রেডিয়াম গার্লস: বিজ্ঞান ও ব্যবসার কালো দাগ
আমেরিকার ইলিনয় প্রদেশের এক সমৃদ্ধ শহর, ওটাওয়া। শহরের মাঝখানে যেখানে ক্লিন্টন স্ট্রিট আর জেফারসন স্ট্রিট কাটাকুটি খেলেছে, সেইখানে গেলে আপনি দেখতে পাবেন একটা ব্রোঞ্জের মূর্তি। একটি অল্পবয়সী মেয়ে, ফুলহাতা ব্লাউজ-শার্ট আর হাঁটু-ছাড়ানো স্কার্টের ফ্যাশনে ফেলে আসা সময়ের ছাপ। এক হাতে পেইন্ট-ব্রাশ আর অন্য হাতে টিউলিপ নিয়ে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে একটি ঘড়ির ডায়ালের উপর। রেডিয়াম গার্ল।
রেডিয়াম। বিশ শতকের শুরুর দিকের অন্যতম চর্চিত আবিষ্কার। ১৮৯৮ সালে মেরি কুরি ও পিয়ের কুরি এর সন্ধান দেওয়ার বছর দশেকের মধ্যেই রেডিয়ামকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংস্থা গজিয়ে ওঠে। ক্যানসার চিকিৎসায় এর গুরুত্ব টের পাওয়ার পর থেকেই রেডিয়াম আবিষ্কার প্রায় আগুন আবিষ্কারের সমান মর্যাদা পেতে থাকে, যার ফল দাঁড়ায় ভয়াবহ। রেডিয়ামের তেজস্ক্রিয়তা সম্পর্কে জানা থাকলেও তার প্রভাব নিয়ে কারও কোনও ধারণাই ছিল না, তাই এর যথেচ্ছ ব্যবহারে লাগাম পরানোর কথাও ভাবেনি কেউ। ওষুধ থেকে ওডিকোলন, দাদের মলম থেকে দাঁতের মাজন – নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় রেডিয়াম ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র। নেহাত উপকরণটি দুর্লভ, তাই সব পণ্যের দাম সবার সাধ্যে কুলায় না। যাদের সাধ্য আছে, তাদের জন্য বাজারে এল রেডিয়াম-স্পা, রেডিয়াম-লাইনিং দেওয়া কাচের বোতল। বলা হল, নিয়মিত তেজস্ক্রিয়তা সেবনে দূর হবে শরীরের সব ব্যাধি, ফিরে আসবে হারানো যৌবনের স্বাদ। রীতিমতো বড়লোকদের শৌখিনতার প্রতীক হয়ে উঠল এর হালকা সবুজ আভা। সেই সময় রেডিয়ামের দ্রব্যগুণ নিয়ে আদিখ্যেতা এমন চরমে উঠেছিল, দেখলে মনে হবে স্বয়ং শঙ্কু বুঝি মিরাকিউরল ধরিয়ে গেছেন।
পনেরো বছরের জন্মদিনের হপ্তাখানেক আগে ক্যাথরিন শওব যখন নিউ জার্সির নেওয়ার্ক শহরের এক কারখানায় পা রাখল, তখন আমেরিকা সদ্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগুনে সেঁকছে। নামে কারখানা হলেও কাজ যথেষ্ট সম্মানজনক, হাড়ভাঙা খাটুনি তো নেই-ই উপরন্তু পয়সাকড়িও মন্দ নয়। সংস্থার পোশাকি নাম “রেডিয়াম লুমিনাস মেটেরিয়ালস্ কর্পোরেশন”; পকেটঘড়ি, হাতঘড়ি, বিমান আর জাহাজের কম্পাসঘড়ি বানায় এরা। যে সে ঘড়ি নয়, তার ডায়ালে সময় লেখা হয় রেডিয়াম দিয়ে, নিকষ অন্ধকারেও জ্বলজ্বল করেন মহাকাল। ছোটো ডায়ালের নম্বরে রেডিয়াম বোলানো যন্ত্রের কম্মো নয়, সূক্ষ্ম কাজে চাই কমনীয় আঙুল। তাই কাজের ধরন অলিখিত ভাবেই “লেডিস ওনলি”। প্রথম দিন সবকিছু ছাপিয়ে দুচোখ ভরে ক্যাথরিন শুধু একটাই জিনিস দেখেছিল – সহকর্মীদের গায়ে-মাথায়, ঘরের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা এক স্বর্গীয় সবুজাভ আভা। রেডিয়াম। এতদিন সে শুধু এই সর্বরোগহর, সর্বদুঃখনাশক ঈশ্বরের নাম শুনেছে, ১৯১৭-এর সেই সকালে প্রথম তাকে ছুঁয়ে দেখল।
একটা বড় হলঘরে সারি সারি ডেস্ক, মেয়েরা বসে নিবিষ্ট চিত্তে ডায়াল এঁকে চলে শিল্পীর দক্ষতায়। হাতে উটের লোমের সরু তুলি আর সামনে বাটিতে রাখা আঠা আর রেডিয়াম মেশানো জিঙ্ক সালফাইড গুঁড়ো। একেকটি কাঠের ট্রে-তে চব্বিশ থেকে আটচল্লিশটি ডায়াল, দক্ষতম শিল্পীরা দিনে আট-দশটি ট্রে নামিয়ে ফেলেন সহজেই, বাড়তি পয়সাও মেলে। ক্যাথরিনকে হাতে ধরে দক্ষতার পাঠ দিলেন প্রশিক্ষক। ছোট-ছোট ডায়ালে আরও ছোট সংখ্যা, তুলির সূক্ষ্মতাই সেখানে শেষ কথা। কিন্তু তুলি, তা সে যতই সরু হোক, রয়েছে তার ছড়িয়ে যাওয়ার রোখ! বারংবার ব্যবহারে ছড়িয়ে যাওয়া তুলির মাথাকে বশ করার চলতি উপায় লিপ-পয়েন্টিং, অর্থাৎ প্রত্যেকবার রেডিয়াম রং করে তুলির মাথা মুখে দিয়ে সরু করে নেওয়া।
“Lip, dip and paint”.
