নিবন্ধ

মুসোলিনির উত্তরাধিকার : ফ্যাসিবাদের জীবাণু ও তার সাধারণ লক্ষণ

মৌমিতা সেনগুপ্ত April 14, 2021 at 7:11 am নিবন্ধ

মুসোলিনির হাত ধরে ইতালিতে ফ্যাসিবাদের আবির্ভাব ঘটে ১৯২০-র দশকে। তাঁর উগ্র জাতীয়তাবাদী মনোভাব মানবাধিকারকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে, গণতন্ত্র ও ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ করে একটি সর্বগ্রাসী ও সর্বাত্মক রাষ্ট্র নির্মাণ করতে চেয়েছিল। এই মতাদর্শকে গোটা পৃথিবী জুড়ে অনেক দানবের জন্ম দিতে দেখেছি আমরা। কিন্তু আজও কি শেষ হয়েছে এই বিধ্বংসী সর্বাত্মক মতাদর্শের জীবাণু? নাকি গণতন্ত্রের জয়জয়কারের যুগেও নতুন করে ফিরে আসছে ফ্যাসিস্ট শক্তির ভূত? এই নিবন্ধে আমরা বিখ্যাত কিছু ফ্যাসিবিরোধী চিন্তাবিদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করে সংক্ষেপে সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজব।

আব্রাহাম নোয়াম চমস্কি নিঃসন্দেহে আমাদের সময়ের শ্রেষ্ঠ একজন মনীষা। বিশ্ব রাজনীতি বিষয়ে তাঁর স্পষ্ট মতামত আমাদের আলো দেখায়। সাম্প্রতিক একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন যে ফ্যাসিবাদের মূল কথাই হচ্ছে একটি টোটালিটারিয়ান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, যে রাষ্ট্র সর্বক্ষেত্রে তার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখতে চায় এবং সমস্যার কথা এই মতবাদ গণতন্ত্রের ছদ্মবেশ নিয়ে ফিরে আসতে চাইছে গোটা বিশ্ব জুড়ে। রজার গ্রিফিন তাঁর গ্রন্থ 'দ্য নেচার অফ ফ্যাসিজম'-এ পলিনজেনেটিক উগ্র জাতীয়তাবাদের যে তত্ত্ব উপস্থাপিত করেছেন, সেটিও এক্ষেত্রে উল্লেখ্য। গ্রিফিনের কথায়, ফ্যাসিবাদ গড়ে ওঠে একটি মিথ অথবা কল্পনাকে ঘিরে, যার ভিত্তি হচ্ছে উগ্র জাতীয়তাবাদ। এখানে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তৈরি করা সত্য (যাকে বলা যেতে পারে Manufactured Truth) বা বিকৃত ইতিহাসকে প্রচার করে একটি শত্রুগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করা হয়, এবং তাকে নির্মূল করতেই দেশপ্রেমী মানুষকে একত্র হবার আহ্বান জানানো হয়। শাসক নিজের নানাবিধ অ্যাপারেটাস ব্যবহার করে জনতার আবেগ বা চিন্তাধারাকে আকার দেয়, নিয়ন্ত্রণ করে। কখনও শাস্ত্র দিয়ে, কখনও বা অস্ত্র দিয়ে। রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’-তেও যেমন এই নিয়ন্ত্রণের এক অসামান্য রেখাচিত্র আমরা দেখি, তেমনই হানা আরেন্তের মতো তাত্ত্বিকদের আলোচনা থেকেও স্পষ্ট হয় রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণকামিতার নীল নকশা। মুসোলিনি নিজের সাংবাদিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েই হয়তো সাধারণ মানুষের এই মানসিক দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে একটি গোষ্ঠীর প্রতি ভীতি, বিদ্বেষ তৈরি করে নিজের ক্ষমতাকে প্রবলতর ও সর্বগ্রাসী করে তুলতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। এই একই মতাদর্শ ব্যবহার করে জার্মানির হিটলার, স্পেনের ফ্রান্সিও বা চিলির পিনোচেৎ নিজেদের শাসন কে শক্তিশালী করেছিলেন। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে বিশ্ব রাজনীতির চিন্তাধারায় আমূল পরিবর্তন আসে ।  বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত হয়ে জাতীয়তাবাদী স্বাধীনতা আন্দোলন। ফ্যাসিবাদী উগ্র জাতীয়তাবাদের সাথে এর মূলগত ফারাক হলো এই যে,  এই আন্দোলনের উৎস মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবাবেগ থেকে। যে আবেগ ক্ষমতার দ্বারা চাপিয়ে দেওয়া নয়। তার ফলস্বরূপ পোশাকিভাবে আজ পর্যন্ত বিশ্বের কোনও প্রান্তে ফিরে আসেনি ফ্যাসিবাদ। রাষ্ট্রব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্রের জয়জয়কার যখন চারদিকে - কাগজে-কলমে ব্যক্তিস্বাধীনতা, মানবাধিকার, সাম্যের উপর দাঁড়িয়ে রাষ্ট্র, সমাজ ও অর্থনীতির পরিকাঠামো, তখন কি ধরে নিতে হবে যে ফ্যাসিবাদ মতাদর্শরূপে বিলুপ্ত? 

