ফিল্ম/ওয়েব সিরিজ রিভিউ

মন্দার : ম্যাকবেথ, মেদিনীপুর, মির্জাপুর

বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য Dec 3, 2021 at 5:48 am ফিল্ম/ওয়েব সিরিজ রিভিউ

ওয়েব সিরিজ - মন্দার
পরিচালনা - অনির্বাণ ভট্টাচার্য
শ্রেষ্ঠাংশে - দেবাশিস মণ্ডল, সোহিনী সরকার, অনির্বাণ ভট্টাচার্য, দেবেশ রায়চৌধুরী, লোকনাথ দে, সজল মণ্ডল
প্রযোজনা - এসভিএফ এনটারটেনমেন্ট
মুক্তি - ২০২১
মাধ্যম - হইচই

পিত্তি দিয়ে গাঁথব মালা

পচা রজনীগন্ধার

মিলব যেদিন চারজনেতে

আমি, পেদো, কালা, মন্দার।


উইলিয়াম শেক্সপিয়ার যখন পেশাদার মঞ্চের জন্য তাঁর নাটকগুলি রচনা করেন, ইংল্যান্ডে তখন সবেমাত্র আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। ১৬০০ সালের শেষ দিনে তৈরি হয়েছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, মধ্যযুগীয় কৃষি নির্ভরতা পেরিয়ে একটু একটু করে অর্থনীতির মানচিত্রে হাজির হচ্ছে বাণিজ্য। ইংরেজ সমাজ দাঁড়িয়ে আছে এক যুগসন্ধির সামনে - সামন্তপ্রভুরা পারস্পরিক বিবাদ ভুলে বাধ্য হচ্ছেন রাজশক্তির তলায় একত্র হতে। তবে মধ্যযুগের সমস্ত স্বভাব মরেনি মোটেই - ডাকিনী, অপদেবতা প্রভৃতি কুসংস্কার এখনও বহাল তবিয়তে বর্তমান মানুষের মনে। উপরমহলের ক্ষমতাবানদের মধ্যে হিংসার ছড়াছড়ি।

          বর্তমান সমাজে শেক্সপিয়ারের কাহিনি, বিশেষত ট্র্যাজেডিগুলির পুনর্নির্মাণ করবার সময় তাই স্রষ্টাদের মধ্যে গল্পটিকে অপরাধ জগতে নিয়ে গিয়ে ফেলার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়, যাতে কাহিনির পরতে পরতে জড়িয়ে থাকা অবাধ হিংসাকে বিশ্বাসযোগ্য ভাবে উপস্থাপিত করবার কাজ সহজ হয়ে যায়। এই প্রসঙ্গে মনে আসবে উইলিয়াম রেইলির মেন অফ রেসপেকট , বিশাল ভরদ্বাজের মকবুল থেকে সৃজিত মুখার্জির জুলফিকার  প্রভৃতি ছবির কথা। অনির্বাণ সেই চেনা ছকের বাইরে যাননি, তাঁর সিরিজের পটভূমি পূর্ব মেদিনীপুরের কাল্পনিক এক মৎস্যজীবীদের গ্রাম - গেইলপুর। ভেড়ি ব্যবসা, তোলা আদায় এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার আঁতাত ঘিরে যেখানে গুণ্ডামি লেগেই থাকে, অবিচারের বিরুদ্ধে গলা তুলতে গেলেই নামিয়ে দেওয়া হয় লাশ। দাপুটে ভেড়ি মালিক ডাবলু ভাইয়ের (রাজা ডানকান) যাবতীয় গোলমেলে কাজের কাজী মন্দার (ম্যাকবেথ) এবং বঙ্কা (ব্যাঙ্কো), পঞ্চায়েত নেতা মদন ভাই (ম্যাকডাফ) পর্যন্ত তাঁর অনুগামী। ডাবলু ভাইয়ের সঙ্গে তার রগচটা ছেলে মঞ্চার (ম্যালকম) তিক্ত সম্পর্ক মনে করাবেই মির্জাপুর ওয়েব সিরিজের কালিন ভাইয়া ও মুন্না ভাইয়ার কথা। শেক্সপিয়ারের নিঃসন্তান ম্যাকবেথ এখানে যৌন অক্ষম, শরীরের খিদে মেটাবার জন্য তার বউ লাইলিকে (লেডি ম্যাকবেথ) ব্যবহার করে ডাবলু ভাই। লাইলির প্ররোচনায় গেইলপুরের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠার লোভে ডাবলুকে খুন করে মন্দার, তারপর যথারীতি স্বামী স্ত্রী শিকার হয় চরম বিবেকদংশনের। অনির্বাণ গল্পটিকে যে সামাজিক পটভূমিকায় নিয়ে ফেলেছেন, মেদিনীপুরের সেই অঞ্চলে এখনও গ্রামীণ প্রভাব যথেষ্ট, সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতার সঙ্গে স্মার্টফোন মিলেমিশে ভারতের আরও অনেক জায়গার মতই এখানে তৈরি হয়েছে এক খিচুড়ি সংস্কৃতি। মজনু বুড়ি ও পেদোর আধিভৌতিক কার্যকলাপ তাই এমন পরিবেশে দিব্যি মানিয়ে যায়। মন্দার ও বঙ্কার সঙ্গে মজনুর প্রথম সাক্ষাতের দৃশ্যটিতে আকিরা কুরোসাওয়ার কিংবদন্তী থ্রন অফ ব্লাড ছবির প্রভাব সুস্পষ্ট। পুলিশ অফিসার মুকদ্দর মুখার্জি যেন বেড়াল কালার মতোই মজনু ডাইনির আরেক ফ্যামিলিয়ার বা শাগরেদ (মনে করুন মূল নাটকে গ্রেম্যালকিন বা প্যাডকের কথা), মন্দারকে খুনের রাতে ফিরতে দেখার সময় মুকদ্দর নিজেই বলে ওঠে, “অ্যান্ড আই আম আ ক্যাট, মিয়াঁও!”

