রাখার উপদেশ দেওয়া হয়। আমার সবসময় মনে প্রশ্ন জাগে, যখন একদম ছোটবেলায় বাড়ির মধ্যেই এই সাবধানতা অবলম্বনের প্রয়োজন হয়, তখন মেয়েদের ‘সেফ স্পেস’ বা নিরাপত্তার আর্জি জানানোর শুরুটা ঠিক কোথা থেকে হওয়া দরকার।


পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায়, দ্বিতীয় লিঙ্গ হল, মেয়েরা বা সিস-উইমেন। যে-কোনো যুদ্ধ-লড়াই-তর্ক-বিবাদের মীমাংসায় বা প্রতিশোধে আক্রমণের বিষয় মূলত হয়ে ওঠে এই দ্বিতীয়-লিঙ্গ। কারণ, এই ব্যবস্থা একজন নারীকে তার শরীর দিয়ে চিনতে শেখায়। সেখানে স্তনের মাপ, কোমরের ভাঁজ, নিতম্বের উচ্চতার ওপর নির্ভর করে মেয়েটির গ্রহণযোগ্যতা। ভদ্রসমাজ পরিশীলিতভাবে সে কথা স্বীকার না করলেও, সমাজের অধিকাংশের মনের গভীরে এই চিন্তারই যে যাপন চলে, সে কথা আমার আলাদা করে বলার কিছু নেই। আর আমার মনে হয়, এই এতক্ষণ ধরে একটা কথাও আমি নতুন বলিনি যা আগে বলা হয়নি। কিন্তু, বলছি, কারণ, বারবার বলা প্রয়োজন, আলোচনা করতে করতে একেবারে ভেতরে গেঁথে দেওয়া জরুরি। 


এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উল্লেখ করতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে। একবার দিল্লি শহরে মধ্যরাতে আমরা ছজন মেয়ে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম, রাতের শহরকে চিনব বলে। আমরা তিনজন তখন তেইশ আর বাকিরা মধ্যত্রিশ। বড় রাস্তা ধরেই হাঁটছিলাম আমরা। হঠাৎ একটা ওষুধের দোকানের সামনে গাড়ি থেকে দুজন পুরুষ ‘আই ওয়ান্ট’ বলে চিৎকার করে হর্ন দিতে থাকে। ওই পথটা পেরিয়ে আসি ছজন। কিন্তু তারপর থেকেই একটা অদ্ভুত ভয় আমাদেরকে চেপে ধরল যেন। সবাই সবাইকে বললাম, কেউ যেন আলাদা না হয়ে যায়। এর বেশ খানিকটা যাওয়ার পরে একটি বাচ্চা ছেলে, তেরো-চোদ্দো বছরের, আমাদের পিছন পিছন আসতে শুরু করল। আমরা ভাবলাম খাবার চায়, ভাবলাম অস্ত্র আছে সঙ্গে কোনও। চলে যেতে বললাম সকলে, বড়রা বকল। ও বেশ অনেকটা পথ আমাদের সঙ্গে আসতেই থাকল, প্রায় আধঘণ্টা। দূরত্ব বেড়ে গেলে দৌড়ে আসছিল। অদ্ভুতভাবে ওই তেরো বছরের একটা বাচ্চাকে আমরা ছজন ভয় পাচ্ছিলাম। হঠাৎই অন্ধকার ফ্লাইওভারে ও প্যান্ট খুলে হস্তমৈথুন করতে করতে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল। 

 

আমরা ভয় পেয়েছিলাম, প্রচণ্ড ভয়। আর ওই তেরো বছর সেই ভয়ের গন্ধ পেয়েছিল। আমরা এখনও ধন্দে আছি কেন আমরা সেদিন ওকে একটা চড় পর্যন্ত মারতে পারলাম না বা অতদূর ওর আসা থামাতে পারলাম না কেন। আমাদের ভাবনাতেই আসেনি যে বারো-তেরো বছরের বাচ্চাটি তার পেনিসকে ছটি মেয়ের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে চিনে নিয়েছে। সত্যি কথা বলতে ২০১৮-এর ৮ মার্চের এই ঘটনার মনস্তাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ আমি এখনও চালানোর চেষ্টা করি। উত্তর এখনও মেলেনি। 

 