শুরুর দিকের কর্মীরা কিন্তু-কিন্তু করেছিল বটে; সুপারভাইজার তাদের বলেন, যে ম্যাজিক মেডিসিনের তৎকালীন বাজারদর ১২০,০০০ ডলার/গ্রাম, তা যদি বিনামূল্যে সামান্য পরিমাণে শরীরে ঢোকে, লাভ বেশি না ক্ষতি বেশি? তাই পুরোদমে চলতে থাকে লিপ-পয়েন্টিং। যুদ্ধের বাজারে ব্যবসা যত ফুলে-ফেঁপে উঠল, নিত্যনতুন শাখা গজালো পাড়ায় পাড়ায়। উপচে পড়ল ডায়াল-শিল্পীদের ভিড়, বাড়ল কাজের চাপ। টেবিল থেকে মাথা তোলার ফুরসত নেই, রং-মাখা হাতেই কোনোরকমে টিফিন সারতে হয়। আর এইসবের মাঝে রেডিয়াম ছড়িয়ে পড়ল আরেকটু, আরেকটু বেশি।
কোম্পানির মাথা ডঃ সাবিন ভন সোচোকি এক অস্ট্রিয়ান রেডিয়াম-বিশেষজ্ঞ, যাঁর প্রশিক্ষক ছিলেন স্বয়ং কুরি-দম্পতি। সেই সুবাদেই রেডিয়ামের অজানা ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা ছিল ডঃ সোচোকির। তাই সংস্থার গবেষণাগারের কর্মীদের সুরক্ষার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা ছিল। তবু অদ্ভুত এক মোহে তিনি নিজে ছিলেন চূড়ান্ত অনিয়মী। রেডিয়ামের টিউব পকেটে নিয়ে ঘুরতেন সেমিনার থেকে ক্লাসরুম, সব জায়গায়। কাজের ফাঁকে মনের আরামের জন্য তাকিয়ে থাকতেন সেই অপার্থিব সবুজ আভার দিকে। বাড়াবাড়ির ফলে খুইয়ে ছিলেন বাঁ হাতের তর্জনীর অংশবিশেষ, কিন্তু মোহ কাটেনি। তাঁর সহকর্মী, অধস্তন কর্মচারী বা সংবাদমাধ্যম, কেউ অবশ্য এইসব খবর রাখেনি। তারা শুধু দেখেছে রেডিয়াম হাতে ভন সোচোকির ব্যক্তিত্ব। তাই রেডিয়াম হয়ে দাঁড়িয়েছিল পৌরুষের দৃপ্ত প্রতীক।
যুদ্ধ বাড়ে, রেডিয়ামের চাহিদা হয় আকাশছোঁয়া, কিন্তু প্রকৃতি কৃপণ। সতর্কবার্তা এল কর্মীদের কাছে, রেডিয়াম নষ্ট করা চলবে না। টেবিল থেকে সরে গেল জলের বাটি, ওতে বারবার তুলি ডোবালে একটু করে রেডিয়াম গুলে নষ্ট হয়। উপায় নেই, তাই তুলির ডগা মুখে উঠল আরেকটু বেশি। কাজের শেষে সবার পোশাক ঝেড়ে যতটুকু রেডিয়াম গুঁড়ো বেরত, তা চলে যেত রং বানাতে। তারপরেও, রাতের অন্ধকারে মেয়েদের নগ্ন শরীর থেকে বিচ্ছুরিত হতো সবুজ আভা। দৈবিক না দানবিক – সেকথা তখন ভাবার অবসর ছিল না।
সাল ১৯১৯, শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত। বিপুল সংখ্যক আমেরিকান পুরুষ ঘরে ফিরছে এবং পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বেকারত্ব। কাজের সু্যোগ কমতে থাকায় কমল রোজগার, ডায়াল-শিল্পীরা অনেকেই অন্য জায়গায় কাজ খুঁজে নিল। হেজেল ভিনসেন্ট চাকরি পেল জেনারেল ইলেকট্রিক কোম্পানিতে, কিন্তু কেন জানি না তার ওজন দিনদিন কমছে। দুর্বল হচ্ছে শরীর আর পাল্লা দিয়ে বাড়ছে চোয়ালের ব্যথা। রেডিয়াম কোম্পানির ডাক্তার আশ্বস্ত করেছিলেন সাধারণ অসুখ বলে, কিন্তু তা সারতে এতদিন লাগে? মলি ম্যাগিয়া যদিও ডায়াল-পেইন্টিং ছাড়েনি, কিন্তু শরীর তারও ভাল নেই। চোয়ালের যন্ত্রণা, একটার পর একটা দাঁত তুলে ফেলেও কমেনি। উল্টে সেইসব জায়গায় আলসার হয়ে চলেছে ক্রমাগত। দিন গড়িয়ে মাস, মাস গড়িয়ে গোটা বছর। আস্তে আস্তে পচতে থাকে মলির চোয়ালের হাড়, ডাক্তার শুধু হতাশ হয়ে তাকিয়ে থাকেন। কী এমন জিনিস ভিতর থেকে একটা মানুষকে এভাবে খেয়ে ফেলতে পারে, তা তাঁর ধারণার বাইরে। একসময় শুধুমাত্র হাতের চাপেই টুকরো টুকরো হয়ে যায় মলির চোয়াল, সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে গলায়, ঘাড়ে। মুখ-গলার জায়গায় একটা ঘা-পুঁজওয়ালা গলা মাংসের তাল নিয়ে মলি মারা যায়। সেপ্টেম্বর, ১৯২২ – অনেক ভেবে মৃত্যুর কারণ লেখা হল, সিফিলিস।
প্রায় একই সময়ে, আটশো মাইল দূরে ওটাওয়া শহরে ডায়াল-পেইন্টিং-এর রমরমা কারবার খুলে বসেছিল “রেডিয়াম ডায়াল কোম্পানি”। একই কাজ, সেই একই ‘lip, dip and paint’। শুধু মেয়েদের মুখ আলাদা। তত্ত্বাবধানে ছিলেন মিস্টার অ্যান্ড মিসেস রিড। তাঁরা রঙের গুঁড়ো খেয়ে দেখাতেন তা কতটা স্বাস্থ্যসহায়ক, মেয়েদের উৎসাহ দিতেন রেডিয়াম নিয়ে নখপালিশ করতে, জামার বোতাম রং করতে। নিউ জার্সির প্রতিযোগীর তুলনায় যথেষ্টই উদার! প্রতিযোগী অবশ্য ততদিনে ভন সোচোকিকে দরজা দেখিয়ে দিয়েছে, নিয়েছে নতুন নাম “ইউনাইটেড স্টেটস রেডিয়াম কর্পোরেশন” (USRC)। সেখানকার মেয়েদের জীবনেও নতুনত্ব এসেছে – চোয়াল ক্ষয়ে যাওয়া অসুখ। হেজেল, হেলেন, আইরিনদের অবস্থা মলির মতোই। আইরিনের ডাক্তার সবকিছু দেখে সিদ্ধান্তে এলেন, এ রোগ জীবিকাগত। তিনি সে রাজ্যের ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাইজিন বিভাগ’কে চিঠি লিখলেন। তাদের এক ইন্সপেক্টর এলেন কারখানা পরিদর্শনে, দেখলেন ‘lip, dip...’ সংস্থার ভাইস প্রেসিডেন্টকে জানাতে তিনি বললেন, “বারবার বারণ করা সত্ত্বেও ওরা শোনে না, কী করি বলুন তো!”
