ফ্যাসিবাদ রুখতে গুপ্তচর হয়েছিলেন নোবেলজয়ী হেমিংওয়ে
গোধূলির শেষ আলোয় জনা তিরিশেক ছায়ামূর্তি হেঁটে চলেছে রুক্ষ, পাহাড়ি প্রান্তর ধরে। আরেকটু এগোলেই শত্রুসীমানা শুরু, তার ওপারেই আছে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য। জিলোকা নদীর উপর রেলওয়ে ব্রিজ। সীমানা পেরিয়ে কয়েকজন এগিয়ে গেল ব্রিজের নিচে, বাকিরা তাদের সুরক্ষায় সজাগ। শুধু একজন মানুষ ওই অন্ধকারেও বাকিদের থেকে আলাদা, তার হাতে বন্দুকের বদলে একটা ক্যামেরা। দলপতি বারবার সাবধান করে দিয়েছে ফ্ল্যাশ ব্যবহার না করতে, তাই ইচ্ছা থাকলেও সে ক্যামেরা আপাতত কোনও কাজে আসছে না। হঠাৎ নিস্তব্ধতার বুক চিরে ভেসে এল দূরাগত রেলগাড়ির আওয়াজ। ব্রিজের কাছে আসতেই সশব্দ বিস্ফোরণে চারদিক কেঁপে উঠল, জিলোকার বুকে ছিটকে পড়ল রেলগাড়ির টুকরো আর ব্রিজের অবশেষ। আর সেই আলোর ঝলকানি পুষিয়ে দিল ফ্ল্যাশের অভাব।
নিশ্চয়ই এই ঘটনা কোনও গল্প বা সিনেমার চিত্রনাট্য? স্থান স্পেনের গৃহযুদ্ধ, কাল ১৯৩৭-এর আশেপাশে আর পাত্র হেমিংওয়ে হলে বাস্তবও গল্পের মতোই রোমহর্ষক শোনায় বটে। আজ্ঞে হ্যাঁ, ওই মানুষটি স্বয়ং আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। মূলত নোবেলজয়ী সাহিত্যিক বলেই তাঁকে আমরা চিনি, কিন্তু যুদ্ধ-সাংবাদিক হিসেবেও তাঁর যথেষ্ট কদর ছিল। স্পেনে তখন রিপাবলিক সরকারের সঙ্গে জেনারেল ফ্র্যাঙ্কোর ফ্যাসিবাদী সেনার ক্ষমতা দখলের লড়াই। তার মধ্যে অনেক আমেরিকান সাহিত্যিক ও সাংবাদিক গিয়ে হাজির হয়েছেন যুদ্ধের সার্বিক ছবিটা তুলে ধরতে। তবে হেমিংওয়ের উদ্দেশ্য একটু আলাদা। ততদিনে তিনি কট্টর ফ্যাসিবাদ-বিরোধী, কিন্তু ঘরের কোণে বসে সমালোচনা করা তাঁর বিলকুল না-পসন্দ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্তন সেনানী আর্নেস্ট তাই ফ্যাসিবাদের বিকৃত রূপ উন্মোচনের জন্য সমমনস্ক কিছু শিল্পী-সাহিত্যিকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তৈরি করেছেন এক সংগঠন, যার মুখ্য উদ্দেশ্য হল স্পেনের মাটিতে জেনারেল ফ্র্যাঙ্কোর বর্বরতা নিয়ে এক বা একাধিক ডকু-ফিচার বানানো। এই করতে গিয়েই তিনি এমন কিছু মানুষ এবং আদর্শের সংস্পর্শে এলেন যা তাঁর জীবনের বাকি পথটা সুনির্দিষ্ট করে দিল।
স্পেনের সেই টালমাটাল অবস্থায় একমাত্র সহায় ছিল সোভিয়েত রাশিয়া। শুধু অস্ত্র বা অর্থ দিয়েই নয়, সাহায্য এসেছিল কুখ্যাত সোভিয়েত গুপ্তচরবাহিনী NKVD-র হাত ধরেও, পরে যাদের নাম পাল্টে হয় KGB। অন্যের ঘরের বিবাদে আমেরিকা সেইসময় নাক গলাতে চায়নি, সে তখনও বছর দুয়েক আগের ভয়াবহ হারিকেনের ক্ষত শুকোচ্ছে। আর সেই হারিকেনের সময় সরকারি অপদার্থতার