নিবন্ধ

অ-দ্বিতীয়া

সৌপ্তিক Jan 9, 2021 at 7:41 am নিবন্ধ

সুশান্ত সিং রাজপুত মারা যাওয়ার পর আমাদের দেশে একটা শোরগোল পড়ে গেল। তাঁর আত্মহত্যার আসল কারণ যে মগজ জোড়া বিষাদ রোগে লুকিয়ে ছিল, তা ভুলে গিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া ও নিউজ মিডিয়ার দৈনিক অবৈধ ট্রায়ালে তাঁর প্রেমিকা রিহা কখনও হলেন ড্রাগের দালাল, কখনও বা কালাজাদু জানা পিশাচসিদ্ধা। খবর চালাতে চালাতে শাস বহু সিরিয়ালের মিথও যুক্তিরূপে চালিয়ে দিলেন জি নিউজের অ্যাঙ্কর মহাশয়া। অনুভূতিশীলেরা হায় হায় করলাম, বিচক্ষণেরা টিভি দেখাই ছেড়ে দিল, বুদ্ধিমানরা নাক সিঁটকাল। তারপর?

তারপর অনেক কটা মাস কেটে গেছে। আজ বোভোয়ার জন্মদিন উপলক্ষ‍্যে লেখা প্রস্তুত করতে বসে, বাসি খবরে চোখ বোলাতে বোলাতে হঠাৎ করেই মিথের (myth) প্রসঙ্গ মাথায় এল। বোভোয়াও তাঁর নারীবাদে দেখাচ্ছেন মিথ কীভাবে আমাদের সমাজে পুরুষতন্ত্রের কাঠামোতে বিচুলি বাঁধে। যেমন ধরুন, রবীন্দ্রনাথ কত সহজে লিখে ফেললেন, ‘নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার কেন নাহি দিলে অধিকার’। মানে দাঁড়ায়, বিধাতাপুরুষ নারীকে কেন আপন ভাগ্য জয় করতে দিলেন না। প্রশ্ন উঠতেই পারত, নারীর ভাগ্য জয় করার জন্য বিধাতার (পুংলিঙ্গ শব্দ, অর্থাৎ তা পুরুষকেই বোঝাচ্ছে) অনুমোদন দরকারি কেন? প্রশ্ন ওঠে না, কারণ রবীন্দ্রনাথ নারীদের সম্বন্ধে প্রচলিত কিংবদন্তি বা মিথ-এর থেকেই এইরকম লাইন লেখার প্রেরণা পেয়েছেন। এমন কথা বেশ চালু, নারী মাত্রেই দুর্বল- এটাও মিথ। আরও হাজার গল্প নারীকে কখনও গড়ে তোলে মাতৃত্বের মোড়কে, কখনও সঙ্গিনীর ‘আদর্শ’ বুনিয়াদে। কিন্তু মজার বিষয় এটা, এই মিথ শুধু রিহাকে মারে না। মারে বোভোয়াকেও। আমাদের ‘পুরুষ’ চোখ বোভোয়াকে কখনও তাই দেখে গর্ভপাত ঘটানো দানবী হিসাবে, আবার কখনও তাঁকে বানিয়ে তোলে নারীবাদের ‘জননী’। অথচ এই জননীর ধারণাতেই আপত্তি ছিল বোভোয়ার। আমরা তাঁকে বারবার মাপবার চেষ্টা করি সার্ত্রের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের ভিত্তিতে। একটা ছবি রয়েছে, বোভোয়া, সার্ত্রে এবং লিনা জোনিনার (সার্ত্রের রাশিয়ান বান্ধবী, যার সঙ্গে পাঁচ বছরের সম্পর্কে ছিলেন সার্ত্রে)। বোভোয়া-সার্ত্রে-জোনিনার গপ্পটুকু মোটামুটি খোলসা করে কিছু লোকজনকে ছবি দেখিয়েছিলাম, যারা এদের কাউকেই চেনে না। জোনিনা সেই মুহূর্তে সার্ত্রের কাছাকাছি আছেন এবং তাঁদের মুখে লেগে রয়েছে এক অনাবিল হাসি- এইটুকু দেখেই অধিকাংশ জোনিনাকে সিমন ভেবে গুলিয়েছে। গণ্ডগোলটির থেকে ধারণা করা যায় বক্তাদের এই বক্তব্যের পিছনে রয়েছে সম্পর্কের সনাতনত্বের ধারণা। যে, চিরন্তন প্রেমিকের হাসিটুকু তো তাঁরই প্রাপ্য। অথচ, দর্শকরা তিনজনের অন্য কোনও পরিচয় জানতে আগ্রহী হননি। সেই বিকল্পও তাঁদের কাছে ছিল। কিন্তু হাতে সম্পর্কের সহজ হিসাব মজুত থাকলে ব্যক্তির পরিচয় অন্য সব কিছু ব্যতীত, সম্পর্কের নিরিখেই বিচার্য হয়। সেখানে ব্যক্তি লঘু হয়ে যায়, প্রধান হয়ে ওঠে পুরুষতন্ত্র স্বীকৃত ‘সনাতন’ কাঠামো। সার্ত্রের সঙ্গে বোভোয়াকে মিশিয়ে দেখতে গিয়ে আমাদের এই হয়েছে বিপদ। বোভোয়ার অস্তিত্বকে মানুষ হিসাবে আমরা পাত্তা দিই না। তাঁকে পড়ি ‘সার্ত্রের সারেঙ্গী বাদক’ হিসাবে। Ethics of Abiguity-তে বোভোয়া নিজেকে চিহ্নিত করছেন একজন Existentialist হিসাবে। আর অস্তিত্বের মোদ্দা কথাই তো নিজের স্বাধীন স্বতন্ত্র পরিচয়। সেই পরিচয় তাই পাঠ করতে বসে আমাদের ভুলচুক হয়ে যায়। বোভোয়ার জীবন ও লেখালেখির চেয়ে মুখরোচক হয়ে ওঠে তাঁর ও সার্ত্রের সম্পর্কের কথা। 