ভাগ্যিস, এই আলোচনার সময় মেয়েরা সেখানে ছিল না!
ইন্সপেক্টর অবশ্য হালচাল দেখে খুব একটা সন্তুষ্ট হলেন না। তিনি রং-এর নমুনা নিয়ে পাঠালেন এক রসায়নবিদের কাছে আর লেবার ডিভিশনকে জানালেন তদন্ত চালাতে। একইসঙ্গে জমা পড়ল দু’টো রিপোর্ট – রসায়নবিদ জানিয়েছেন রঙে থাকা রেডিয়াম নিয়মিত শরীরে ঢুকলে ক্ষতির সম্ভাবনা সর্বাধিক আর লেবার ডিভিশনের পরিদর্শক জানিয়েছেন এসব অসুস্থতা দুর্ঘটনা মাত্র, কাজের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। রসায়নবিদের রিপোর্ট কোনও গুরুত্ব পায়নি, বলাই বাহুল্য। কারণ রেডিয়াম নিয়ে যাবতীয় গবেষণার সিংহভাগই হত ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে, ফলাফলও বেরত তাদের পছন্দসই। এমনকি কিছু রেডিয়াম মেডিসিন কোম্পানি নিজেদের গবেষণা ছাপিয়ে নিয়মিত ডাক্তারদের পাঠাত। তাই ভুরি ভুরি রিপোর্ট জানাচ্ছে রেডিয়াম কতটা জনহিতকর। হাতে গোনা জার্নালেই লিপিবদ্ধ ছিল রেডিয়ামের জন্মলগ্ন থেকে তখনও অবধি পাওয়া সমস্ত অসুস্থতার বিবরণ, কতিপয় বিজ্ঞানীর সতর্কবার্তা।
ফল পাওয়া গেল হাতেনাতেই। ১৯২৩-এর মধ্যে কর্মচারীদের বেশ কিছুজন মারা গেল মুখ ও গলার হাড়-মাংস সম্পূর্ণ ক্ষয়ে গিয়ে। আরও অনেক বেশি মানুষ অসুস্থ হতে থাকল। অসুস্থ হল ক্যাথরিন, মারা গেল তার এক বোন। উত্তেজিত ক্যাথরিন স্বাস্থ্য দপ্তরে গিয়ে আর্জি জানিয়ে এসেছিল, কিন্তু সে আর্জিতে কান দেওয়ার মতো বিশেষ কেউ ছিল না। সংস্থার কাজে যাতে সমস্যা না হয়, সেই জন্য আচমকাই লিপ-পয়েন্টিং বন্ধ করে দেওয়া হল। কারণ হিসেবে বলা হল, মুখের লালায় থাকা অ্যাসিড রংকে নষ্ট করে দেয়। তবু বারবার আশ্বাস দেওয়া হল, রেডিয়ামে কোনও বিপদ নেই।
তবে এইবার সরকারি স্তরে সামান্য নড়াচড়া শুরু হল। কনজিউমার লিগের এক ডাকাবুকো নেত্রী ক্যাথরিন উইলি সরেজমিন তদন্তে নামলেন। অসুস্থ কর্মীদের দেখে রীতিমতো ধাক্কা খেলেন তিনি। কে বলবে এই মেয়েগুলো কেউ পঁচিশ পেরোয়নি? বিছানার সঙ্গে মিশে যাওয়া শরীর, মুখ-গলা জুড়ে বীভৎস পচন – যেন দুঃস্বপ্নের কোনও প্রেত এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের ডাক্তারদের সঙ্গেও কথা বললেন উইলি, কারণ ততদিনে শহর জুড়ে ডেন্টিস্টদের চেম্বারে রোগীর ভিড় উপচে পড়ছে। সবার উপসর্গ কমবেশি এক, কিন্তু রোগের পরিচয় অজানা। কোম্পানি অবশ্য সেসব কথা কানে তোলেনি; সদ্য দেশের সেনাবাহিনীর থেকে বড়সড় কন্ট্র্যাক্ট পেয়েছে তারা, এখনই তো ব্যবসা বাড়ানোর সময়। উইলি বেগতিক বুঝে আইনি ব্যবস্থার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখলেন। আইন? মহিলা শ্রমিকদের জন্য? ইয়ে, তা একটা আছে বটে, কিন্তু ওতে যেসব জীবিকাগত রোগের তালিকা আছে, তার মধ্যে রেডিয়ামের বিষক্রিয়া নেই। এমনকি রেডিয়াম যে আদৌ বিষ, সেকথাই কোথাও বলা নেই। তার উপর আইন মোতাবেক, রোগ নির্ণয় হওয়ার পাঁচ মাসের মধ্যে অভিযোগ জানাতে হবে, কোম্পানির খাতায় নাম থাকতে হবে। যেখানে এককণা রেডিয়াম ভেঙ্গে অর্ধেক পরিমাণ তেজষ্ক্রিয়তা বেরতে সময় লাগে ১৬০০ বছর, সেখানে পাঁচ মাস তো নস্যি! অধিকাংশ মেয়েরা ডাক্তার অবধি গেছেই চাকরি ছাড়ার পর। কারণ, চাকরিতে থাকাকালীন তারা মাইনের সঙ্গে আশ্বাসও পেয়েছে নিয়মিত। সবকিছু জানিয়ে উপরওয়ালাদের হস্তক্ষেপ চাইলেন উইলি। কিন্তু ততক্ষণে তাদের হাতে এসেছে আরেকটি রিপোর্ট, তার ভিত্তিতেই তারা ঠিক করলেন ছাড় দেওয়াই যায় কোম্পানিকে। সেখানে ছিল মেডিক্যাল হিজিবিজি লেখা কয়েকটা চার্ট আর এক লাইনের বক্তব্য, “কোনও কর্মচারীর রক্তে কোনোরকম অস্বাভাবিকতা নেই”। প্রেরক USRC।
