শিল্পসমালোচনা থেকে ভ্রমণবৃত্তান্ত : ত্রৈলোক্যনাথের অচর্চিত বইপত্রের সন্ধানে
কঙ্কাবতী বা ডমরু চরিতের স্রষ্টা ত্রৈলোক্যনাথ আমবাঙালির ঘরের লোক। কিন্তু সাহিত্যিক ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের কর্মময় জীবনের এক বিস্তৃত অধ্যায় আজও চর্চার আড়ালেই থেকে গেছে।তিনি বহু বিচিত্র পেশার সাথে যুক্ত থেকেছেন আজীবন। শিক্ষকতা দিয়ে শুরু করলেও পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর, রাজস্ব ও কৃষি বিভাগের অধিকর্তা, ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামের কিউরেটর -বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পদে নিযুক্ত হয়েছেন। ১৮৯২তে কঙ্কাবতী উপন্যাসের মাধ্যমে সাহিত্যিক জীবনের সূচনা হলেও, ইতিপূর্বেই কর্মসূত্রে রচনা করেছেন ‘Hand-book of Indian Products’ (১৮৮৩) এবং ‘Art Manufactures of India’ (১৮৮৮) নামে দুটি মূল্যবান গ্রন্থ। বস্তুত উনিশ শতকে ভারতীয় শিল্পের বিবর্তনের ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে ত্রৈলোক্যনাথের এই বই দুটির গুরুত্ব যথেষ্ট।
১৮৮৬ সালে তৎকালীন ইংরেজ সরকার লন্ডনে ভারতীয় শিল্প দ্রব্যের একটি আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে।ভাবলে অবাক হতে হয়,এই প্রদর্শনীর যাবতীয় ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন ত্রৈলোক্যনাথ। ১২ মার্চ ১৮৮৬ তারিখে ‘Nepaul’ জাহাজে বোম্বে বন্দর থেকে লন্ডনের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাচ্ছেন তিনি। সেই বছরের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর - প্রায় ৯ মাস থাকছেন বিদেশে। আর সেই সঙ্গে ভারতীয় শিল্পকে বিদেশের মাটিতে পরিচিতি দেওয়ার ভার তুলে নিচ্ছেন নিজের কাঁধে। এই পর্যায়ে ত্রৈলোক্যনাথ ইউরোপ ভ্রমণের যাবতীয় বৃত্তান্ত গেঁথে ফেললেন ‘A Visit to Europe’- গ্রন্থে। এই বইটি লেখার কোন প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল না তাঁর। দেশে ফেরার পর ‘Indian Nation’ পত্রিকার অনুরোধে ইউরোপ ভ্রমণের জার্নাল লেখা শুরু করেন, যা পরবর্তী প্রায় দেড় বছর ধরে সাপ্তাহিক কিস্তিতে প্রকাশিত হয়। ১৮৮৯ সালে তা প্রকাশ পায় বই আকারে। বইটির ভূমিকা লেখেন এটর্নি এন.এন ঘোষ। এর প্রায় ৮ বছর পর পরিমল গোস্বামী বাংলায় বইটি অনুবাদ করেন। ত্রৈলোক্যনাথ ৩৯ বছর বয়সের ইউরোপ যাত্রা করেছিলেন। নিজের দেশের বিভিন্ন প্রদেশে কাজ করার বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়েই তাঁর বিদেশযাত্রা। এক পরিণত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তিনি পরিচিত হচ্ছেন ইউরোপীয় সমাজ-সংস্কৃতির সঙ্গে। আর তা-ই লিপিবদ্ধ করছেন ‘A Visit to Europe’-গ্রন্থে।
আরও পড়ুন : তারাশঙ্করের প্রথম বই ছিল কবিতার বই / টিম সিলি পয়েন্ট
ত্রৈলোক্যনাথের জীবনীকার তপোধীর ভট্টাচার্যের মতে, তাঁর জীবনকে সহজেই দুটো অধ্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে। যেখানে ১৮৯৬ সাল নাগাদ প্রথম পর্যায়ের সমাপ্তি এবং ১৮৯২-৯৩ সালে অন্য পর্বের সূচনা। ১৮৯৬ সালে ত্রৈলোক্যনাথ ভারতীয় মিউজিয়ামের কিউরেটর হিসেবে নিজের কর্ম জীবন শেষ করছেন। অন্যদিকে ১৮৯২তে ‘কঙ্কাবতী’ প্রকাশের মধ্যে দিয়ে তাঁর সাহিত্যিক-জীবনের সূচনা। নিঃসন্দেহে সাহিত্যিক ত্রৈলোক্যনাথকে বাঙালি ভুলে যায়নি, কিন্তু তাঁর জীবনের বিস্মৃত এই অধ্যায়টির ধুলো ঝেড়ে দেখবারও সময় এসেছে বৈকি। তাঁর এই ‘নন ফিকশন’ রচনাগুলি চর্চার আলোয় আসা প্রয়োজন।
........................