আমার আকাশও নীল
কিছু লেখার আগে কখনও এমন ফাঁপড়ে পড়িনি। এমনকি, মাধ্যমিকের আগে দুঃস্বপ্ন দেখেও না। ক্লাস এইটে প্রথম X = যে কী হবে তা বের করতে গেলাম। সামনে এক সহপাঠী, ক্লাসের ফার্স্টবয়, সে-ও আমার মত খাবি খাচ্ছে। শেষে কীভাবে সে অঙ্ক কষল তা কেবল ঈশ্বরই জানেন, X = X বেরোল। সে খাতাটি অল্প দেখালে, আমি খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলাম। এই তো মিলেছে! মিলেছে! লেফট হ্যান্ড সাইড সমান সমান রাইট হ্যান্ড সাইড! আর পায় কে, কষে দিলাম ওভাবেই। কে জানে পরীক্ষার শেষ পাঁচমিনিটে কী চেপেছিল মাথায়। বীজগণিত তার বীজগুলিকে ঠিকভাবে কখনোই উপ্ত করতে পারেনি মনে। বাড়িতে ফিরে এসে দেখলাম অঙ্কের স্যার বসে আছেন টেনশন হাতে নিয়ে, পাশে মা এনে রেখেছেন চা। উনি ছুঁয়েও দেখেননি। আমি গদগদ হয়ে তাঁকে এই নতুন উদ্ভাবিত অঙ্কের ব্যাপারে জানালাম। উনি অত্যন্ত হতাশ হয়ে পড়লেন। বললেন, “তোর মাথায় কি একটুও এলো না, X = X কখনও হতে পারে না! তুই কি অঙ্ক পরীক্ষায় সাহিত্য লিখে এলি?” আমার নয়া উদ্ভাবিত গাণিতিক কৌশলের সেখানেই সুশ্রী ইতি।
আজ মনে হয়, মানুষের মধ্যে থেকেও সবসময় এক্স ইকুয়ালটু এক্স হয় না। বরং অন্য কিছু। জীবনের অঙ্ক কখনোই সমান ক্যালকুলেশন নিয়ে চলে না।
ছোটবেলা থেকে সামান্য ‘মেয়েলি’ ছিলাম। কিন্তু সেটাই আমার আত্মীয় বা বন্ধুমহলে আমাকে অসামান্য বানিয়ে দিয়েছিল। মা বাবা আমায় নিয়ে চিন্তায় থাকতেন। দাদা আট বছরের বড় আমার থেকে – পড়াশুনোয় মারকাটারি মেধাবী। তার ভাই আমি, সবাই ভাবত আমিও তাকে অনুসরণ করব। তাল কাটল প্রথম বড়পিসিমার বাড়ি গিয়ে। তার আগে পাড়ায় গান গাইতাম, প্রশংসা আসত পাড়া থেকে। সে বার ক্লাবে প্রোগ্রাম হবে পনেরোই আগস্টের, যাকে বলে গালা সেলিব্রেশন। পাড়ার দিদিরা গাইবে গান। তিনজন দাদাও গান গাইবে। যিনি অনুষ্ঠানটা করাচ্ছিলেন, তিনি আমায় নিয়ে গেলেন। গানের সঙ্গে সঙ্গে নাচও হবে। মহড়ায় বসে আমি সাত বছর বয়সী এক মুগ্ধ গায়ক, যে কিনা কোরাসে গাইছে আর নাচ দেখছে। নাচগুলো সহজ ছিল খুব আজ বুঝতে পারি, তাই নাচগুলি দিব্যি তুলে ফেলতাম বাথরুমে স্নান করতে গিয়ে।
কথায় ফিরি, বড়পিসিমার বাড়িতে গানের আসর বসল। আমি বাচ্চা গলায় গাইছি। হঠাৎ “উঠ গো ভারতলক্ষ্মী” গাইতে গাইতে হাতের মুদ্রায় সেই বাথরুমে তুলে নেওয়া নাচ বেরিয়ে এলো। সবাই কী উচ্ছ্বসিত! তুই নাচতে পারিস? নাচ নাচ! গ্যাস-ট্যাস খেয়ে নাচতে উঠলাম। সবার সে কী উৎসাহ! ভীষণ আনন্দ পেলাম। পরের দিন সন্ধের আসরে আবার নাচার অনুরোধ। নাচলামও। হঠাৎ বাজ পড়ার মত আওয়াজ। আমার বাবার গলাফাটানো চিৎকার - “তুমি নাচবে না! নাচলে মেরে আধমরা করে দোবো!”
