রাষ্ট্রের শিল্পী নাকি শিল্পের রাষ্ট্র?
মেফিস্টো-র হেনরিক হফগেন নাৎসি পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন অভিনেতা হিসেবে টিকে থাকার আকাঙ্ক্ষা থেকে। জার্মানিতে তখন নাৎসিরা হিটলারের নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসছে। সেই চরম শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তির অংশীদার না হতে পারলে, ফুরিয়ে যাওয়ার ভয় পেয়েছিলেন হফগেন। নিজের বিশ্বাস, প্রেম, এই সব কিছুকে লুকিয়ে তিনি চলে আসেন বার্লিনে। রাষ্ট্রের কাছাকাছি, ক্ষমতার পায়ের কাছে।
রাজাদের আমলে থাকত তাঁদের সভাকবি, নিজেদের নাট্যকার, গীতিকার, ইতিহাসবিদ। ইতিহাস তৈরি হত রাজার ইচ্ছেয়। সেখানে তাই রাজ্যদখলের গল্প, রাজাদের কীর্তি-কাহিনি। কিন্তু, এখন সেই রাজাও নেই, আর তার রাজপাটও গিয়েছে। এখন স্বাধীন দেশের সংবিধান গণতন্ত্রে সকল নাগরিকের সমান মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সুনিশ্চিত করছে। সেই স্বাধীনতা শিল্পীর বক্তব্য, ব্যক্তিমানুষের পছন্দকে সুরক্ষিত করে। সুরক্ষিত করে ব্যক্তিসত্তা, নিজস্ব রুচি, প্রেমের অধিকার, ধর্মাচরণের অধিকারকে, কারণ ভারতবর্ষের সংবিধান অনুযায়ী, এটি একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। তবে সে সংবিধান মানা হচ্ছে কই? ফ্যাসিবাদ চেষ্টা করে কণ্ঠরোধের, যা গণতন্ত্রের পরিপন্থী। মজার কথা হল, এই ফ্যাসিবাদের চরিত্র চিরকাল এক থাকে। তাই, আমরা, সাধারণ মানুষেরা, রাজনীতির তাত্ত্বিক আলোচনায় মিল খুঁজে পাই এক সময়ের সঙ্গে অন্য সময়ের। যেমন এখন পাচ্ছি, নাৎসি জার্মানির সঙ্গে বর্তমানে এ দেশের রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতির।
আবার, ১৮৭৬-এ ব্রিটিশ সরকার আনে নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইন। সেই আইন অনুসারে, নাটক নির্মাণের আগে নাটককারকে পাণ্ডুলিপি দেখিয়ে নিতে হবে সরকারের কাছে। অন্যথায়, এই আইন নাট্যকার, অভিনেতাদের হাজতবাস করানোর অধিকারী। স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতেও এই আইন নানাভাবে বিভিন্ন রাজ্য ব্যবহার করে এসেছে। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে এর পোশাকি নাম হয়েছে 'সেন্সর বোর্ড'। সেই বোর্ড ছবির কাহিনি থেকে শুরু করে কোন দৃশ্য রাখা হবে, সেসবের নিয়ন্ত্রক, সর্বেসর্বা, সরাসরি রাষ্ট্রের চর, কখনও কখনও।
অর্থাৎ, বোঝা যায়, শিল্পীদের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক দেশ-কাল-সময় নির্বিশেষে কখনোই ভালো না। প্যানডেমিক যদিও কেন্দ্রীয় সরকারকে দিয়ে ঘোষণা করিয়েছে, বিনোদন নানান অদরকারি (নন-এসেনশিয়াল) কাজের মধ্যে একটি। তাও, সম্প্রতি একটি রাজনৈতিক দল, যারা আবার কেন্দ্রের সরকারও বটে, বাধ্য হয়েছে ভোটের মুখে 'ইঁদুরকল' নামে একটি নাটককে বন্ধ করে দিতে। এবার প্রশ্ন হল, এত অদরকারি জগৎ ও তার মানুষদের সঙ্গে সরকারের এই চিরকালীন দ্বন্দ্ব কেন? এই দ্বন্দ্বই কি অগ্রাহ্য করার কথা বলে?
যে-কোনোরকমের শিল্প, গান, থিয়েটার প্রভৃতি– এমন একটা মাধ্যম যা বহু ব্যঞ্জনায় একটি বিষয়কে ব্যক্ত করে। ভাষা প্রয়োগের জটিলতা পেরিয়ে নৈর্ব্যক্তিক মাধ্যম হল শিল্প, যা শব্দের থেকে অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছোয়। মনকে প্রভাবিত করে। বাংলায় পাঁচালি, কবিগান, খেউড়ের প্রচলন সেই ভাবপ্রকাশের মাধ্যম হিসেবে উঠে এসেছিল। তাঁরা নিজেদের মতন করে কথা প্রচার করতেন। তাঁদের ওপরেও কি নিষেধের নির্দেশ নেমে আসত না?