আরও পড়ুন : ময়মনসিংহের তেভাগা আন্দোলনে প্রতিবাদের মুখ রাসমণি : এক বিস্মৃত অধ্যায় / সবর্ণা চট্টোপাধ্যায়

সিমনের বাবা বলতেন ‘পুরুষের মগজ’-এর অধিকারী তাঁর কন্যা। মাপকাঠিটাই পুরুষ। যে স্কেলে মানুষের মেধাকে মাপা হচ্ছে সেটাই যদি পক্ষপাতদুষ্ট হয়, তা হলে সেখানেই সমস্যার শুরু। আমাদের নারীবাদকে পড়ার ও বোঝার চেষ্টা করাটাও অনেকটা এরকম জায়গায় দাঁড়িয়ে। বোভোয়ার মৃত্যুর পর বহু বছর কেটে গেলেও আমরা আমাদের কাঠামোটাকে অপরিবর্তিত রেখেছি। বলা বাহুল্য, সেই কাঠামো পুরুষের হাতে তৈরি। আর সেই কাঠামোতে দাঁড়িয়ে সার্ত্রের সঙ্গে ৫১ বছরের  সম্পর্কই তাই চিরন্তনী আখ্যা পাবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু স্বাভাবিক আর অস্বাভাবিকের বাইনারিতে নিজেকে আটকাননি বোভোয়া। জীবনের বদলকে স্বীকার করেছেন। তাই বদলেছেন নিজের অস্তিত্ব সম্বন্ধে ধারণা। অস্তিত্বের ধারণায় সময় ধ্রুব। সময় মানেই তা পরিবর্তনশীল, তাই সময়ের সঙ্গে ধারণাও এক থাকে না। ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’ রচনার সময়ে বিশ্বাস করতেন সমাজতন্ত্রই নারীদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারে। পরে এ মত বদলে জানিয়েছেন, সমাজতন্ত্রও পুরুষ প্রতিষ্ঠিত একটি আদর্শ, তাই নারীর অবস্থান সে পাল্টাতে ব্যর্থ। নারীর আকাঙ্ক্ষা ও উচ্চাভিলাষের স্বাধীন স্বীকৃতি তাই কোনও আরোপিত কাঠামোতেই সম্ভব নয়।