আমি হতবাক, স্তব্ধ। আসর মাটি হল। তারপর দুদিন পিসির বাড়িতে ছিলাম, দূর থেকে দেখতাম পিসতুতো ভাই-বোনেরা কি যেন একটা হাসাহাসি করত আমার নামের মতো কী একটা নাম নিয়ে। আমার বাবার উপর আরো রাগ চড়ে গেল। ভাবলাম উনি হয়তো আরো কিছু বলেছেন তাই ওরা আমোদ পাচ্ছে। যেদিন বাড়িতে ফিরলাম, সেদিন বাবা খুব বকলেন। বললেন, আমায় গার্লস স্কুলে ভর্তি করাবেন। বড়ো চুল রেখে যেন আমি মেয়ে সাজি। খুব কাঁদলাম। শেষে মা এলেন রাত্রে খাবার পরে আমার পাশে। মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, “বাবার উপর রাগ করিস না। তুই জানিস না, তোকে যারা নাচতে বলেছিল তারা সবাই বাইরে এসে তোর সম্পর্কে খারাপ কথা বলেছে। বলেছে আমরা তোকে নাকি এসব করতে শিখিয়েছি। আমাদের কুশিক্ষায় তুই মেয়েদের মত আচরণ করছিস। তোকে আমরা ছেলেদের মত করে মানুষ করতে পারিনি। আমরা তো তোকে ভালোবাসি বল বাবা, তোর সম্পর্কে এরকম শুনলে বাবার কষ্ট হয় না? তাই তো অমন করে তোকে বারণ করলেন। ওরা ভালোবেসে দেখতে চায়নি, ওরা ঠাট্টা করার জন্য দেখতে চেয়েছিল।”
সেদিন এত অসম্ভব অবাক হয়েছিলাম যে মাকে উত্তর দিতে পারিনি কিছু। কেবল একটা উত্তর খুঁজে বেরিয়েছি। আমি তো তাদের বিশ্বাস করলাম। নিজের কিছুই তো অনাবৃত রাখিনি। তারা তো আমার থেকে বয়সে বড়ো। সবসময় বলে, খুব নাকি বুঝদার। তারা কেন এমন করল?
বড় হয়েছি, কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। গান শিখেছি। নাচের দিকে ভুলেও যাইনি। গ্র্যাজুয়েশন করার সময় হঠাৎ নাচের গুরুর সন্ধান পেলাম। নিজের দেহকে ঋজু থেকে অঋজু করে, মন্দিরগাত্রের ভাস্কর্যের জীবন্ত প্রতিরূপ করে, নিজেকে মন্দির বানিয়ে দেবতার কাছে নাচকে উৎসর্গ করতে শিখলাম। সেদিন উপলব্ধি করলাম, যে নাচ আমার রূপান্তরকামী জীবনকে ঠোক্কর খাইয়েছিল, সেই নাচই আমার জীবনকে সমকামী, উভকামী ও বিষমকামী এই তিন স্তর থেকে বহু দূরে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে ভগবতীর নির্মলজ্ঞানসাগরে মজিয়ে দিল। সেখানে অন্তত কেউ আমাকে টিটকিরি দেবে না।