চমস্কির মতো তাত্ত্বিকেরা বলেন যে মতাদর্শটি আর প্রত্যক্ষ ভাবে না থাকলেও এর লক্ষণগুলি আধুনিক অনেক রাষ্ট্র ব্যবস্থাতেই বিদ্যমান। দার্শনিক জেসন স্ট্যানলি তাঁর ‘হাউ ফ্যাসিজম ওয়ার্কস’ গ্রন্থটিতে ব্যাখ্যা করেছেন কীভাবে ফ্যাসিজমের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে শ্রেণীবিন্যাস এর রাজনীতি। জৈবিকভাবে নির্ধারিত এক বিমূর্ত শ্রেষ্ঠতার প্রতি এই মতাদর্শের নিষ্ঠা - যার মাধ্যমে তারা একটি কাল্পনিক গৌরবময় অতীতকে পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করে। সাম্প্রতিক অতীতে এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদের উপর নির্ভর করে ২০০ বছর প্রাচীন গণতন্ত্রের ভিতকে চ্যালেঞ্জ করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হওয়া। আরও বিভ্রান্তির জন্ম হয় তখন, যখন যে রাষ্ট্রপতি এমন মিথ্যেকে ব্যবহার করে ক্ষমতা দখল করেন, তিনিই আবার তাঁর সমালোচক গণমাধ্যমকে ভুয়ো খবর তৈরির কারখানা হিসেবে আখ্যা দেন। 

আলোচনার এই বিন্দু থেকে উঠে আসে ফ্যাসিবাদী শক্তির আরেকটি আধুনিক অস্ত্রের প্রসঙ্গ। ফেক নিউজ। অভিবাসী এবং ভিন্ন ধর্মের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের ভিত্তিহীন ও কাল্পনিক ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব ছড়ানোর মূল অস্ত্র ছিল ইন্টারনেট। ওয়াকিবহাল মহলের মনে পড়বে যে স্বয়ং ওবামা এই ফেক নিউজের শিকার হয়েছিলেন। ফ্যাসিবাদী ধারণাকে বাস্তবায়িত করা এবং মানুষের মনে দৃঢ়মূল করে দেবার অন্যতম উপায় হল মানুষের মগজ দখল করা - মানুষের মস্তিস্কে উপনিবেশ স্থাপন করা। এই ভয়ংকর প্রবণতা এই মুহূর্তে ভারতের জাতীয় স্বাস্থ্যের পক্ষে সবচেয়ে বিপদ। নোয়াম চমস্কি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন, ভারতের রাজীনীতিতে এখন ফ্যাসিবাদের ভাবধারা ও লক্ষণ উঠে আসছে। যেখানে ট্রাম্প কৃষ্ণাঙ্গ অভিবাসীদের দিয়ে নিজের ব্যর্থতা ঢাকছিলেন, ভারতের সরকার বঞ্চিত শ্রেণির হাতে তুলে দিচ্ছে ধর্মীয় বিভেদের অস্ত্র। তিনি আরও বলেছেন যে মুসলমানদের হাতেই হিন্দুরা বঞ্চিত - এই ধারণা তৈরী করে হিন্দুত্ববাদের জোয়ারে ভাসিয়ে দিচ্ছে গোটা দেশ। মনে রাখতে হবে, ফ্যাসিবাদের জমিতে শুধুই হিংসার চাষ। হিংসা ছাড়া ফ্যাসিবাদ দাঁড়াতে পারে না। এই শক্তি একটা কথা স্পষ্ট করে ঘোষণা করে - তুমি আমার কথায় সায় না দিলে তুমি আমার শত্রু। 