নজির দেখে আমেরিকান প্রশাসনের উপর তিতিবিরক্ত হেমিংওয়ের মনে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের আদর্শ জাঁকিয়ে বসতে বিশেষ বেগ পায়নি। এমনিতে ফিল্ম তৈরির উদ্দেশ্যে যে সংগঠন গড়ে উঠেছিল, তাতেও অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী ছিলেন বাম মনোভাবাপন্ন, তবে হেমিংওয়ের মতো প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং লড়াকু ছিলেন না কেউই। পরপর বেশ কয়েকবার স্পেনে যাওয়ার সুবাদে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা হয়েছিল তাঁর। কখনও বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া গাড়ি থেকে অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে এসেছেন, কখনও বোমায় আহত মানুষকে দেখে সাংবাদিকের খোলস ছেড়ে ফার্স্ট-এইড কিট হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। এইসবের মাঝেই তাঁর সঙ্গে সখ্য বাড়ে জরিস ইভেন্সের। খাতায়-কলমে জরিস ইভেন্স ফ্যাসিবাদ-বিরোধী ডকু-ফিচারের পরিচালক, কিন্তু গোপনে তিনি ছিলেন সোভিয়েত দেশের আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট শাখার এক প্রধান সদস্য। ফ্যাসিবাদ নামক ক্যানসারে কমিউনিজমই একমাত্র ওষুধ, একথা তিনি বন্ধু আর্নেস্টের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। ফলত, গৃহযুদ্ধের মাঝে যখন সোভিয়েত সেনার গুপ্তহত্যা, শ্রেণিশত্রু নির্বাচন ইত্যাদি বিষয়গুলি নিয়ে ক্রমাগত প্রশ্ন উঠছে, হেমিংওয়ে তখনও তাদের সপক্ষে দাঁড়িয়ে পরিচিত বন্ধুদের সঙ্গে ঝগড়া-হাতাহাতি পর্যন্ত করেছেন। পরিস্থিতি খানিক পালটায় ফ্র্যাঙ্কোর জয়ের পর, হতাশ হেমিংওয়ের চোখে রিপাবলিক সরকারের ব্যর্থতার জায়গাগুলো আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়।
সোভিয়েত কর্তারাও ভাবলেন, এই সুযোগে যদি হেমিংওয়েকে আরেকটু সক্রিয় করে তোলা যায়। নির্দেশমতো লেখকের সঙ্গে একান্তে সাক্ষাৎ করলেন জেকব গোলোস। গোলোস ছিলেন আমেরিকার মাটিতে গেঁড়ে বসা এক সোভিয়েত স্পাই। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল খুবই সরল। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের মতো ব্যক্তি যদি লেখায়, কথায় তাদের আদর্শ তুলে ধরেন আর মাঝেসাঝে সাংবাদিকতার খাতিরে দেশবিদেশের যুদ্ধে যেতে হলে রাজনৈতিক খবরাখবর যদি সোভিয়েত অবধি পৌঁছে দেওয়া যায়। কিন্তু সে যোগাযোগ হবে কীভাবে? জেকবের কথামতোই তাঁকে কিছু কিউবান পোস্টাল স্ট্যাম্প দিলেন হেমিংওয়ে, যার জুড়িদার স্ট্যাম্প রইল তাঁর নিজের কাছে। অচেনা কেউ এসে সেই জুড়ি দেখালেই তিনি বুঝে যাবেন সে খোদ মস্কোর লোক।