বেশিক্ষণ বিষাদের কথার ভ্যাজভ্যাজানি ভালো নয়। উপরের কথাগুলি প্ল্যাটফর্ম মাত্র। এবার মজার কথায় আসি। ছোটবেলায় স্কুলের ছেলেরা গার্লস স্কুলের কাছ দিয়ে যেতে কী যে ভালো বাসত! আর মেয়েরাও যারা জানলার কাছে বসতো তারা যেন অধীর হয়ে অপেক্ষা করত কখন ছেলেগুলো যাবে। ‘তিরচি নজরিয়া’-র এক-একটা কটাক্ষ আর উত্তেজনায় টইটম্বুর ছেলেদের পুরকির হাসি হাসতে হাসতে এগিয়ে যাওয়া। তখন গার্লফ্রেন্ড বা বয়ফ্রেন্ড বলে কিছু নেই। চোখাচোখি হল কী সামান্য হাসি বিনিময় হল - সঙ্গে সঙ্গে সেই মেয়ে হয়ে যেত ছেলেটির বউ আর অন্য ছেলেদের বউদি। সম্পর্কের এত সরলীকরণ ভাবাই যায় না। আর আমি? ভাগ্যের ফেরে আমার দুটি বন্ধু জুটেছিল। আমরা তিনজন ছিলাম সমকামী। স্কুলের ইয়াং স্যারেরা আমাদের ব্যাথার কারণ ছিলেন। তিনজনে একসঙ্গে স্কুল থেকে ফিরতুম। আর আমার থেকে ওরা দুজন ছিল খুব স্ট্রেট ফরোয়ার্ড। সিনিয়র দাদাদের ঝাড়ি মারত। কয়েকজন দাদা আবার রেসপন্সও করতো দিব্বি তাতে। তাতে আমার সহচরদুটির সে কী পবিত্র উল্লাস!
আমার যাপন ছিল আবার অন্যরকম। তখনো বুঝতে পারিনি আকর্ষণ কেন হচ্ছে। ক্লাস সিক্সে পড়াকালীন সিইএসসি-র বিল এসেছিল একবার খামে করে। খামে আসার কারণ হয় ক্লিনিক প্লাস নয়তো ক্লিনিক অলক্লিয়ারের বিজ্ঞাপনের নমুনা শ্যাম্পু। পাঠিয়েছিল ফ্রি স্যাম্পেল হিসেবে। তাতে ছিল বিপাশা বসু আর জন আব্রাহামের ছবি। দুজনের চামড়া টানটান, সুন্দর। আর চুল কুচকুচে কালো শ্যাম্পুর কেরামতিতে। খামটি ফেলে দেওয়ার আগেই চুপচাপ সংগ্রহ করলাম। সকালে স্কুল যাবার আগে আর রাত্রে শুতে যাবার আগে বের করে দেখতাম। উদ্দেশ্য একটাই, জন আব্রাহামকে দেখা। ফ্যান্টাসি করার মত মনের পাকামি আসেনি তখনও। দেখতেই ভালো লাগত কেবল। একদিন দাদা ধরে ফেলে - “কি দেখছিস রে?” তাড়াতাড়িতে বললাম, “খামটা ওখানে রাখা আছে তাই দেখছি।” বলে ফেলে দিলাম। প্রথম জীবনের ক্রাশ তার ‘কেশসঙ্গিনী’-কে নিয়ে ময়লার বালতিতে করে জমাদারের গাড়িতে মহাভিনিষ্ক্রমণ করলেন। জন আব্রাহামের অমন ছবি আর পাইনি। অথবা হয়তো আমার সেই পুরোনো মনটাকেই ফিরে পাইনি আর।
বড় হলাম। মাধ্যমিকে ভালো ফল করলাম। এক বন্ধুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলাম। যৌবনের টান হচ্ছে ঘিয়ের কাছে আগুন। কিন্তু বন্ধুটি সবাইকে বলে দিল। ফলে যা হবার তাই হল। অসহ্য টিটকিরি, অসহ্য টিজিং। চোখ তুলে তাকাতে পারতাম না। বাঁচিয়েছিল পরীক্ষার রেজাল্ট আর গুটিকতক বন্ধু। তারা আমাকে টিজ করেও ভীষণ ভালোবাসত, অপমান করত না সবসময়। তাদের কাছে থাকতাম। তারা বুঝতে পারত আমার আকাঙ্ক্ষা। কখনো তার জন্য দূরে সরে যায়নি। আজও না। সেদিনের পরে তাদেরই মধ্যে এক বন্ধু বলেছিল – “তুই