যদি স্বীকার করে নেওয়া যায়, আমরা প্রত্যেকেই দেশকাল নির্বিশেষে কোনও না কোনও কাঠামোর অংশী, তা হলে এ কথা স্বীকার করতেও লজ্জার কিছু নেই যে, ২০২১ সালে আমরা বোভোয়াকে আদতে যেভাবে পড়ছি তা পুরুষতন্ত্রের কাঠামোর উপরে দাঁড়িয়েই পড়া হচ্ছে। আমাদের পাঠে তাই থেকে যাচ্ছে সেই সনাতনকে স্বীকৃতি দেওয়ার অমোঘ প্রয়াস। অথচ এই কাঠামোর বাইরেই আছেন আসল সিমন। নেলসন অ্যালগ্রেনের নামটি তাই অনেক ক্ষেত্রেই বাদ পড়ে যায় বোভোয়ার জীবনের আলোচনায়। মার্কিন এই ঔপন্যাসিক উপন্যাসের জগতে তেমন সাড়া ফেলেননি। তবে বোভোয়ার হৃদয়ে তাঁর আলাদা স্থান ছিল। My beloved Chicago Man থেকে তিনি কখনো হয়ে গেছেন আদরের পশু, কুমির কিংবা My beloved Husband। Husband শব্দটি ধোঁয়াশার সৃষ্টি করতে পারে পাঠকের মনে। যদি করে, তবে কুমির সম্বোধনও ধোঁয়াশা জন্ম দেবে। আর না হলে, ধরে নিতে হবে এই ধোঁয়াশা আদতে আমাদের পালন করা পুরুষতন্ত্রের অবদান।  নারীকে প্রকৃতি, রহস্যময়ী, অমানুষ, জননী, পত্নী হিসাবে চিহ্নিত করার সামাজিক প্রবণতার কথা বোভোয়া বলেছেন। ব্যক্তিজীবনে এই মিথগুলির থেকে দূরে সরেছেন। সমাজের সম্বন্ধে ধারণার সঙ্গে সময়ে প্রেমও বদলেছে, বদলেছে মানুষ। ক্লঁদ লাজমনের সঙ্গে থেকেছেন বেশ কিছুদিন। বিনাকা ল্যাম্বলিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছেন সমপ্রেমী সম্পর্কে। 

আরও পড়ুন : স্মরণে বীণা দাস : স্বাধীনতা সংগ্রামের এক বিস্মৃতপ্রায় বীরাঙ্গনা / মন্দিরা চৌধুরী 

The Second Sex লেখায় আসা Self ও Other-এর  কথা খেয়াল করলেই লক্ষ করা যায়, একটি চেতনা নিজেকে কর্তা ভেবে, অন্যটিকে বানিয়ে তোলে কর্ম বা অপর। পুরুষ নারীকে করে তুলেছে চিরন্তন, অপর বা other। নারীকে সে কখনই Self বা কর্তা হয়ে উঠতে দেয়নি। পুরুষের আশ্রিত বা দাস হিসাবেই আমদের সমাজ নারীকে চিনেছে। প্রতিটি সংস্কৃতিতেই পুরুষ=পরম রূপ, নারী নেহাতই নারী। বোভোয়া নেহাতই নারী ছিলেন না বলেই কখনও বিবাহ করেননি, কিংবা কখনও প্রেমিকের সঙ্গে ‘আজীবন কাটাব জীবন’ ব্রতে জড়াননি নিজেকে। নিজের জীবনকে আকস্মিক প্রেমের প্র্যাক্টিস সেশনে পরিবর্তন করেছেন। সন্তান না নেওয়ার সিদ্ধান্ত অনেক আগেই নিয়েছিলেন। পরে একসঙ্গে থাকারও বিরোধী হয়ে উঠেছেন, যখন দেখেছেন একসঙ্গে থাকলে একটি self অপরটিকে other-এ পরিণত করার চেষ্টা করে। 

