কথা বলা পুতুল মাইকেল : বাংলা দূরদর্শনের এক সোনালি অধ্যায়
ভেন্ট্রিলোকুইজম। বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায় অন্তর্বচন, বা মায়াস্বর। শব্দটা আজ আমাদের কাছে তেমন অপরিচিত নয়। কিন্তু সাতের দশকের শেষে দূরদর্শন চ্যানেলে ‘চিচিং ফাঁক’ নামক অনুষ্ঠানে যখন মাইকেলের আবির্ভাব ঘটে, তখন এই শব্দের সঙ্গে আমবাঙালির পরিচয় ছিল না বললেই চলে। মাইকেলের বিষয়ে নির্দ্বিধায় ব্যবহার করা যায় জুলিয়াস সিজারের সেই অমর বাক্যবন্ধ ‘ভিনি ভিডি ভিসি’ - মানে এলাম, দেখলাম, জয় করলাম। মধ্যবিত্ত বাঙালি বাড়ির ছোটদের কাছে মাইকেল ছিল এক অমোঘ আকর্ষণ। তবে শুধু ছোটরা না, বড়োরাও বুঁদ হয়ে ছিল তার জাদুতে। মাইকেল কিন্তু কোনও মানুষের নাম নয়। কোনও প্রাণীই নয় সে। মাইকেল কথা বলা এক পুতুল। ১৯৭৫ সালের ৯ আগস্ট যেদিন কলকাতা দূরদর্শন শুরু হল, সেদিন ‘চিচিং ফাঁক’ অনুষ্ঠানের সূচনা হয়েছিল মাইকেলকে দিয়ে। অনুষ্ঠানের নাম ছিল ‘মাইকেলের আসর’। আর মাইকেলের নিরন্তর বকবকানির নেপথ্যে যে মানুষটি ছিলেন, তাঁর নাম প্রবীরকুমার। সম্পূর্ণ নাম প্রবীরকুমার দাস।
আমরা এখন টিভি, ইউটিউব বা লাইভ শো-তে অনেক ভেন্ট্রিলোকুইস্টের দেখা পাই। কিন্তু প্রবীরবাবুর মতো এত কুশলী শিল্পী বাংলায় তো বটেই, গোটা ভারতেও খুঁজলে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। মাইকেলের হয়ে কথোপকথনের সময় বিন্দুমাত্র ঠোঁট নড়ত না তাঁর। প্রবীরবাবুর কাছে অনেক পুতুল ছিল, কিন্তু তাঁকে খ্যাতি এনে দিয়েছিল মাইকেল। ১৯৫৩ সালে প্রবীরবাবুর জন্ম। ছোট থেকেই যুক্ত ছিলেন বয়েজ স্কাউটের সঙ্গে। আগ্রহ ছিল ম্যাজিকে। ১৯৬৬ সালে স্কাউটের ‘ওয়ার্ল্ড জাম্বুরি’-তে অংশ নেবার জন্য রাশিয়ায় যাবার সুযোগ পান। সেখানেই ভেন্ট্রিলোকুইস্ট জে.ভি. দাবাত্নিয়াকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে এই খেলার চর্চা শুরু করেন। সম্ভবত ১৯৭০ সাল নাগাদ প্রবীরবাবু মাইকেলকে নিয়ে প্রথম মঞ্চ অনুষ্ঠান করেন কলকাতা ময়দানে স্বদেশী মেলায়। সেখানেই তিনি নজরে পড়ে গেছিলেন মীরা মজুমদারের, যিনি কয়েক বছর পর কলকাতা দূরদর্শনের অধিকর্তা হবেন।
১৯৭৫ সালে শুরু হয় মাইকেলের আসরের জয়যাত্রা। আট থেকে আশি - সবার মন জয় করা এই অনুষ্ঠানটি একটানা চলেছিল ১৯৯৫ পর্যন্ত। ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত এই অনুষ্ঠান লাইভ হত সন্ধে ৬ টা থেকে ৭ টা পর্যন্ত। শুরুতে তিনটি মঙ্গলবার অন্তর হত, পরে দর্শকদের বিপুল অনুরোধে প্রতি মঙ্গলবার আয়োজন করতে হয়। ১৯৮৯ সালের পর থেকে কাজের চাপে প্রবীরবাবু অনুষ্ঠানটি আর লাইভ করতে পারেননি। শেষ কয়েক বছর আগে রেকর্ড করে নিতেন। মাইকেল সে সময় কতটা জনপ্রিয় ছিল, জানা