এমন ভাবার কারণ নেই যে তিনি কোনও গর্হিত কাজ করছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখনও ভবিষ্যতের গর্ভে। আমেরিকার স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হচ্ছে না কোনোভাবেই। বস্তুত কট্টর দেশভক্ত লেখকের কাছে এই কাজটা ছিল ফ্যাসিবাদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই, যে লড়াই তাঁর নিজের দেশ সেই মুহূর্তে যেচে পড়ে লড়তে রাজি ছিল না আর উল্টোদিকে সোভিয়েত তখন একমাত্র প্রতিবাদী স্বর। উপরন্তু যুদ্ধের আবহে গুপ্তচরবৃত্তির অ্যাড্রেন্যালিন ছিল বাড়তি পাওনা। দ্বিতীয়া স্ত্রী মার্থা গেলহর্নের সঙ্গে তখন চিনে যাওয়ার তোড়জোড় করছেন তিনি, সেখানে চিয়াং কাই-শেকের কুওমিনতাং আর মাও সে তুং-এর কমিউনিস্ট পার্টি একযোগে জাপানি আগ্রাসন প্রতিহত করতে ব্যস্ত। তারই মধ্যে চলছে নিজেদের মধ্যে ক্ষমতা দখলের চোরাগোপ্তা সংঘর্ষ। মজার কথা, তাঁর চীনযাত্রার কিছু আগে পরিচিত রাজনৈতিক বৃত্ত মারফৎ রুজভেল্ট প্রশাসনের তরফে অনুরোধ এল খ্যাতনামা লেখক যদি সাংবাদিকতার সূত্রে সে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ডামাডোলটা একটু জেনে আসেন।
শুধু স্পাই নয়, একেবারে ডবল এজেন্ট!
চেষ্টার কসুর রাখেননি আর্নেস্ট। চিয়াং কাই-শেকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, রীতিমতো স্পাই-মুভির মতো ব্যবস্থাপনায় আলাপ করেছেন মাও-এর ডান হাত চৌ এন-লাইয়ের সঙ্গে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনেছেন সে দেশের হাল-হকিকত। তবু একবারও সেই স্ট্যাম্পের জুড়ি কাজে আসেনি - না চিনে, না বাকি জীবনে! যদিও সোভিয়েতের খাতায় তাঁর নামে গুপ্ত সংকেতও লিপিবদ্ধ হয়েছিল – আর্গো; তবু কোনও এক অজ্ঞাত কারণবশত আর্নেস্টের সোভিয়েত গুপ্তচরবৃত্তির যাত্রা মাঝপথেই ভেস্তে যায়। সম্ভবত রাশিয়ান কমিন্টার্ন বুঝতে পেরেছিল যে হেমিংওয়ের ফ্যাসিবাদ-বিরোধিতার সুতীব্র প্যাশনের ছিটেফোঁটাও কমিউনিজমের আদর্শের জন্য বরাদ্দ ছিল না। তাছাড়া চিনে থাকাকালীনই সোভিয়েত-জার্মানি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যা গোটা বিশ্বের কমিউনিস্ট ও সমাজতান্ত্রিক সমর্থকদের কাছে ছিল একটা বড় ধাক্কা। দেশে ফিরে হেমিংওয়ে গুছিয়ে চিঠি লিখলেন আমেরিকার মুখ্য অর্থসচিবকে, চীনের আসন্ন গৃহযুদ্ধের আভাস দিয়ে বিস্তারিত বিবরণ জানালেন। হাজার হোক, দেশের অনুরোধের কাছে তিনি দায়বদ্ধ। আর এই দায়বদ্ধতার চক্করেই তিনি আবার জড়িয়ে গেলেন চরবৃত্তির খেলায়, এবার একটু অন্যভাবে।