এদিকে অসুস্থ কর্মীরা কোম্পানিকে বারবার বলছে একটু সাহায্যের জন্য। অন্তত মানবিকতার খাতিরে নিজের কর্মীদের জন্য এটুকু করবে না তারা? হাতে আছে লেবার ডিভিশনের ছাড়পত্র, কোম্পানির বয়েই গেছে মানবিক হতে! অসুস্থ, অশক্ত মার্গেরাইট কার্লোর বুকে ধাক্কা লাগল; এতদিনের বিশ্বস্ততার এই প্রতিদান? ১৯২৫-এর ফেব্রুয়ারিতে USRC-এর বিরুদ্ধে সে ক্ষতিপূরণের মামলা করল। প্রথম আইনি পদক্ষেপ।
মামলা-মোকদ্দমা ব্যবসার জন্য মোটেই ভাল নয়। গুজবের চোটে মেয়েরা কাজ ছেড়ে যাচ্ছে, লগ্নি কমছে। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো সেই কনজিউমার-নেত্রী ক্যাথরিন উইলি ড্রিঙ্কার কমিটির রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছে। কোম্পানি যে নিরপেক্ষ গবেষক সিসিল ড্রিঙ্কারকে দিয়ে তদন্ত চালিয়েছিল, সে খবর ঠিক। কিন্তু তাঁর ফাইনাল রিপোর্ট আসার আগেই তো লেবার দপ্তরের ছাড়পত্র পেয়ে গেছিল তারা, তাই সেসব নিয়ে মাথা ঘামায়নি। অবশ্য মাথা ঘামালেও বিপদ ছিল। ঠিক একবছর আগে জমা দেওয়া রিপোর্টে ড্রিঙ্কার স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, কর্মীদের এই অবস্থার জন্য রেডিয়ামের ক্ষতিকারক প্রভাবই দায়ী। সমস্ত কেস স্টাডি খুঁটিয়ে দেখে, রেডিয়ামের প্রভাব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যে সুরক্ষার বিন্দুমাত্র ব্যবস্থা না থাকায় অতি সহজেই মেয়েদের শরীরে রেডিয়াম ঢুকে পড়ছে, জমা হচ্ছে তাদের হাড়ে। এমনকি কোম্পানির গবেষক কর্মীদের মধ্যেও অনেকের হাতে, মুখে ঘা দেখা গেছে। তারা নিজেরা এটাকে সামান্য সংক্রমণ ভেবেই বসে আছে, কিন্তু আদপেই তা নয়। আলাদা করে বলা হয়েছে, মার্গেরাইট কার্লো’র অবস্থার জন্য দায়ী রেডিয়াম। একবছর ধরে কোম্পানি এই রিপোর্ট চেপে রেখেছে, এখন চাইলেই দিয়ে দেবে?
মেয়েরা মরলে ক্ষতি নেই, তবে পুরুষ মরলে একটু নড়েচড়ে বসতে হয় বৈকি। ১৯২৫-এর জুন মাসে মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে মারা গেল USRC-এর প্রধান রসায়নবিদ, এডউইন লেম্যান। মৃত্যুর কারণ পার্নিশিয়াস অ্যানিমিয়া, তবু সাম্প্রতিক অভিযোগের ভিত্তিতে প্রশাসন নাক গলাল। ময়নাতদন্ত করলেন সদ্যনিযুক্ত প্রধান স্বাস্থ্য অধিকর্তা ডঃ হ্যারিসন মার্টল্যান্ড। তিনি ইতিমধ্যে মেয়েদের অসুস্থতার কথা শুনেছেন, তাদের ক্ষেত্রেও অ্যানিমিয়া ছিল মৃত্যুর অন্যতম কারণ। তার উপর রেডিয়াম যে অস্থিমজ্জাকে বেশি বেশি রক্তকোশ বানাতে উত্তেজিত করে এবং, ব্যবসায়ী মূর্খগুলো যাই দাবি করুক না কেন, তাতে যে শেষ অবধি সব কোশ নষ্ট হয়ে অ্যানিমিয়া অবশ্যম্ভাবী, সেকথাও তিনি জানতেন। হার্টল্যান্ড যোগাযগ করলেন ভন সোচোকির সঙ্গে। দুজনে মিলে লেম্যানের শরীর কেটে হাড় বের করলেন, সেই হাড় পুড়িয়ে গুঁড়ো করে তেজস্ক্রিয়তা-মাপক যন্ত্রের সামনে রাখতেই চড়চড় করে ঘুরে গেল কাঁটা। মার্টল্যান্ড বুঝলেন, সময় হয়েছে মার্গেরাইট কার্লোকে দেখতে যাওয়ার। মার্গেরাইটের অবস্থা ততদিনে আরও শোচনীয়। মার্টল্যান্ড আর সোচোকি তাকে নিয়ে এলেন হাসপাতালে, সঙ্গে USRC-এর আরেক অসুস্থ কর্মী সারাহ্ মেইলেফার। নিয়ে তো এলেন, কিন্তু তেজস্ক্রিয়তা মাপবেন কী করে? জ্যান্ত মানুষের হাড় তো আর...