চমস্কি আরেকটি বিষয়েও আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন। ফ্যাসিবাদের  আরেকটি লক্ষণও ভারতে প্রত্যক্ষ হয়ে উঠছে - গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ। তাঁর মতে , এই মুহূর্তে ভারতে গণমাধ্যমও সরকারের সঠিক সমালোচক হয়ে উঠতে পারছে না। বরং একটি অমিত শক্তিশালী আইটি সেল তৈরি করে ভাজপা ও আরএসএস ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপের মতো সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহার করে ভাইরাসের মতো ফেক নিউজ ও ম্যানুফ্যাকচারড ট্রুথ ছড়িয়ে দিচ্ছে ভারতীয় জনতার মনে। দিগভ্রান্ত আত্মধ্বংসী একেকটা প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে এদের হাত ধরে।

আরও পড়ুন : নাটক বন্ধ কর তো! / সৌপ্তিক

এই পরোক্ষ ফ্যাসিবাদী নীতির ভয়ঙ্কর প্রভাব আরেকটি ক্ষেত্রে পড়ছে। তা হল শিক্ষাজগৎ। ইদানিং কালে দেশদ্রোহিতার ফতোয়া করে শিক্ষক ও ছাত্র সমাজের প্রতিবাদী ধারার মুখ বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। প্যারাডাইম চেঞ্জেস বা দৃষ্টান্তের পরিবর্তনের নাম করে একটি বিশেষ হিন্দুত্ববাদী চিন্তাধারাকে ছাত্র রাজনীতির আদর্শ করে তোলার চেষ্টা হচ্ছে। সিলেবাস ও শিক্ষানীতিকে নিজেদের ছাঁচে ঢেলে সাজিয়ে মানুষের চিন্তাভাবনাকে পুরোপুরি দখল করতে চাইছে এরা। মুক্তচিন্তার পথ রুদ্ধ করে দেওয়া এদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য। স্বল্প পরিসরে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই। কিন্তু বলা বাহুল্য, এই রাজনৈতিক ধারাটি সত্যিকারের গণতন্ত্রের টিকে থাকার পক্ষে বিপজ্জনক। আর যে সর্বাত্মক অসহিষ্ণুতার বাতাবরণ আমাদের চারপাশে আজ গড়ে উঠেছে, তাকেও একটা সচেতন নির্মাণ বললে ভুল হয় কি? মুশকিল এটাই যে, মানুষ যখন এর জীবাণু বহন করেন, অসচেতনেই বহন করেন। পাঠক, মিলিয়ে নিতে পারছেন তো আপনার চারপাশের সঙ্গে? ফ্যাসিবাদের লক্ষণই হচ্ছে, সে আপনার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে জীবাণুর মতো মিশে যাবে। উমবের্তো ইকোকে অনুসরণ করে বলা যেতে পারে যে, আমাদের অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে কারণ ফ্যাসিবাদ নানাভাবে আমাদের চারপাশে রয়েছে। আমাদের কর্তব্য হল একে নির্ভুলভাবে চিনে নেওয়া, উন্মোচিত করা এবং এর ফাঁদে পা না দেওয়া। 

[ লেখার মাঝখানের পোস্টারে ব্যবহৃত কার্টুনটি ডেভিড লো-র আঁকা]

............................

[কভার পোস্টারে ব্যবহৃত কার্টুনটি শিল্পী অ্যান্ডি ক্যাম্পবেলের আঁকা। কভার পোস্টার ডিজাইন : অর্পণ দাস ]



#রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন-বিরোধী লেখাগুচ্ছ #জুজু #সিরিজ #series #State Terror #State Violence #Fascism #ultranationalism #dictator #Benito Mussolini #Adolf Hitler #BJP #Narendra Modi #Donald Trump #Amit Shah #মুসোলিনি #হিটলার #নরেন্দ্র মোদি #বিজেপি #মৌমিতা সেনগুপ্ত #সিলি পয়েন্ট #ফ্যাসিবাদ

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

18

Unique Visitors

214980