মোটামুটি ১৯৪১ নাগাদ আর্নেস্ট ও মার্থা কিউবার সৈকতের কাছে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন। জার্মানির হাঁকডাকে তখন আরেক বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে গেছে। জাপানি বিমান আছড়ে পড়েছে পার্ল হারবারের উপর। হাভানার আমেরিকান দূতাবাসের সঙ্গে হেমিংওয়ের ছিল যেমন সখ্যতা, তেমনই দুচক্ষে সহ্য করতে পারতেন না সেখানকার FBI কর্মীদের। দূতাবাসকে তিনি জানালেন নিজের প্ল্যান – কিউবার বুকে ফ্যাসিবাদী চক্রী ও চরদের খুঁজে বের করার জাল বিস্তার! অন্য কেউ হলে হয়তো পাগলের প্রলাপ বলে উড়িয়ে দিত, কিন্তু মার্কিন রাষ্ট্রদূত স্প্রুইলি ব্র্যাডেন দেখলেন মেজাজি, খোলামেলা ভাবমূর্তির হেমিংওয়ে নাবিক থেকে নেতা সব দরবারেই সমান স্বচ্ছন্দ। এলাকাভিত্তিক খবর বের করার জন্য তাঁর চাইতে যোগ্য লোক আর হয় না। তাঁর মদতে হেমিংওয়ে চালু করলেন কুড়ি-পঁচিশজনের গোপন মিশন – ‘The Crooked Factory’। কোনোরকম প্রশাসনিক তকমা ছাড়া এবং FBI-এর তীব্র আপত্তিতেও একটানা কাজ চালিয়ে যায় ক্রুকেড ফ্যাক্টরি। সেইসময়ের এমব্যাসি মিনিট্স থেকে জানা যায়, R-42 নামের এক এজেন্ট হাভানা থেকে তিরিশ মাইল দূরে ডেরা বেঁধে নিয়মিত হেমিংওয়েকে খবর পাচার করত। কিন্তু একবছরের মাথায় এই উদ্যোগেও দাঁড়ি পড়ে। হেমিংওয়ে কাজ করতেন আবেগের বশে, তাঁর নেতৃত্ব সবাইকে আকর্ষিত করলেও সেই অর্থে দীর্ঘমেয়াদি কোনও ছক মেনে এগোতে পারতেন না। কাজেই আবেগ স্তিমিত হতেই মিশনের মেয়াদ ফুরোয়, যদিও মার্কিন দূতাবাস নিজেদের রিপোর্টে এদের কর্মকাণ্ডকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছিল।
আরও পড়ুন : আগল ভাঙার দূত : ভারতের প্রথম মহিলা আইনজীবী কর্নেলিয়া সোরাবজী / টিম সিলি পয়েন্ট
হেমিংওয়ে অবশ্য এর মধ্যে পেয়ে গেছেন অ্যাড্রেন্যালিনের নতুন রসদ। সুদক্ষ এই নাবিকের অন্যতম শখ ছিল মাছধরা। সেই সুবাদে ‘পাইলার’ নামে একখানা নৌকা বানিয়েছিলেন তিনি, যাকে মিনি-ক্রুজ বললেও অত্যুক্তি হতো না। সেইখানা নিয়ে তিনি কিউবান সমুদ্র জুড়ে মার্কিন নৌসেনার হয়ে নজরদারি শুরু করলেন। বরাবরের মতো এখানেও কাজে লাগল তাঁর বন্ধুভাগ্য; লেফটেন্যান্ট জেনারেল জন থমসন তাঁর হয়ে কথা বললেন ব্রাডেনের সঙ্গে। হেমিংওয়ের প্রস্তাব ছিল সাংঘাতিক – উপকূল ধরে জার্মান নৌবহরের সন্ধানে নজরদারি চালানো আর শত্রু সাবমেরিনের দেখা পেলে অতর্কিতে আঘাত হেনে তার ইউ-বোট ধ্বংস করে দেওয়া। সেইসময় জার্মান সাবমেরিনের আতংক গোটা মার্কিন নেভির অন্তরে এমন গেঁড়ে বসেছিল যার ফলে এই প্রস্তাব যে আদতে পাগলামি, ইউ-বোটের বিশালতা ও অস্ত্র-সম্ভারের কাছে পাইলার যে আদপেই খড়কুটো – সেকথা বুঝেও তারা ছাড়পত্র দেয়। সঙ্গে দেয় প্রয়োজনীয় যুদ্ধাস্ত্রের সহযোগিতা। প্রায় একবছরের এই সমুদ্রচষা মিশন, যার পোশাকি নাম ছিল অপারেশন