মাথা খাটিয়ে উপায় বের করলেন দুজনে। সারাহ্-কে বসানো হল ইলেকট্রোস্কোপের সামনে, দেহস্থিত রেডিয়াম থেকে নির্গত গামা বিকিরণ ধরা পড়বে তাতে। সেইসঙ্গে বিশেষ ভাবে বানানো একটা রেসপিরেটর-বোতলে তাকে নিঃশ্বাস ছাড়তে হবে। রেডিয়াম ভেঙে যেহেতু নিষ্ক্রিয় রেডন গ্যাস তৈরি হয়, তাই আক্রান্তের চোয়ালে রেডিয়াম জমে থাকলে ধরা পড়বে ঐ যন্ত্রে। এর আগে কখনও জীবিত দেহের তেজস্ক্রিয়তা মাপার কথা কেউ ভাবেনি, এমনকি এই উপায়ও কারও মাথায় আসেনি। মার্টল্যান্ড আর সোচোকির যৌথ জিনিয়াসের ফল হল অভাবনীয়। স্বাভাবিক গামা বিকিরণের মাত্রা ১০ একক/ঘন্টা, সারাহ্-এর ক্ষেত্রে তা এল ১৪; শ্বাসপরীক্ষায় ৫ একক/৩০ মিনিটের স্বাভাবিক মাত্রার তুলনায় ফল দাঁড়াল ১৫.৪ – রেডিয়াম!
এর দু’দিন পরে রক্তজালক ফেটে সারাহ্-এর মৃত্যু হয়। সারাহ্ মেইলেফার, স্বাভাবিক জীবনের স্বপ্ন দেখা অখ্যাত এক মেয়ে, মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে হয়ে উঠল প্রথম রেডিয়াম-কন্যা যে জীবিত ও মৃত দুই অবস্থাতেই রেডিয়ামের বিষক্রিয়াকে প্রমাণ করল। রেডিয়াম-কন্যা – কথাটা ভুল নয় কিন্তু। মাত্র ১৮০ গ্রাম রেডিয়াম পাওয়া গেছিল তার শরীর থেকে, কিন্তু প্রতিটি অঙ্গ থেকে পাওয়া গেছিল তেজস্ক্রিয়তা। ফুসফুস, বৃক্ক, অন্ত্র, অস্থিসন্ধি – বাদ ছিল না কোনও জায়গাই। এই প্রথমবার বোঝা গেল কেন এই রোগের প্রাদুর্ভাব একেকজনের জন্য একেক জায়গায়। দেহবন্দি রেডিয়াম থেকে নির্গত আলফা, বিটা ও গামা বিকিরণ কোথাও এতটুকু বাধাপ্রাপ্ত হয় না যে! সামান্য পরিমাণ মৌল থেকেই তারা ইচ্ছামতো সারা শরীর ঘুরে বেড়ায়। মার্টল্যান্ড এই সমস্ত কিছু জানালেন সেইসব মেয়েদের যারা তাঁর কাছে নিজেদের পরীক্ষা করাতে এল। তবে সেইসঙ্গে জানালেন আরও একটা তথ্য – এই বিষক্রিয়ার কোনও চিকিৎসা নেই।
সংবাদমাধ্যম এবং বৈজ্ঞানিক মহলে এই তথ্য প্রকাশমাত্রই শুরু হল চরম বিরোধিতা। বিজ্ঞান ও মানবতার একনিষ্ঠ সেবকের কপালে, সংবর্ধনা নয়, লাঞ্ছনা জুটল। প্রতিটি রেডিয়াম কোম্পানি উঠেপড়ে লাগল হ্যারিসন মার্টল্যান্ডকে মিথ্যুক প্রমাণ করতে। কারণ মার্টল্যান্ডের গবেষণাপত্র তো শুধু রেডিয়াম-কন্যাদের দুর্বিপাকের কথা বলে না, রীতিমতো প্রশ্ন তোলে ওষুধ, প্রসাধনী, শৌখিন খেলনায় রেডিয়াম ব্যবহারের যৌক্তিকতা নিয়ে। সে প্রশ্নকে আরও ইন্ধন জুগিয়েছে ডঃ সিসিল ড্রিঙ্কারের সেই রিপোর্ট, যা এতদিন চাপা ছিল। USRC-এর এখন শনির দশা, তারা বুঝেছে আদালতে তাদের মুখ পুড়বে বিচ্ছিরি ভাবে। তাই সাত-তাড়াতাড়ি মার্গেরাইট আর তার সঙ্গিনীদের ডেকে আদালতের বাইরে একটা আর্থিক সমঝোতায় এল। কিন্তু বেঁকে বসল গ্রেস ফ্রেয়ার, সেইসঙ্গে ক্যাথরিন শওব, কুইন্টা, অ্যালবিনা এবং এডনা। ১৯২৭-এর মে মাসে, সবাই মিলে আলাদা ক্ষতিপূরণের মামলা করল, চোখে চোখ রেখে লড়াই শুরু দুই কাঠগড়ার মাঝে। দৈনিক খবরের শিরোনাম হয়ে দাঁড়াল এই মামলা। বাদীপক্ষের উকিল রেমন্ড বেরির আর্জিতে কবর থেকে তুলে আনা হল রেডিয়াম বিষক্রিয়ার প্রথম শহিদ মলি ম্যাগিয়ার দেহ। এই প্রথম ময়নাতদন্ত হয়ে সামনে এল তার মৃত্যুর কারণ – রেডিয়াম। এই মামলা চলা অবধি গ্রেসের চোয়াল সতেরো বার কাটা হয়েছে, এডনার পিঠে স্টিলের খাঁচা বসানো হয়েছে যাতে তার ক্রমাগত ক্ষয়ে চলা শিরদাঁড়া সোজা থাকতে পারে, বাকিদের অবস্থাও তথৈবচ। সাধারণের মনে ছিল একটাই প্রশ্ন, বিচার অবধি মেয়েগুলো বাঁচবে তো?