 

আজ যখন মানুষের জীবন সন্দেহ আর অবিশ্বাসের চাকায় ঘুরছে, তখন বোভোয়ার যাপন ও কর্ম আমাদের নতুন করে ভাবাতে সাহায্য করতে পারে। চিরন্তনী গন্ধে মশগুল হয়ে যাওয়ার আগে নিজেদের একবার প্রশ্ন করে দেখতে পারি চিরন্তন কাকে বলছি কেনই বা বলছি। Ethics of Ambiguity-তে Passion-কেই প্রাধান্য দিচ্ছেন বোভোয়া, বাতিল করছেন ‘Abosolute Value’-কে। কারণ সমাজনির্দিষ্ট ভ্যালুর স্কেলটাই আদতে একটি কাঠামোর দাসত্ব করে। এক্ষেত্রে সেই কাঠামোটি পুরুষতন্ত্রের। কাজেই নারীবাদ পড়তে বসে, যদি নিজের কাঠামোটার মতো করে বোভোয়াকে পড়ি, বাদ দিই তাঁর আদর্শ ও সেই আদর্শকেই জীবনে অভ্যাস করার নিপুণ মুনশিয়ানা- তবে জি টিভিকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। মিডিয়ার দ্বারা এখনও হেনস্থা হবেন রিহারা। কারণ, পুরুষতন্ত্রের চোখে আত্মহত্যা করা কোনও ছেলের পিছনে থাকে নিশ্চিত কোনও মেয়ের হাত। ভাবুন না, ত্রিকোণ প্রেমে কারও একটা আত্মহত্যার সুস্বাদু রিপোর্টিংগুলোর কথা, দেখেছেন তো সকলেই। কাগজে বা টিভিতে। আমরা একদিকে দুই নারী হাতে তরবারি বলে খ্যাক খ্যাক করে হাসি। আর ফেসবুকে হ্যাশট্যাগের সঙ্গে মি টু জুড়ে দিয়ে ভাবি নারীবাদের প্রশস্ত পথ খোলা।  


    


তথ্যসূত্র :

১) নারী, হুমায়ুন আজাদ, আগামী প্রকাশনী।

২) সিমন দ্য বোভেয়ার, সম্পাদনা বীতশোক ভট্টাচার্য ও সুবল সামন্ত, এবং মুশায়েরা

৩) Freedom and Feminism In Simone De Beavoir’s Philosophy, Tove Pettersen, Simon De Beauvoirs Studies Volume 24 2007-2008, Brill

৪) Beauvoir, Sartre and generous passion, Jean Pierre Boule`, Simon De Beauvoirs Studies Volume 27 2010-2011, Brill 

৫) Simon de Beauvoir (1959)- Full interview, you tube 

৬) Simon de Beauvoir & Satre (1967), you tube

৭) Simon de Beauvoir Interview why I’m a feminist (1975)

৮) BBC Radio 4 Podcast, Simon de Beauvoir (In our Time)  

   

#simone de beauvoir #activist # feminist #social theorist #philosopher #existentialist #writer #নারীবাদ #Jean-Paul Sartre #নারীমুক্তি #The Second Sex #Memoirs of a Dutiful Daughter #সৌপ্তিক #সিলি পয়েন্ট #Birthday

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

16

Unique Visitors

214978