অনির্বাণের সবথেকে বড় কৃতিত্ব, তিনি শহুরে বাবুদের মনোরঞ্জনের জন্য সরল গ্রামবাসীর একঘেয়ে রোমান্টিক ছবি না এঁকে বাংলার গ্রামীণ সমাজের সত্যিকারের জটিল অবস্থা তুলে ধরবার চেষ্টা করেছেন। মদন বাবুর সংলাপ “শহরে ত পলিটিক্সের হেডলাইট জ্বলে, আসল ইঞ্জিন তো গ্রামে” সেই ভুয়ো রোমান্টিকতার জালকেই টেনে ছিঁড়ে দিতে চায়। সিরিজের প্রথমেই এসেছে সাইক্লোনের ত্রাণ নিয়ে জালিয়াতির কথা। মকাইয়ের চাবির রিংয়ে লেখা 'ইনকিলাব জিন্দাবাদ' দেখে মন্দার যখন বলে ওঠে, 'ইনকিলাব? এটা আবার কোন কিলাব রে?' তা আঞ্চলিক ক্লাবগুলোকে ঘিরে ঘটে চলা অনুদানসর্বস্ব রাজনীতির কথা মনে করিয়ে দেয়। মঞ্চা যখন ভেড়িকর্মীদের আন্দোলন ভাঙতে যায়, তখন তার টি শার্টে জ্বলজ্বল করতে থাকে চে গুয়েভারার মুখ। আপাত নরম স্বভাবের মুকদ্দরের যেখানে সেখানে ইংরিজি প্রয়োগ এক ধরণের উগ্র শহুরে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে, যা তাকে নির্দ্বিধায় গ্রামের সকল নারীকে ভোগ্যবস্তু ভাবতে ইন্ধন যোগায়। শেষে কিন্তু সে নিজেই পা দিয়ে ফেলে আপাত সরল গ্রামের মেয়ে লাকুমনির (লেডি ম্যাকডাফ) পাতা ফাঁদে। এছাড়া রংচঙে ঘরবাড়ি, বর্ণময় জামাকাপড় এবং অমিত কুমারের প্রথম দেখা ছবির ‘ওয়ান টু থ্রি… ও সুন্দরী’র মত আশি নব্বইয়ের দশকের গানের জনপ্রিয়তার মত ছোট ছোট জিনিসের মধ্যে দিয়ে মেদিনীপুরের গ্রামীণ সংস্কৃতি চমৎকার ফুটিয়ে তুলেছেন অনির্বাণ। গোটা সিরিজের সংলাপ লেখা হয়েছে মেদিনীপুরের গ্রাম্য ভাষায়, কলকাতার তথাকথিত সুশীল সমাজের ‘টুম্পা’ ডাকের মুখে মেদিনীপুরের ছেলে অনির্বাণের এটাও একটা থাপ্পড় বইকি!