এই প্রশ্নই রেমন্ড বেরিকে বাধ্য করল USRC-এর সঙ্গে আর্থিক সমঝোতায় যেতে। শুরুর দিকের শুনানিতে দৃশ্যত নাস্তানাবুদ হতে হয়েছিল কোম্পানির উকিলদের। সাক্ষী, প্রমাণ, জুরিদের সহানুভূতি সবকিছুই তাদের বিরুদ্ধে। অবস্থা শোচনীয় বুঝে শুনানির শেষে তারা ফিরে গেল সেই প্রাচীন কায়দায়, “তারিখ পে তারিখ...”। তাই পরবর্তী শুনানির মাঝে ক্যাথরিনের শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকায় সমঝোতায় রাজি হল রেডিয়াম-কন্যারা। চুক্তি অনুযায়ী, এককালীন আর্থিক সাহায্য ছাড়াও USRC এই মেয়েদের বার্ষিক ভাতা, মৃত্যু অবধি সমস্ত চিকিৎসার খরচ ও কোর্টকাছারির খরচের ভার নিতে দায়বদ্ধ রইল।
আদালতে জয় অধরা থাকলেও এই মামলার ইতিবাচক প্রভাব হল অন্যত্র। খবরের কাগজে তুমুল জনপ্রিয়তার ফলে এই প্রথম ওটাওয়াতে কর্মরত মেয়েরা জানল রেডিয়াম বিষক্রিয়া কী জিনিস। রেডিয়াম ডায়াল অবশ্য তাদের মতো করে কর্মীদের শান্ত করার ত্রুটি রাখেনি। প্রত্যেকটি মেয়ের শ্বাসবায়ু এবং রক্ত পরীক্ষা করা হল, কিন্তু তার ফল কেউ জানতে পারল না। উল্টে আঞ্চলিক সংবাদপত্রে পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন দিয়ে কোম্পানি জানাল, তাদের কর্মীদের কারও মধ্যে রেডিয়াম বিষক্রিয়ার চিহ্নমাত্র নেই, আর তাছাড়া রেডিয়াম ডায়ালের রং-এর উপাদান এতই স্বাস্থ্যকর যে USRC-এর সঙ্গে তুলনাতেই আসে না।
কিন্তু কোম্পানি জানত ডায়াল-শিল্পী পেগ লুনির দেহে তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ আশঙ্কাজনক। তাই তারা পেগের স্বাস্থ্যের অবনতির দিকে কড়া নজর রাখছিল, অবশ্যই সবার অগোচরে। সরকারি তরফে রেডিয়ামের ব্যবহারকে “সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ” ঘোষণা করা হলেও সেভাবে প্রচার করা হয়নি। তাই ১৯২৯ সালে পেগের মৃত্যুর পর রেডিয়াম ডায়াল উঠেপড়ে লাগল যাতে পরিস্থিতি হাতের বাইরে না যায়। ভালোমানুষের মতো তারা বলল, “দেহের একটা ময়নাতদন্ত করা উচিত, কী বলেন?” পেগের পরিবার শুরু থেকেই কোম্পানির উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দিহান ছিল, তাই প্রস্তাবে রাজি হল একটাই শর্তে – তাদের পরিবারের ডাক্তারও থাকবেন সেখানে। নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট সময়ে ডাক্তার মর্গে পৌঁছে দেখলেন তাঁর যাওয়ার এক ঘন্টা আগেই কাটাছেঁড়া শেষ। কোম্পানির পেটোয়া লোকেরা সযত্নে সরিয়ে নিয়েছে পেগের তেজস্ক্রিয়তা-মাখা হাড়ের সমস্ত টুকরো। তিনি শুধু হাতে পেলেন একটা রিপোর্ট – তেজস্ক্রিয়তা শূন্য, মৃত্যুর কারণ ডিপথেরিয়া।
ভারী অদ্ভুত এই রেডিয়াম-কন্যেদের কাহিনি। শরীরময় বিষের জ্বালা নিয়ে ছটফট করতে করতে তারা মরে যায়, তবু সে মৃত্যু সরকারের ঘুম ভাঙ্গাতে পারে না, যা পারল প্রভাবশালী মার্কিন ধনকুবের এবেন বায়ার্স। এক সাংঘাতিক আঘাতের চিকিৎসায় ডাক্তার তাকে দিয়েছিল ‘রেডিথর’, ওষুধশিল্পে রেডিয়াম-গুণের পোস্টার-পণ্য। খেতে খেতে শেষে চোয়ালটি খুলে এসে ১৯৩২-এ তার মৃত্যু হল। সরকারি দপ্তরগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ে রেডিয়ামকে ওষুধশিল্পে নিষিদ্ধ ঘোষণা করল। এক ধাক্কায় রেডিয়াম জোগান দেওয়া কোম্পানিগুলির পায়ের নিচের জমি সরে গেল।
ওটাওয়ার রেডিয়াম ডায়াল কোম্পানিতে তখনও প্রতিদিন চলছে ‘lip, dip and paint’। অথচ মেয়েরা অনেকেই বুঝতে পারছিল, অবস্থা সুবিধের নয়। সদ্যযুবতী ক্যাথরিন উল্ফের পা বেঁকে চলেছে প্রতিনিয়ত, এখন সে লাঠি ছাড়া কোনোভাবেই হাঁটতে পারে না। প্রায় একই অবস্থা হেলেন আর অলিভেরও। ইনেজের কোমর আটকে গিয়ে সে চলচ্ছক্তিহীন। শার্লট পার্সেলের কনুইতে টিউমর এমন অবস্থায় পৌঁছল যে হাত কেটে বাদ দেওয়া ছাড়া উপায় রইল না। সেই কাটা হাতের হাড় থেকেই খোলসা হল এই সার্বিক দুর্দশার কারণ – রেডিয়াম। মেয়েরা ঠিক করল সবাই মিলে গিয়ে ধরবে তাদের পূর্বতন ম্যানেজার, মিঃ রিড-কে। জানতে চাইবে তাদের কী করণীয়।
