ফিচার

শেক্সপিয়রের ম্যাকবেথ ও ভারত-পর্যটনকারী এক জাহাজের কথা

বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য July 27, 2021 at 4:37 am ফিচার

A sailor’s wife had chestnuts in her lap,
And munched, and munched, and munched. “Give me,”
     quoth I.
“Aroint thee, witch!” the rump-fed runnion cries.
Her husband’s to Aleppo gone, master o' th' Tiger;
But in a sieve I’ll thither sail,
And like a rat without a tail,
I’ll do, I’ll do, and I’ll do.

উইলিয়াম শেক্সপিয়রের বহুল প্রচলিত ম্যাকবেথ নাটকে এ লাইনগুলো পড়েন নি, এমন সাহিত্য রসিক খুঁজে পাওয়া ভার। প্রথম অঙ্কের তৃতীয় দৃশ্যে প্রথম ডাইনি জানায় তার ফন্দির কথা- নাবিকের বউ তাকে বাদাম খেতে দেয়নি বলে নাবিকের জাহাজ নাজেহাল করে ছাড়বে সে। একটু পরেই ব্যঙ্কোর সাথে অকুস্থলে এসে হাজির হবে সেনাপতি ম্যাকবেথ, ডাইনিদের কাছে জানবে রাজা হবার সর্বনাশা ভবিষ্যদ্বাণী। কিন্তু অনেকেই জানেন না, প্রথম ডাইনির বয়ানে ‘টাইগার’ নামক যে জাহাজের কথা বলা হয়েছে তার আসল পরিচয়। এই জাহাজের সঙ্গে জড়িয়ে আছে লন্ডনের জনৈক ব্যবসায়ী রালফ ফিচের নাম। প্রথম ভ্রমণকারী ইংরেজ হিসেবে স্বদেশে যাঁর সম্মান সবচেয়ে বেশি।

সাল ১৫৮১। ইংল্যান্ডের মসনদে তখন কুমারী রানি প্রথম এলিজাবেথ। সেই সময়ে লন্ডন শহরে ব্যাঙের ছাতার মত রাতারাতি গজিয়ে ওঠা একের পর এক ব্যবসায়ী সমিতির একটির সদস্য ছিলেন স্যার এডওয়ার্ড অসবোর্ন আর রিচার্ড স্ট্যাপার নামে দুই ভদ্রলোক। তাঁরা সদ্য হলফনামা পেয়েছেন তুরস্কে ব্যবসা করবার। অনেক বলেকয়ে সেটাকে বাড়িয়ে নিলেন ভারতবর্ষ অবধি। ভারতবর্ষ তখন পরিচিত সোনার দেশ বলে। ভারতীয় পণ্যে বোঝাই পর্তুগিজ জাহাজ দেখে চোখ টেরিয়ে যাচ্ছে ব্রিটিশ নাবিকদের। সেই ভারত না যেতে পারলে হয় নাকি? এবার তাঁরা খুঁজতে  লাগলেন এমন একজন লোককে, যে ডাঙা পথে ঘুরে আসতে রাজি হবে ভারতবর্ষের ভিতরটা। পাওয়া গেল জন নিউবেরী নামের এক ব্যক্তিকে। তুরস্ক, পারস্য আর আরব দেশ ঘুরে তিনবছর পর সবেমাত্র দেশে ফিরেছেন। নতুন অভিযানের কথা শুনেই লাফিয়ে উঠলেন তিনি। নিউবেরীর পকেটে মোগল সম্রাট আকবরকে লেখা খোদ রানি এলিজাবেথের চিঠি, সঙ্গে আরো তিন সহযোগী- উইলিয়াম লীডস, জেমস স্টোরী আর রালফ ফিচ। জাহাজের নাম? আজ্ঞে হ্যাঁ, ‘টাইগার’।

আরও পড়ুন : ফ্যাসিবাদ রুখতে গুপ্তচর হয়েছিলেন নোবেলজয়ী হেমিংওয়ে / সায়নদীপ গুপ্ত

