ময়মনসিংহের তেভাগা আন্দোলনে প্রতিবাদের মুখ রাসমণি : এক বিস্মৃত অধ্যায়
"চৈত্র মাসে যদি কখনো ময়মনসিংহ যাও, রাত্তিরে উত্তরে তাকাবে। দেখবে যেন একরাশ ধোঁয়াটে মেঘে কারা আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। ভয় পাবার কিছু নেই, আসলে ওটা মেঘ নয়, গারো পাহাড়"।
কাঞ্চনজঙ্ঘা যেমন মেঘাচ্ছন্ন মোহময়ী রূপে নিজেকে সাজিয়ে তোলে, তেমন রানির সাজ নয় এটা। রোমান্সের নামগন্ধ নেই এখানে। এ সাজ আসলে গারো পাহাড়ের নীচে ভুখা প্রজাদের খাদ্য সংগ্রহের প্রস্তুতির সাজ। প্রতিকূল পরিবেশকে বাগে এনে এভাবেই নিজেদের রুটি-রুজি জোগাড় করে গারো পাহাড়ের নীচে বাস করা মানুষেরা। চাষের জন্য মাটি নেই, তবুও চাষ করে তারা। কেমন করে? জঙ্গলে আগুন লাগানোর পর যখন তা নিভে যায় এবং পাহাড়ের গায়ে এক পুরু ছাইয়ের আস্তরণ তৈরি করে, তার উপর ফসলের বীজ ছড়িয়ে দেয় হাজং উপজাতি। পোড়া কালো জমি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হাজংদের হাতের জাদুতে হয়ে ওঠে সবুজ। 'হাজং' কথার অর্থ 'পোকা'। তাদের হাতেই নাকি ছিল চাষের জাদু তাই তাদের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘হাজং’ - অর্থাৎ চাষের পোকা। কিছু শতাব্দী আগে সে অঞ্চলে এক অদ্ভুত আইনের কথা শোনা যায়। 'হাতিবেগার' আইন। কেবলমাত্র জমিদারদের শখ পূরণের জন্য অন্যান্য গ্রাম থেকে এক-কাপড়ে প্রজাদের নিয়ে আসা হতো হাতি ধরতে। বলা বাহুল্য, এমন ভয়ঙ্কর সাধ পূরণে নিজেদের সাধের জীবনটাও দিয়ে দিতে হতো হাজং প্রজাদের। এদের অধিকাংশই ছিল ভূমিহীন বর্গা ঠিকা চাষী। 'ভরপেট না-ও খাই, রাজকর দেওয়া চাই' - এই তো আমাদের চিরকালের শাসন তথা শোষণ ব্যবস্থা। অতিবৃষ্টি বা অনাবৃষ্টিতেও নির্দিষ্ট সময়ে খাজনা দিতে হত তাদের। বীজ বপনের সময় একটা সামান্য ভরা পেটের যে স্বপ্ন দেখত তারা, ফসল পাকার সঙ্গে সঙ্গেই সে স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হত। এমনভাবে প্রতি বছর নিঃস্ব হত হাজং প্রজারা। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘আমার বাংলা’-য় অসাধারণ মরমী বর্ণনা রয়েছে তাদের জীবনযাত্রার -
" বড়ই ধাঁধায় পড়েছি, মিতে-
ছেলেবেলা থেকে রয়েছি গ্রামে;
বারবার ধান বুনে জমিতে
মনে ভাবি বাঁচা যাবে আরামে।
মাঠ ভরে যেই পাকা ফসলে
সুখে ধরি গান ছেলেবুড়োতে।
একদা কাস্তে নিই সকলে।
লাঠির আগায় পাড়া জুড়তে
তারপর পালে আসে পেয়াদা
খালি পেটে তাই লাগছে ধাঁধা।।"
তারা ফসল না দিলে বা খাজনা দিতে না পারলে উচ্ছেদ ছিল একমাত্র শাস্তি। এই প্রথার নাম ছিল ‘টঙ্ক’ প্রথা।