ফ্রেন্ডলেস, খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি। মাত্র একবার তাঁরা জার্মান সাবমেরিনের একেবারে সামনাসামনি এসেছিলেন, কিন্তু ইউ-বোটে হামলার স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। এরপরে ফ্রান্স-বেলজিয়াম জুড়ে জার্মানির সঙ্গে মিত্রশক্তির যুদ্ধের খবর সংরহের কাজে বিস্তর ছোটাছুটি করে যখন হেমিংওয়ে আবার ঘরে ফেরেন তখন তাঁর ভগ্ন স্বাস্থ্য, বিবাহবিচ্ছেদ এবং তৃতীয় বিবাহ, গুপ্তচরবৃত্তি থেকে তাঁকে বহুদূর সরিয়ে দিয়েছে।
আরও পড়ুন : রেডিয়াম গার্লস: বিজ্ঞান ও ব্যবসার কালো দাগ / সায়নদীপ গুপ্ত
এত উদ্দীপনা আর উৎসাহ শেষ অবধি কোথায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করায় আর্নেস্ট হেমিংওয়ে মানুষটাকে? এটুকু নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এই সমস্ত স্বল্পমেয়াদী উত্তেজনার পিছনে যতটা দায়ী যুদ্ধফেরত অস্থির প্রাণপ্রাচুর্য এবং আবেগ, ততটাই অনুঘটকের কাজ করেছে তাঁর একরোখা ফ্যাসিবাদ-বিরোধিতা। সময়ে সময়ে সে বিরোধিতা এতটাই উগ্র যে বিকল্প শক্তির হাতে ব্যক্তিস্বার্থ ক্ষুণ্ণ হচ্ছে কিনা, সে প্রশ্নকেও পাত্তা দেননি তিনি। অথচ এত উগ্রতা সত্ত্বেও সমর-কৌশল সম্পর্কে তাঁর ধীশক্তি ছিল আশ্চর্যরকম ধারালো। চিন-ভ্রমণের শেষে ঘরে ফেরার সময় পার্ল হারবারে সারিসারি যুদ্ধবিমান দেখে সরাসরি খেদ জানিয়েছেন, মার্থাকে লেখা চিঠিতে বলেছেন এ তো প্রকারান্তরে শত্রুর হাতে খাবার তুলে দেওয়া। একবছর না ঘুরতেই সে কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলেছে। ফ্রান্সে মিত্রশক্তির সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে নিজস্ব পেট্রোলিং জিপ নিয়ে তদারকি করে এসেছেন প্যারিসে ঢোকার সেফ-প্যাসেজ। মূলত সেই কৌশলের ভিত্তিতেই তাঁদের ট্রুপ বিনা বাধায় প্যারিসে ঢুকে যায়। আবার এই মানুষটাই, ঠান্ডা যুদ্ধের আবহে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্য রূপ প্রত্যক্ষ করে ভিতর ভিতর ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন, আমেরিকার মাটিতে সোভিয়েত গুপ্তচরদের কথা ফাঁস হয়ে যেতে ভয়ে মরেছেন যে এই বুঝি কেউ তাঁর নাম নিল! নিজের সেই কিউবান স্ট্যাম্পের অতীত আর এফবিআই-ভীতি নোবেল পাওয়ার পরেও তাঁকে ডিপ্রেশনের অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে, যার সর্বশেষ পরিণতি মানসিক চিকিৎসা ও আত্মহত্যা।
ইতিহাস তাঁকে সাহিত্যের সর্বোচ্চ সম্মান দিয়েছে, বর্তমানের কাছে তাঁর প্রতিবাদের ভাষ্য আরও বেশি প্রয়োজন।
....................................
তথ্যসূত্র - 'Writer, sailor, soldier, spy', Nicholas Reynolds