এই প্রতিবাদের পারফরম্যান্সের একটি ধরন হিসেবে উঠে এসেছে পারফরম্যান্স আর্ট। এই পারফরম্যান্স আর্ট সরাসরিভাবে আওয়াজ তোলে– বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা হয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। এক্ষেত্রে আমাদের বহু পরিচিত নাম ম্যারিনা আব্রমোভিচ। ইয়ুগস্লোভিয়ার রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থা, উদ্বাস্তু হওয়ার শিকড়হীনতা বারেবারে তাঁর কাজের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে এসেছে, প্রতিবাদস্বরূপ।
খুব ক্লিশে হয়ে যাওয়া কথায়, থিয়েটার হল সমাজের দর্পণ। ফলে, সামাজিক থেকে রাজনৈতিক সব বিষয়ে বক্তব্য পেশের মাধ্যম হিসবে থিয়েটার বারেবারে উঠে এসেছে। ভারতবর্ষে রাজনৈতিক থিয়েটারের ইতিহাস দেখলে চলে আসে ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন (IPTA)-এর কথা। এখানে প্রতিবাদী নাটক বা অ্যাজিট-প্রপ থিয়েটার সরাসরিভাবে একটি রাজনৈতিক পক্ষ নিয়েছে। বামপন্থী মতাবলম্বী এই সংগঠন সরাসরিভাবে তাঁদের শিল্পে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলে এসেছেন। উৎপল দত্তের নাটকে, হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গানে সেই প্রতিরোধের কথা বারেবারে উঠে এসেছে। মাঠঘাট পেরিয়ে আসা সেই আহ্বানকে রাষ্ট্র প্রতিবারই একইভাবে ভয় পেয়ে এসেছে। সেই ভয় কখনও শিল্পীদের জেলে ঢুকিয়েছে, আবার কখনও বা সফদরের হত্যা হয়েছে। যেখানে অভিনয় চলাকালীন সফদর হাশমিকে গুলি করা হয়েছিল, সফদরের মৃত্যুর ঠিক পরে জন নাট্য মঞ্চ সেই একই জায়গায় ফিরে গিয়ে নাটকের অভিনয় সম্পূর্ণ করে। কারণ, সেই নাটকে নিছক বিনোদন ছিল না, সে নাটক বলার, শেষ করার প্রয়োজন ছিল, প্রতিবাদের প্রয়োজনে। অবশ্য শুধু বিনোদন থাকলে সফদর গুলিও খেতেন না। পাবলো নেরুদার চিঠি পোড়ানো হয়েছে। বহুযুগ আগে গ্যালিলিও হত্যাও এইসবের থেকে আলাদা নয়। প্রত্যেকটা ক্ষেত্রেই বিরুদ্ধ মতকে চেপে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উল্টোদিকে থেকেছেন শিল্পী, কবি, দার্শনিক।
মৃত্যু না হত্যা, এই দ্বন্দ্বের মাঝে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস এক অন্য মাত্রা নেয়। সেখানে চিহ্নিতকরণ করা হয় সরকার পক্ষের শিল্পীদের। অপর পক্ষকে প্রতিরোধ করা সহজ হয় সেক্ষেত্রে। কখনও নাটক বন্ধ করে, কখনও শো-এর সুযোগ না দিয়ে, আবার কখনও টাকাপয়সা (যাকে গ্রান্ট পাওয়া বলি) বন্ধ করে দেওয়া হয় এই পুরো পদ্ধতিতে। লক্ষ্য হল, একেবারে ভেতর থেকে একজনকে চেপে দেওয়া, যাতে সে কথা বলার সুযোগ পর্যন্ত না পায়। আর, এই সময়েই একঘরে হয়ে যেতে চান না কিছু শিল্পী। তাঁদের মধ্যে একদল হন নিরপেক্ষ, আরেকদল যান সরকারপক্ষে। এবার, একটু ভেবে দেখা দরকার, এই সরকারপক্ষ কি সকলে স্বেচ্ছায় হয়? ক্ষমতার সিংহাসন থেকে নানান প্রলোভনের মোহর ছুড়ে দেওয়া রাজার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারে কজন? কজনের আর্থিক-সামাজিক অবস্থান সেই মুখ ফিরিয়ে থাকাকে সহযোগিতা করতে পারে? মূল্যবোধ ও নিজস্ব রাজনৈতিক চেতনার প্রসঙ্গ এখানে আনলাম না। কারণ, তার মধ্যে এক জটিল মনস্তত্ত্বের হিসেব লুকিয়ে আছে।
তবে কোনও কণ্ঠরোধই দেশ-কাল-সময় নির্বিশেষে শিল্পীদের দমিয়ে রাখতে পারেনি। রাষ্ট্রের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্কের টানাপোড়েন তাই আজীবন, খানিক রোম্যান্টিসাইজ করে বলতে গেলে, এ যুদ্ধ নিরন্তর। তবে এই সাদাকালোর দ্বন্দ্বে পক্ষ বেছে নিতেই হয়। আর, পৃথিবীর ইতিহাস থেকে রূপকথার গল্প– কোথাওই ফ্যাসিস্টদের বা দুষ্টু লোকেদের জিত হয় না। তাই, হেনরিক হফগেনকে সব খুইয়ে ফিরে যেতেই হয়, কারণ ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র কখনও কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না। তাদের কাজ শুধু দাবিয়ে রাখার মধ্যে, ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে। তাই, হফগেন-এর শেষ অভিব্যক্তিতে সে সামান্য একজন অভিনেতা হয়েই থেকে যায়।
আরও পড়ুন : মুসোলিনির উত্তরাধিকার : ফ্যাসিবাদের জীবাণু ও তার সাধারণ লক্ষণ / মৌমিতা সেনগুপ্ত
...........................
[ লেখার মাঝখানের পোস্টারে ব্যবহৃত কার্টুনটি ডেভিড লো-র আঁকা]
[পোস্টার : অর্পণ দাস]