কিন্তু শোষণই তো জন্ম দেয় প্রতিবাদের, প্রতিবাদীর। সুসঙ্গ পরগনার ভেদিপুরা অঞ্চলের বগাবারী গ্রামের এমনই এক টঙ্ক চাষীর ঘরে জন্ম নেয় রাসমণি। বাল্যবিধবা, তাই সমাজের বিচার অনুসারে খুব দ্রুতই তার নামের সঙ্গে জুড়ে যায় নতুন তকমা - 'ডাইনি' রাসমণি। কিন্তু তা বিন্দুমাত্র বিচলিত করতে পারে না তাঁকে। তিনি জানতেন, কীভাবে একার লড়াই জিতে নিতে হয় - জীবন সংগ্রাম থেকে যুদ্ধক্ষেত্র সর্বত্রই। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তারই প্রমাণ দিয়ে গেছেন তিনি।
কখনও নিজের বপন করা ধান থেকে চাল ভেঙে তা বিক্রি করে নিজের যাপন পথ তৈরি করতেন, আবার কখনও তিনি হয়ে উঠতেন সুসঙ্গ অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ ধাত্রী। হ্যাঁ,' ডাইনি' রাসমণির হাতেই প্রথম কেঁদে উঠতো সে গ্রামের নবজাতকেরা। তাদের সুস্থ রাখার দায়িত্বও ছিল তাঁরই উপর। এই বাল্যবিধবাই হয়ে উঠেছিলেন হাজং সমাজের কান্ডারী।
সময়টা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। সমস্ত পৃথিবী জুড়ে চলছে এক ভয়ংকর যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা, চলছে ব্যাপক ওলটপালট। মনুষ্য-সৃষ্ট মন্বন্তরে বিপর্যস্ত গ্রামজীবন, হাজং অঞ্চলে সেই দুর্ভিক্ষ রোখার জন্য 'বেশি খাদ্য ফলাও', 'খাল কাটা', ' বাঁধ বাঁধা' ইত্যাদি আন্দোলন গড়ে ওঠে। আর সেইসব আন্দোলনের অন্যতম প্রধান মুখ হয়ে ওঠেন রাসমণি। তাঁর নেতৃত্বে গামে গড়ে ওঠে 'মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি'। পঞ্চাশের মন্বন্তরে যখন কিছু স্বার্থান্বেষী মুনাফালোভী মানুষ উৎপাদিত দ্রব্য নিজ খামারে মজুত করে রেখে শুরু করেছিল কালোবাজারি, ঠিক তখনই তিনটি গ্রামের অন্নের দায়িত্ব নিয়ে লঙ্গরখানা খুলেছিলেন রাসমণি। এবং তার জন্যে শুধুমাত্র দরজায় দরজায় গিয়ে চাল সংগ্রহ নয়, কালোবাজারি চোরা ব্যবসায়ীদের মজুতখানা থেকে রাসমণির নেতৃত্বে বাজেয়াপ্ত করা হতো চাষীদের হকের চাল। এভাবেই 'ডাইনি' রাসমণি হয়ে ওঠেন 'অন্নপূর্ণা'।
চাষীদের অশিক্ষার সুযোগ নিয়ে জমিদারেরা চিরকালই নিজেদের ইচ্ছামত বাড়িয়ে গেছে একের পিঠে শূন্যের সংখ্যা। ইতিহাস বরাবর আমাদের সেই গল্পই শুনিয়েছে। তাই প্রয়োজন শিক্ষার। যাতে অশিক্ষার কারণে হাজং চাষীদের আর সর্বস্বান্ত হতে না হয় তার জন্য সেই অঞ্চলে রাসমনির আবেদনেই শুরু হয় এক নৈশ বয়স্ক বিদ্যালয় এবং স্বয়ং তিনিই ছিলেন সেই বিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী। কালক্রমেই এই স্কুল হয়ে ওঠে রাজনৈতিক শিক্ষার পীঠস্থান। বর্ণপরিচয় হাতেখড়ির সঙ্গে চলতে থাকে রাজনৈতিক আলোচনাও। এমনভাবেই রাজনৈতিক শিক্ষা অর্জন ও অভিজ্ঞতার গল্প শোনার মধ্যে দিয়েই সেদিনকার বাল্যবিধবা 'ডাইনি' রাসমণি গড়ে তোলে এক বিপ্লবী দল। তিনি গ্রহণ করেন ময়মনসিংহের সীমান্ত অঞ্চল ও পার্বত্য অঞ্চলের আন্দোলনের নেতৃত্ব।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বাংলার বুকে দানা বাঁধতে থাকে তেভাগা আন্দোলনের বীজ। টঙ্ক আন্দোলনের পর ময়মনসিংহে তেভাগা আন্দোলন আরও তীব্র আকার নেয়। সারা জেলায় তেভাগার লড়াই শুরু হয়ে যায়।