          তবে মন্দার সিরিজের সবচেয়ে দুর্বল জায়গা পেদোর মৃত্যু ও মজনু বুড়ির বর্শা ছুঁড়ে মন্দারকে হত্যা। সুদীপ্ত ধাড়ার চমৎকার অভিনয় পেদোকে ঘিরে যে অস্বাভাবিক এবং আধা-অলৌকিক বাতাবরণ তৈরি করে, মন্দারের হাতে পেদোর মারা যাওয়া সেটিকে নষ্ট করে দেয়। ডাইনিরা ম্যাকবেথকে মনে আগে থেকেই জন্ম নেওয়া প্রবণতাগুলিকে বাড়িয়ে তোলে মাত্র, নাটকের কোথাও তারা ঘটনা পরম্পরায় সরাসরি অংশগ্রহণ করে না। ম্যাকবেথ ও তার স্ত্রীর সর্বনাশের জন্য ডাইনিদের ছলনা ও তাদের নিজেদের চারিত্রিক দুর্বলতা উভয়েই দায়ী। তাই তো ম্যাকবেথ আজও আমাদের ভাবায়, আমরা না পারি এ নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রকে পুরোপুরি ক্ষমা করতে, না পারি তাকে খলনায়ক বলে সম্পূর্ণ বর্জন করতে। মজনু বুড়িকে মন্দারের ঘাতক বানিয়ে পরিচালক সেই ব্যাঞ্জনাটিকেই একদম ঘেঁটে দিলেন। এছাড়া সিরিজটি মাঝে মাঝেই বড় মন্থর, ঔপনিবেশিক মানসিকতায় দুষ্ট তৃতীয় বিশ্বের পরিচালকরা অনেক সময়েই শেক্সপিয়ারকে নিয়ে কাজ করতে গেলে উচ্ছ্বাসের আতিশয্যে পরিমিতিবোধ হারিয়ে ফেলেন, মন্দার সেখানে ব্যাতিক্রম হতে পারেনি। আর হঠাৎ ডাবলু ভাইয়ের খুনের আগে জুলফিকার ছবির মুহূর্ত দেখিয়ে সৃজিতের প্রতি ঘটা করে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের প্রয়োজন ছিল কি? টালিগঞ্জের শিল্পচর্চা কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরেই বড্ড বেশি পরস্পরের পিঠ চাপড়ানোর বিরক্তিকর মাধ্যম হয়ে উঠছে। 

আরও পড়ুন : শেক্সপিয়রের ম্যাকবেথ ও ভারত-পর্যটনকারী এক জাহাজের কথা / বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য  

           অভিনয়ে সেরা প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে মন্দারের চরিত্রে দেবাশিস মণ্ডল। তরুণ, সুদর্শন এই মঞ্চাভিনেতা এরপর ফ্যামিলি ম্যান মার্কা দু মিনিটের রোলের থেকে বেশি কাজ পাবেন, আশা রাখা যায়। লাইলির চরিত্রে চোখের ভাষাকে দুর্দান্ত কাজে লাগিয়েছেন সোহিনী সরকার। দেবেশ রায়চৌধুরি যথাযথ, শঙ্কর দেবনাথ এর আগে বহুবার সিনেমা সিরিয়ালে ছোট পার্টে নজর কেড়েছেন, বঙ্কার চরিত্র তার ব্যাতিক্রম নয়। আলাদা করে বলতে হবে মদনের ভুমিকায় লোকনাথ দে, ‘লাকুমনি’ দোয়েল রায় নন্দী এবং ফন্টুসের চরিত্রে কোরক সামন্তর কথা। মজনু এবং পেদোর ভূমিকায় সজল মণ্ডল এবং সুদীপ্ত ধাড়াকে নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে, এই প্রশংসা সম্পূর্ণরূপে তাঁদের প্রাপ্য। অনির্বাণ চমৎকার, তবে তাঁর চরিত্রটি বিষয়গতভাবে কাহিনিতে নতুন কিছুই যোগ করে না। সংলাপ ভৌমিকের সম্পাদনা আরও ভাল হতে পারত, অতিরিক্ত দৈর্ঘ্য এই সিরিজের অন্যতম ত্রুটি। সৌমিক হালদারের ক্যামেরা ও সুব্রত বারিকের প্রোডাকশন ডিজাইন প্রশংসার যোগ্য। নজর কেড়েছে সোমনাথ কুণ্ডুর মেক আপ এবং সঞ্চিতা ভট্টাচার্যের পোশাক পরিকল্পনা, মজনু বুড়ি হিসেবে সজল মণ্ডলের ভোলবদলের কথা তো লোকের মুখে মুখে ফিরছে। মন্দার কখনোই নির্ভুল নয়, কিন্তু বিছানাসর্বস্ব শহুরে রমকম বা বাঁধা গতের গোয়েন্দাকাহিনির বাইরে বেরিয়ে হইচই অবশেষে নতুন কিছু করবার চেষ্টা করছে, প্রাপ্তি হিসেবে এটুকুই বা মন্দ কী। 

..................

#ওয়েব সিরিজ #রিভিউ #মন্দার #অনির্বাণ ভট্টাচার্য #হইচই #সিলি পয়েন্ট #ওয়েব পোর্টাল

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

20

Unique Visitors

219128