ওদের কথায় কষ্ট পাচ্ছিস, জানিস ওরা বাথরুমে গিয়ে কী করে? কোচিং-এ গিয়ে কী করে? তুই দোষী হলে ওরাও তো দোষী। নিজেকে কেন কষ্ট দিচ্ছিস?” এতটা হয়তো গুছিয়ে বলতে পারেনি, কিন্তু ভাবটুকুই ছিল যথেষ্ট। সেদিন থেকে আমার দৃঢ়ভাবে পথ চলার হল শুরু। ‘দোষী’ কেবল আমি না, ‘দোষী’ তারাও। আমার ‘দোষ’ আমি সামনে এনেছি, তারা পারেনি। এরপর বড় হওয়া। জীবনে বয়ফ্রেন্ডের আগমন। একাধিক। এই জগৎ থেকেই বন্ধু এসেছে অনেক। তারাও কম-বেশি বিড়ম্বিত। তাই প্রচলিত জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন। একটা নতুন চাদর আমরা বুনে নিয়েছি যেন - সবাই তাতে ঘাপটি মেরে নিজের আনন্দে মেতে থাকি। তবে একটাই ভয় থেকে যায় - দূর ভবিষ্যতে কী হবে? মা-বাবার যে ভালোবাসার ফল্গুধারা আমাকে ঘিরে রেখেছে, তা অন্তর্হিত হলে আমি বাঁচব কোথায় গিয়ে?
আরও পড়ুন : লাল নীল সবুজেরই... / দোয়েল রক্ষিত
সমকামিতা পাপ। অবশ্যই পাপ। অন্তত এই সমাজে পাপ। আমি স্বীকার করি। যে সমাজে প্রেমকে শরীরের চিহ্ন দিয়ে বিচার করা হয়, যে সমাজে সামনে বন্ধু হয়ে পিছনে লেগপুলিং করা হয় - সে সমাজে সমকামিতা থাকা পাপ। কিন্তু তাহলে বিসমকামিতাও তো পাপ। কারণ প্রেম তো লিঙ্গ বিচার করে আসে না। আমার শরীরের কোনও একটা অংশকে যেমন ইচ্ছা করলেই আমি নির্বাসিত করতে পারি না, তেমনই প্রেমেরও এক অংশকে ভালো অন্য অংশকে খারাপ বলতে পারিনা। আর যতদিন অন্যকে দমন বা পীড়ন করে আনন্দ পাবার অমানবিকতা থাকবে - ততদিন প্রেম অবশ্যই পাপ। ভালোবাসা পাপ। নিজেকে অনাচ্ছাদিত করা পাপ।
একটা আনন্দের মুহূর্ত খালি একটু বলে যাই। যেদিন বছর তিনেক আগে সুপ্রিম কোর্টে সমকামিতার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়, সেদিন আমার প্রিয়টি ফিরছিলেন কলেজে পড়িয়ে। দেখতে পেয়েই রাস্তায় তাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম আনন্দে। রাসবিহারীর মোড়ে। করোনা ছিল না তখন।
আরও পড়ুন : AS PARROTS CATCH FIRE, ROSES DRAW FLAME / Trijit Acharyya
সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল, লোকের দৃষ্টিকে কে পরোয়া করে আর! এখন তো আমার আকাশটা আমি নীলই দেখব। অন্য রঙের চশমা পরে জোর করে ধূসর দেখব না।
….………………………………..
[ব্যক্তিগত কারণে লেখক নিজের নাম গোপন রেখেছেন]
#সিলি পয়েন্ট #ওয়েবজিন #pride month #Lgbt Community #অপ্রকাশ সেন