কে জানাবে? মিঃ রিড তো ১৯২৮ সাল থেকে জানেন যে তার অধীনে কাজ করা সাতষট্টিজন ডায়াল-শিল্পীর মধ্যে চৌত্রিশজন তেজস্ক্রিয়তার শিকার। এই ছ-বছরে সংখ্যাটা বেড়েছে বই কমেনি। তিনি শার্লটের কাটা হাত আর ক্যাথরিনের নুয়ে পড়া শরীরের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমাদের তো এমন কিছু হয়নি”।
আদালতের রাস্তা ছাড়া আর কোথাও যাওয়ার থাকে না এরপরে। তবে ওটাওয়ার রেডিয়াম-কন্যাদের ভাগ্য তাদের নিউ জার্সির সহযোদ্ধাদের মতো প্রসন্ন ছিল না। ওয়াল স্ট্রিট ধ্বসে গিয়ে আমেরিকার বাজার-অর্থনীতি তখন ধুঁকছে। শহরের অন্যতম রোজগার-সংস্থানের বিরুদ্ধে এই আইনি পদক্ষেপ পাড়াপড়শিরা মোটেই ভালোভাবে নিল না। আদালতে দাঁড়িয়ে কোম্পানির উকিলরাও আইনের ফাঁকফোকর গলে দিব্যি বেরিয়ে গেল। প্রাথমিক শুনানিতে মেয়েদের কোনও সুবিধা হল না বটে, কিন্তু ইলিনয় প্রশাসন আইনের এই ফাঁক বোজাতে তৎপর হল। কিন্তু তার সুফল পেতে আরও অন্তত বছর তিনেক! এতকিছুর মধ্যে তারা পাশে পেল ‘শিকাগো ডেইলি টাইমস্’-কে। সেখানকার সাংবাদিক মেরি ডটি অক্লান্ত ভাবে লিখে চলেছে রেডিয়াম-কন্যাদের দুর্দশার দৈনন্দিন বিবরণ, গড়ে তুলেছে জনমত। সেই জনমত যা এতদিন তাদের বিপক্ষে ছিল। এমতাবস্থায় কাপুরুষমাত্রেই যা করে রেডিয়াম ডায়াল কোম্পানিও তাই করল। ওটাওয়াতে তাদের ঠিকানায় তালা ঝুলিয়ে ব্যবসা গুটিয়ে পালাল। ওদিকে আবার রেডিয়াম-কন্যাদের হয়ে মামলা লড়তে কেউ রাজি নয়। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েও লাভ হচ্ছে না। অবশেষে শিকাগো শহরে গিয়ে মেয়েরা খোঁজ পেল লিওনার্ড গ্রসম্যানের।
আশ্চর্য মানুষ এই লিওনার্ড গ্রসম্যান। সাংবাদিকতা, রাজনীতি, আইনজীবিকা সবকিছুতেই নাম কুড়িয়েছেন কিন্তু যত অভাগা, অত্যাচারিতদের জন্য লড়তে পছন্দ করেন। রেডিয়াম-কন্যাদের কাছে তিনি এলেন প্রায় দেবদূত হয়ে, শুনানির মোটে দুদিন আগে। প্রথমদিন অবশ্য বিচারকের কাছে আরেকটু সময় চেয়ে নেওয়া ছাড়া কিছুই করার ছিল না। এরপর শুরু হল আসল লড়াই। তন্নতন্ন করে খুঁজেপেতে গ্রসম্যান এই মামলার ঘুঁটি সাজালেন, মূল অভিযোগকারিণী করলেন ক্যাথরিন উলফ্কে। পাঁচ কন্যার মধ্যে ক্যাথরিনকে বেছে নেওয়ার একটাই কারণ, তারই বাঁচার আশা সবচাইতে ক্ষীণ। খেতে বসে ক্যাথরিনের মুখে উঠে এসেছে দু’টো শক্ত টুকরো, চোয়াল ভেঙে গেছে আপনা থেকেই। সংক্রমণ ছড়াল গলায়, খাওয়াও দুঃসহ হয়ে উঠল, সেইসঙ্গে কোমরের অস্থিসন্ধির টিউমর বাড়তে থাকল পাল্লা দিয়ে। মামলার দিনে ভরা আদালতে ক্যাথরিন ঢুকেছিল তার স্বামী টমের কোলে চেপে। কয়েকদিন পর থেকে আর তাও সম্ভব হত না, একটু জোরে চেপে ধরলেই ক্যাথরিনের হাড় ভেঙে যেত। মামলা চলাকালীন সাংবাদিকরা তাকে নাম দিয়েছিল “টুথপিক গার্ল”।
ধন্যি টুথপিক গার্লের বিস্ময়কর জীবনীশক্তি! আদালতে বসে প্রথমদিনে একের পর এক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সে তুলে ধরেছে বাণিজ্যিক লাভের জন্য দিনের পর দিন তাদের উপর হয়ে চলা অন্যায়ের খতিয়ান। পরবর্তীকালে চলচ্ছক্তিরহিত হয়ে পড়ায় মামলা স্থানান্তরিত হয় ক্যাথরিনের বাড়িতে, তার বিছানার পাশে। বিছানায় প্রায় মিশে যাওয়া শরীর থেকে শীর্ণ দুটো হাত বের করে সে দেখায়, ঠিক কীভাবে তারা ডায়ালে সময় আঁকত। ‘Lip, dip and paint’। এই প্রখর জেদ আর ধারালো প্রমাণের সামনে কোম্পানির উকিলদের কিছুই করার ছিল না। অবশেষে ১৯৩৮-এর এপ্রিলে আদালত রায় শোনাল – রেডিয়াম ডায়াল কোম্পানি দোষী।
তেরো বছর আর দুই শহর জুড়ে চলা একটা লম্বা অপেক্ষার অবসান।