ফিচকেই দেওয়া হয়ে থাকে ভারতে প্রথম ইংরেজ পর্যটকের সম্মান। নিজে ঘুরে দেখেছেন ভারতবর্ষের দশ দিক। দেশে ফিরে লিখেছেন সেই কাহিনি। প্রথমে বিশেষ পাত্তা না পেলেও পরে ফিচের লেখা হয়ে ওঠে ব্রিটিশ পর্যটক সম্প্রদায়ের যাবতীয় উদ্যম উৎসাহের প্রধান উৎস। ফিচ যাত্রা শুরু করেছিলেন ১৫৮৫ সালে, দেশে ফেরেন ১৫৯১ খ্রিস্টাব্দে। গোয়ায় পা দিয়েই গুপ্তচর সন্দেহে তাঁর ঠাঁই হয় পর্তুগিজ বন্দিশালায়। ফাদার স্টিভেন্সের দৌলতে অনেক কষ্টে মুক্তিলাভ করে বেরিয়ে পড়েন ভারত ভ্রমণে। গোয়া থেকে বিজাপুর, সেখান থেকে গোলকুণ্ডা, তারপর আগ্রায় মহামহিম আকবর বাদশার দরবারে। আগ্রা থেকে নৌকোয় প্রয়াগ, কাশী, পটনা ঘুরে গৌড়। তারপর একে একে হুগলি, সপ্তগ্রাম, কুচবিহার, চট্টগ্রাম। প্রতিটি স্থান সম্পর্কে দিয়েছেন বর্ণনা, রেখেছেন নিজস্ব মতামত। লক্ষ্য করেছেন প্রত্যেকটি জায়গার স্থাপত্য, জনজীবন, বেশভূষা, রীতিনীতি। ঠিক যেমনটা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন ফ্রান্সিস বেকন তাঁর বহুল প্রচলিত ‘অফ ট্র্যাভেল’ প্রবন্ধে। ফিচ লিখছেন, গোয়ার গ্রামগুলো যেন পটে আঁকা ছবি। প্রত্যেক বছরের সেপ্টেম্বরের গোড়ার দিকে চার-ছ’খানা জাহাজ গোয়ায় আসে পর্তুগাল থেকে, চল্লিশ পঞ্চাশ দিন কাটিয়ে চলে যায় কোচিনে। সেখানে জাহাজ বোঝাই করে মরিচ আর লঙ্কায়। সাধে ষোড়শ শতাব্দীর ব্রিটিশ নাটকে অহরহ গুণগান রয়েছে ভারতীয় মশলার! বিজাপুর পৌঁছে লিখছেন, এখানে সব পরিবারই নাকি সোনা রুপো জমায়। মছলিপত্তমের মূল আকর্ষণ সেই মরিচ আর মশলা, ভারতবর্ষের যাবতীয় পণ্য এসে জমা হয় এখানকার বন্দরে। জাহাজ আসে পেগু আর সুমাত্রা থেকে।

আরও পড়ুন : শিল্পসমালোচনা থেকে ভ্রমণবৃত্তান্ত : ত্রৈলোক্যনাথের অচর্চিত বইপত্রের সন্ধানে / বিদিশা বিশ্বাস

আকবর শাসিত বেরহামপুরে বসে ফিচ লিখছেন, এখানকার একটা টাকায় যে পরিমাণ খাঁটি রুপো থাকে, ইংল্যান্ডে তার দাম হবে কুড়ি পেন্স। আগ্রার চেয়ে ফতেপুর আরো সুন্দর, পরিচ্ছন্ন। আগ্রা আর ফতেপুর মিলিয়ে সম্রাট আকবরের পশুশালায় আছে এক হাজার হাতি, ত্রিশ হাজার ঘোড়া, চোদ্দোশো হরিণ, প্রচুর চিতাবাঘ, নানা জাতের মহিষ এবং অসংখ্য বাজপাখি। ফিচের মতে ফতেপুর এবং আগ্রা, লন্ডন শহরের চেয়ে অনেক বড় ও অনেক বেশি জনবহুল। বারাণসীতে হিন্দু বিগ্রহের পূজা দেখে অবাক হয়ে লিখেছেন, এখানে বাঘ সিংহ হনুমান এমনকী ময়ূরেরও পুজো হয়। বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন সপ্তগ্রাম বাণিজ্যকেন্দ্রের। অভিযান সেরে দেশে ফিরে আসবার পর খোদ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ফিচকে তাদের পরামর্শদাতা হিসেবে বহাল করে। ফিচ যেভাবে এই বিশাল ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখে বর্ণনা করেছেন, জন ওভিংটনের আধা লোকমুখে শুনে আধা নিজে বানিয়ে লেখা ভারতবর্ষের আট ফুট লম্বা বিশাল দাঁতওয়ালা মানুষের আষাঢ়ে গপ্পের চেয়ে ঐতিহাসিক ও গবেষকদের কাছে তা ঢের বেশি মূল্যবান। আধুনিক ইউরোপীয় বাণিজ্যের উত্থান এবং প্রাক আধুনিক ভারতবর্ষের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে ফিচের ভ্রমণকাহিনির গুরুত্ব অনস্বীকার্য।  


.....................................



# ফিচার #বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য #সিলি পয়েন্ট #ওয়েবজিন #web portal #William Shakespeare #Macbeth

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

29

Unique Visitors

219143