কাটজু কদিন আগে সোশ্যাল মিডিয়াতে বললেন যে দেশের বেকারত্ব, অর্থনৈতিক চাহিদা ধর্ষণের ঘটনা বাড়াচ্ছে। তাঁর মতে, করোনার ফলে দেশের আর্থিক অবস্থায় ধর্ষণ একটি অতি প্রচলিত ঘটনা হয়ে উঠবে। এবার, কাটজু বলে প্রবল প্রতিবাদের চাপে যা ডিলিট করলেন, আমরা কজন বুকে হাত রেখে বলতে পারি সেটা আসলে আমরা ভাবি না? পুরো ভারতের কথা ছেড়ে দিলাম, এই কলকাতা শহরের অধিকাংশ মানুষ মনে করে, মেয়েদের যৌনতা তাদের একমাত্র পরিচয় এবং তা ভোগ করা পুরুষের অধিকারভুক্ত। একটু লক্ষ করলে দেখা যাবে আড্ডার বেশিরভাগ উপকরণ থাকে যৌন উত্তেজনামূলক। সেই প্রণালী মূলত একটি মেয়ের শরীরের বিবরণের ওপর নির্ভর করে থাকে। একটি মেয়েকে দেখে সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব সহজেই ‘সেক্সি’ কমেন্টটি সকলে করে ফেলে। কিন্তু, কেন করে? যে বলছে এবং যাকে বলছে, দুপক্ষেরই যে কোনোরকম বিবেচনা ছাড়াই মন্তব্যটি ভালো লাগে, তার পিছনেও দীর্ঘদিনের প্রোথিত পিতৃতন্ত্র আছে। আসলে, এই সমাজে যৌনতাকে কেবলমাত্র প্রজননের একটি মাধ্যম হিসেবে দেখা হয়। পুরুষের হাতে থাকে সেই জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা। নারী এখানে কেবলই ধাত্রী। অর্থাৎ, এই বোঝাপড়ার মধ্যেই অলিখিতভাবে যৌনতার চাবি থাকে পুরুষের পকেটে। সেক্সুয়াল অ্যাক্ট-এর সঙ্গে প্লেজার বা আনন্দকে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত না করলে সেখানে নারী-পুরুষের সমানাধিকার মনস্তাত্ত্বিকভাবে আসা কঠিন। 


আড্ডার গোলে এই যৌন রসাত্মক মন্তব্যের চর্চা হয় রোজ, কারণ, "এত সিরিয়াসলি সব নিলে মজা হবে কী করে!" বলছি না, এটা পুরুষের একার সমস্যা, এটা পিতৃতান্ত্রিক সমাজের সমস্যা, যার শিকার সকলে, সক্কলে। যে উচ্চবর্ণ জয়া আহসানের ছবি পোস্ট করে বলে তা তার রাতের রসদ, আর সেখানে একদল পুরুষ রসালো মন্তব্য করে, আমি এই পুরোটার মধ্যে একরকমের জান্তব ধর্ষণের গন্ধ পাই। সেই অবদমিত কামনার শেষেই হয়তো পা ভেঙে দেওয়া হয়, মেরুদণ্ড ভেঙে জিভ টুকরো করে ফেলা হয়। জানা নেই...


এই প্রতিটি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ধর্ষণের পরে এক পক্ষ সবসময় নীরবতা পালন করে। আর-এক পক্ষ ব্যস্ত হয়ে পড়ে মেয়েটিকে দায়ী করতে বা ঘটনা অস্বীকার করতে। যৌনতার ক্ষেত্রে সবসময় একটি মেয়ের সম্মতি প্রয়োজন– এবং সেই সম্মতি আসা দরকার স্বেচ্ছায়। যে যৌন মিলনে বা যৌন ইঙ্গিতে একটি মেয়েকে শারীরিক বা মানসিকভাবে বলপ্রয়োগ করা হয়, তাই-ই ধর্ষণের আওতাভুক্ত। সেক্ষেত্রে বয়স বা পদাধিকার বলেও যদি কাউকে যৌন মিলনে পরোক্ষভাবে বাধ্য করা হয়, তাহলেও তা হেনস্থা বলে অভিহিত হবে।


আসলে আমাদের প্রতিদিনের আলোচনা, বেঁচে থাকায়, কথাবার্তায় বারবার মেয়েদের যৌনতা নিয়ে চর্চা খুব স্বাভাবিকভাবে উঠে আসে। এই উঠে আসার শিকড় এতই গভীরে যে তা চিনতেও পারা যায় না বহু সময়। বিবাহিত সম্পর্কের যৌন মিলনেও যে দুপক্ষের সরাসরি সম্মতি প্রয়োজন, অন্যথায় তা ধর্ষণ, এ কথা এখনও অনেকে মেনে নিতে পারেন না। 


এত কথা বলার পরেও বলব, আমার আজকাল একা গাড়িতে চড়তে একটা অন্যরকম ভয় করে। কেন জানি না বারবার মনে হয়, খোলা জানলা দিয়ে যে কেউ অ্যাসিড ছুড়তে পারে মুখে। দুর্গা ঠাকুর নিয়ে যাওয়ার সময় যখন সারা শরীর খোলা রেখে, শুধু মুখটুকুন কাগজ দিয়ে ঢেকে নিয়ে যাওয়া হয়, সেটা দেখলেই আমার কেমন সেই, সারভাইভারের জবানবন্দি দেওয়ার ছবি মনে পড়ে।


এই একটা ভয়ও অমূলক নয় আর। আমাদের অভ্যস্ততায় আর মোমবাতি জ্বলে না, আমাদের দৈনন্দিনতায় এখন ট্রাম্পের করোনা সেরে গেছে। এখন পুজো দখল করেছে সব। সোশ্যাল মিডিয়ার স্মৃতিতে হাথরসের মেয়াদ শেষ। রাষ্ট্র যেভাবে মনীষাকে গোপনে নিভৃতে পোড়ায়, তেমনি সোশ্যাল মিডিয়াও আলোচনা সরিয়ে দেয় দ্রুত। আমরা জানি শিউরে ওঠা আর দিন গোনা ছাড়া আর খুব বেশি কিছু করার নেই আমাদের। 


[পোস্টারে ব্যবহৃত ছবির উৎস - apc.org] 

[পোস্টার : অর্পণ দাস]  


#নারীপক্ষ #নিবন্ধ #মনীষা #হাথরস #আসিফা #বলরামপুর

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

27

Unique Visitors

181923