এটাই উপসংহার হতে পারত, কিন্তু দুঃস্বপ্নেরা ফিরে ফিরে আসে। রেডিয়াম ডায়াল এই রায়ের বিরোধিতা করল। কীসের জন্য? বিলিয়ন ডলার ব্যবসা করা কোম্পানির ৫,৬৬১ ডলার বাঁচানোর জন্য। হ্যাঁ, ঐটুকুই পেয়েছিল ক্যাথরিন। রেডিয়াম ডায়াল ইলিনয় ছেড়ে চলে যাওয়াতে তাদের সম্পত্তি বলতে কিছুই ছিল না। শুধু ছিল প্রশাসনের কাছে রাখা দশহাজার ডলার সিকিউরিটি বন্ড, যা কিনা কর্মীদের দাবিদাওয়া মেটাতেই খরচ হওয়ার কথা। এটুকু থেকেই ভাগ পেতে পারত রেডিয়াম-কন্যারা, যাদের এক একজনের ডাক্তার, অপারেশন, ওষুধ মিলিয়ে প্রায় কুড়ি-পঁচিশ হাজার ডলার ধার হয়ে গেছে। এটা ছিল তাদের মর্যাদাটুকু রক্ষা করার লড়াই, আর রেডিয়াম ডায়ালের কাছে নিজেদের ভাবমূর্তি বাঁচানোর। জুলাই, ১৯৩৮; রেডিয়াম ডায়াল উচ্চ আদালতে আর্জি জানাল। ঠিক পরের দিন, ক্যাথরিন উলফ্ তার ধৈর্যের শেষ বিন্দুটুকু খরচ করে চোখ বুজল।
কিশোরী ক্যাথরিন যখন এক সকালে লম্বা হলঘরটায় বসে হাতে তুলি ধরেছিল, সেদিন তার দুচোখে ছিল অনন্ত স্বপ্ন। বাপ-মাকে আরেকটু ভালো রাখার, নিজের মতো করে ভালো থাকার স্বপ্ন, সংসারের স্বপ্ন। সে জানত না এই স্বপ্নের পথে তাকে এক অসম লড়াইয়ে নামতে হবে। জানত না, সে-ই হয়ে উঠবে একদশক ধরে চলা রেডিয়াম-কন্যাদের প্রতিবাদের মুখ। মৃত্যুর দিনে শুধু সে জেনে গেছিল, লড়াই আর শেষ হল না! এখন তার লড়াই এগিয়ে নিয়ে যাবেন লিওনার্ড গ্রসম্যান। উপর্যুপরি সাতবার কোম্পানি আপিল জানায়, সাতবার গ্রসম্যানের দৌলতে সে আপিল খারিজ হয়। এই মামলার সুবাদে গ্রসম্যানকে বিশেষ সুপারিশ করাতে হয় আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে সওয়াল-জবাব করার জন্য। মামলার সমস্ত খরচ যায় নিজের পকেট থেকে। কিন্তু তিনি জানতেন লক্ষ্য একটাই – জাস্টিস।
অক্টোবর, ১৯৩৯ – চিরতরে দোষী সাব্যস্ত হল রেডিয়াম ডায়াল।
এক বিশ্বযুদ্ধ থেকে আরেক বিশ্বযুদ্ধে এসে শেষ হল রেডিয়ামের বিষক্রিয়া। হিরোশিমা-নাগাসাকিতে তেজস্ক্রিয়তার অন্য রূপ দেখল সারা বিশ্ব। যুদ্ধ মিটতে অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের সুপারিশে মানবদেহে তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব নিয়ে গবেষণার প্রয়োজনীয়তা বুঝল দেশ, নতজানু হল রেডিয়াম-কন্যাদের সামনে। তাঁদের সাহায্য ছাড়া যে এক পা-ও এগোবে না এই প্রকল্প। জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা সেই কতিপয় মানুষ সেদিনও কাউকে ফেরাননি। শুধুমাত্র আগামী পৃথিবীকে একটু ভালো রাখার জন্য আবার এসেছেন হাসপাতালের বেডে, সানন্দে অনুমতি দিয়েছেন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর। তাঁদের কথা মাথায় রেখেই এসেছে নতুন আইন, কর্মী সুরক্ষা স্থান পেয়েছে মুনাফারও আগে। বিজ্ঞানের সমুদ্র-মন্থনে যে কালকূট উঠে এসেছিল, তাকে গলায় ধারণ করে রেডিয়াম-কন্যারা গোটা পৃথিবীকে একটা উত্তরাধিকার সঁপে গেছেন। বিজ্ঞানকে অবহেলা করে ব্যবসাকে প্রাধান্য না দেওয়ার, মানবতাকে সবার ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়ার উত্তরাধিকার। তার কতটা কাগজে-কলমে থেকে গেছে আর কতটা আমরা বহন করতে পারছি, সে উত্তর জানে শুধু কবরে শুয়ে থাকা সার সার অখ্যাত মেয়েরা।
ক্লাস এইটের ম্যাডেলিন পিলার ২০০৬ সালে যখন প্রথম এই গল্প শোনে, তখন কয়েকটা পত্রপত্রিকা, বই আর একটা নাটক ছাড়া সে কোথাও সেই মেয়েদের খুঁজে পায়নি। একার উদ্যোগে ম্যাডেলিন ইলিনয় শহরের মেয়রকে রাজি করায় এমন কিছু করতে, যাতে চলতে-ফিরতে কখনোই আমরা সে উত্তরাধিকার না ভুলি। ২০১১ সালে ব্রোঞ্জের সংকল্পে মাথা তোলে ‘রেডিয়াম গার্ল’।
“মনে রেখে দেব” বলতেও কত দেরি করে ফেলি আমরা!
তথ্যসূত্র:
১) The Radium Girls: The Dark Story of America’s Shining Women, Kate Moore
২) These Shining Lives, Melanie Marnich
[ কভার পোস্টার: অর্পণ দাস]
#বাংলা #নিবন্ধ #বিজ্ঞান #রেডিয়াম গার্লস #The Radium Girls: The Dark Story of America's Shining Women #সিলি পয়েন্ট #সায়নদীপ গুপ্ত #অর্পণ দাস