‘আধি নয় তেভাগা চাই’, ‘ফসল কেটে ঘরে তোল’, ‘দখল রেখে চাষ কর’, ‘টঙ্ক প্রথার উচ্ছেদ চাই’, ‘জান দেব তবু ধান দেব না’, ‘বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ চাই’ - ইত্যাদি স্লোগান কণ্ঠে নিয়ে আন্দোলনের প্রথম সারিতে এসে দাঁড়ায় নারীবাহিনী। গোলাম কুদ্দুস তাঁর 'লাখে না মিলায়ে এক'-এ বলেছেন, "গ্রামের সে ভয়ানক দিনগুলির মধ্যে যে না থেকেছে সে কি করে বুঝবে কৃষক মেয়েদের মনের ভাব, যখন তারা ধানের আটির উপর হাত বুলিয়ে বলে,- মা লক্ষী ঘরে এয়েচ? তোমাকে আমি ছাড়বো না।- ' জান দেব তো ধান দেব না' র রহস্য এই।" ময়মনসিংহের সীমান্ত অঞ্চলে ও অন্যান্য স্থানে আন্দোলনরত চাষীদের শক্তি জুগিয়ে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন রাসমণি। শুধুমাত্র চাষীদের নয় গ্রামে গ্রামে তিনি উদ্বুদ্ধ করেছিলেন চাষির ঘরের মেয়েদেরও। হাজং বিদ্রোহের ফলে সুসঙ্গ অঞ্চলের জমিদারির তিনটি মহকুমায় জমিদারের' রাজত্ব যখন প্রায় তলানিতে ঠেকেছিল, তখন ১৯৪৬ সালে ব্যাস্টিন সাহেবের পরিচালনায় 'ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল বাহিনী' হাজং অঞ্চলের উপর আক্রমণ করে নিজেদের অধিকার ফিরে পেতে। ভয়ংকর ধ্বংসলীলার পরেও হাজং চাষিরা পিছু হটেনি। এই রাসমণির নেতৃত্বেই সেদিন চাষী ও চাষী বউরা দা তীর-ধনুক নিয়ে বন্ধুকে সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। রণক্ষেত্রে দাঁড়িয়েই এই রণংদেহি শেখালেন নতুন যুদ্ধ মন্ত্র, শেখালেন ঐক্যের শক্তি।
লড়াই তখন মধ্যগগনে। দিনটা ছিল ১৯৪৬ এর ৩১ শে জানুয়ারি। বহেরাতলি গ্রাম কেঁপে উঠেছিল এক লাঞ্ছিত কৃষক-বধূ সরস্বতীর আর্তনাদে। ২৫ জন সৈন্য হাজং অঞ্চলের বহেরাতলি গ্রামে ঢুকে চালিয়েছিল লুটতরাজ। লুটেছিল মা-বোনেদের ইজ্জত। রাসমণি ও তার অনুগামীরা সে সময় পার্শ্ববর্তী গ্রামেই বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। সরস্বতীর আর্তনাদ এসে পৌঁছলে ৩৫ জন বীরকে নিয়ে রাসমণি ছুটে যান বহেরাতলি গ্রামে। তীর-ধনুক, দা হাতে লড়াই চলে প্রতিপক্ষ রাইফেলধারী ২৫ জন সৈন্যদের বিরুদ্ধে। সরস্বতীর ইজ্জত-হরণকারীকে শনাক্ত করে তাকে নিজে হাতে শেষ করেন রাসমণি । চলতে থাকে পাল্টা গুলিবর্ষণ। অন্তত দশটা বুলেটের ঘায়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে রাসমণির লাশ।
রাসমণিদের মৃত্যু হয়না। তাঁরা আজও লুকিয়ে থাকেন মিছিলের মধ্যে - নতুন রাসমণিকে মিছিলের প্রথম সারিতে দেখবেন বলে। আর আমাদের কাজ ধুলো লাগা ইতিহাস ঘেঁটে রাসমণিদের গল্প তুলে আনা।
ঋণ : ১) তেভাগা সংগ্রাম, সুপ্রকাশ রায়।
২) তেভাগার নারী, সম্পাদনা: চিত্তরঞ্জন পাল।
৩) আমার বাংলা, সুভাষ মুখোপাধ্যায়।