যায় রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের একটি স্মৃতিচারণ থেকে - “সেই সময় মাইকেলকে নিয়ে মানুষের মনে কতটা ভালোবাসা, কতটা আগ্রহ ছিল, তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করা যেত না। লাইভ অনুষ্ঠানের দিন মাইকেল, প্রবীরদার মোটরসাইকেলের সামনে বসে দূরদর্শন ভবনে যেত। আর ওকে দেখবার জন্য রাস্তার দু ধারে লোক দাঁড়িয়ে থাকত। একবার অনুষ্ঠানের শেষে প্রবীরদা মাইকেলকে একটা লম্বা ব্যাগে পুরে ফেলেছিলেন। হঠাৎ দেখা গেল বেশ কিছু ছোট ছেলেমেয়ে কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে। কী হল। কী ব্যাপার! না, মাইকেলকে ব্যাগে ভরে দেওয়া হয়েছে, ও তো দম বন্ধ হয়েই মারা যাবে! অগত্যা প্রবীরদাকে আবার তাড়াতাড়ি ওকে ব্যাগ থেকে বের করে ফেলতে হল।”
আরও পড়ুন : লস্ট ভয়েস গাই : একজন বোবা স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ানের বিশ্বজয়ের গল্প
প্রবীরবাবু আর মাইকেলের গুণগ্রাহীর তালিকায় ছিলেন সত্যজিৎ রায়, উত্তম কুমার, অমিতাভ বচ্চন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, পাহাড়ি সান্যাল, কমল মিত্র, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, কাননদেবী প্রমুখ অনেকে। সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত ‘ভুতো’ গল্পটি এমনই একজন ভেন্ট্রিলোকুইস্ট আর তাঁর পুতুলের গল্প। গৌতম ঘোষ তাঁর ‘গুড়িয়া’ ছবির চিত্রনাট্য সাজিয়েছিলেন মহাশ্বেতা দেবীর ‘জনি ও উর্বশী’ কাহিনি অবলম্বনে। সেই ছবিতে ভেন্ট্রিলোকুইস্ট জন মেন্দেজের ভূমিকায় ছিলেন মিঠুন চক্রবর্তী। তাঁকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন প্রবীরবাবু।
টেলিভিশনের বাইরেও অব্যাহত ছিল মাইকেলের জয়যাত্রা। তাকে নিয়ে প্রবীরবাবু পশ্চিমবঙ্গের নানা প্রান্তে অসংখ্য স্টেজ শো করেছেন। স্কুল, কলেজ, অফিসের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যাঙ্ক, বীমা কোম্পানি ও অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার হয়ে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান করেছেন। ‘৭৮-এর বিধ্বংসী বন্যার সময় মাইকেলকে সামনে রেখে ত্রাণ তুলেছেন। আজ বিনোদনের হরেক পসরার মাঝে কথা বলা পুতুলদের জনপ্রিয়তা আর নেই। শিশুরাও এই আশ্চর্য বিদ্যায় মুগ্ধ হয় না আর। কিন্তু প্রবীরকুমার তাঁর মাইকেলকে নিয়ে প্রায় তিন দশক ধরে যেভাবে বাঙালির বিনোদনের একটা বড় খোরাক যোগান দিয়ে এসেছেন, সে কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণে রাখা দরকার।
….……………………….
ঋণ : রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায় / দূরদর্শনের কথা বলা পুতুল মাইকেল ও তাঁর স্রষ্টা প্রবীরকুমারের কথা / banglalive.com