ফিচার

মিজলস মহামারি : জনস্বাস্থ্য ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

অহনা বড়াল Mar 30, 2022 at 5:48 am ফিচার

হাম। আমাদের অত্যন্ত পরিচিত রোগ। তীব্র ছোঁয়াচে এই রোগটির জন্য দায়ী মিজল্‌স মর্বিলিভাইরাস (Measles morbillivirus) নামে এক ভাইরাস। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, সারা পৃথিবী জুড়ে মাঝেমাঝেই মহামারির আকার ধারণ করেছে এই রোগ। এমনকি সাম্প্রতিক অতীতেও এর প্রাদুর্ভাব লক্ষ করা গেছে।

দিনটা ১৫ ই নভেম্বর, ২০১৯। কোভিড-১৯ তখনও এক ভোরের দুঃস্বপ্ন, বাস্তব নয়। কিন্তু, দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের সামোয়ার অন্তর্গত দ্বিতীয় জনবহুল দ্বীপ উপলু-র দরজায় কড়া নাড়ছিল এক মহামারি যার কার্যকর ভ্যাকসিন থাকা সত্ত্বেও সেদেশের জনসংখ্যার একটা বড়ো অংশ ইচ্ছাকৃতভাবে এর আওতার বাইরে থেকে যাওয়ায় মহামারি ছড়িয়ে পরার এবং তার ফলে বহু শিশুর মৃত্যুর আশঙ্কা করেছিলেন সেদেশের সরকার।

কিন্তু কী এই মহামারি? আগস্ট, ২০১৯ নাগাদ ওই উপলু দ্বীপে নিউজিল্যান্ড থেকে আগমন ঘটে এক পর্যটকের। ওই সময় নিউজিল্যান্ডে চলছিল হামের মহামারি এবং ওই পর্যটকটিরও গায়ে ছিল লাল লাল ফোস্কার অস্তিত্ব। কিন্তু, সেই সময় উপলু’র জনস্বাস্থ্য কর্মীরা এই বিষয়ে উদাসীন থাকায় এক ভয়ঙ্কর অসুখের বাধাহীন প্রবেশ ঘটে যায় এই দ্বীপ-দেশে।
এরপর ২রা অক্টোবর নাগাদ, উপলু-র সাত নাগরিকের শরীরে ‘হাম’ দেখা দিল। শিশুদের মধ্যে এই রোগের প্রকোপ বেশি হওয়ায় স্কুলগুলি থেকে এই রোগের সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার হার অধিকমাত্রায় বাড়তে শুরু করল। কিন্তু সেক্ষেত্রেও চোখে পড়ল সরকারী উদাসীনতা। কেবলমাত্র আইন করে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে জনসমাগম নিষিদ্ধ করা হলেও ওই আদেশও পালিত হল ঢিলেঢালাভাবে। খোলা থাকল প্রতিদিনের পঠনপাঠন।
নভেম্বরের শুরুতে রোগীর সংখ্যা ৭১৬ জনে গিয়ে দাঁড়ায়। মাত্র ১ লক্ষ ৯৭ হাজার জনসংখ্যার উপলু দ্বীপে তা প্রায় ০.৪% রোগাক্রান্তের হার নির্দেশ করে। এই হার ছোঁয়াচে রোগের জন্য জনসংখ্যার তুলনায় বেশ উদ্বেগজনক। এরপরই উপলু’র সরকার নড়েচড়ে বসে। সারা দেশজুড়ে জারি হয় জরুরি অবস্থা। ভ্যাকসিনকে বাধ্যতামূলক করে শুরু হয় জোর কদমে ভ্যাকসিনেশন। বন্ধ করা হয় আন্তর্জাতিক উড়ান। দেড় মাস পর জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়া হলে দেখা যায় যে, সেদেশের মোট ৫৬৬৭ জন হামে আক্রান্ত হয়েছেন এবং ১৫ বছর বয়সের নিচে শতকরা ৮ ভাগ শিশুই এই রোগের শিকার। পাশাপাশি মৃত্যু হয়েছে ৮১ জনের।
কিন্তু, প্রশ্ন ওঠে, হাম তো প্রতিরোধযোগ্য একটি ব্যাধি, তাহলে কেন এই মহামারি? আসলে, ২০১৮ সালে হামে, মাম্পস আর রুবেলা’র টিকা নিয়ে মৃত্যু হয়েছিল দুই শিশুর যা সেদেশের জনসমাজে ভ্যাকসিনের প্রতি এক ভীতির জন্ম দেয়। ফলত, ঐ দেশে ২০১৭-১৮ সালে যেখানে হামের টিকাপ্রাপ্ত মানুষের সংখ্যা ৮০-৯০ শতাংশ ছিল সেখানে ২০১৯ সালে তা নেমে যায় ৩০ শতাংশে। আর হামের টিকা নেওয়ার প্রবণতা এই নিম্নমুখী হারই নিউজিল্যান্ড থেকে আমদানিকৃত ঐ ভাইরাসকে তৈরি করে দেয় মহামারী সৃষ্টির এক উর্বর ক্ষেত্র।

মহামারির অবসান ঘটে ঠিকই কিন্তু মানবজাতির জন্য তা রেখে যায় এক নতুন হুমকি — ইমিউন অ্যামনেসিয়া বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার বিস্মরণ মহামারী যত না ভয়ানক তার চেয়ে অনেক বেশি ভয়ানক এই ইমিউন অ্যামনেসিয়া। এখনও পর্যন্ত এটা সৃষ্টি করার একমাত্র ক্ষমতা রয়েছে হামের জন্য দায়ী মিজলস ভাইরাসের। ছোঁয়াচে ভাইরাসদের মধ্যে একেবারে প্রথম সারির ভাইরাস হলো মিজলস। প্রায় দুই ঘণ্টা বাতাসে ভেসে বেড়ানোর ক্ষমতা রয়েছে তার। আজ থেকে প্রায় নয় বছর আগে আবিষ্কৃত এই ভাইরাসে বিজ্ঞানীরা প্রথম লক্ষ্য করেন যে, মিজলস আমাদের শরীরের বিশেষ কিছু রক্তকণিকা, যা মূলত ‘মেমোরি সেল’ নামে পরিচিত তাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। এই ‘মেমোরি সেল’ মূলত আমাদের শরীরে কোনো রোগ-জীবাণুর প্রবেশ ঘটলে তাদের ছিনিয়ে রাখার কাজ করে, যাকে দ্বিতীয়বার দেখামাত্রই দ্রুত রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং সেইসকল পূর্বপরিচিত রোগজীবাণুর অবধারিত অসুস্থতা থেকে শরীরকে রক্ষা করা সম্ভব হয়। কিন্তু, এই মিজলস ভাইরাস দ্বারা আমাদের শরীর কোনোভাবে আক্রান্ত হলে, তা আমাদের শরীরের মেমোরি সেলগুলোকে ধ্বংস করে আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় শিশু অবস্থায় যখন আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ছিল শূন্য। আর এই বিস্মরণ স্থায়ী হওয়ায় আবার সমস্ত রোগ-জীবাণুকে নতুন করে চিনতে হয়।

সামোয়া-র মত এক ক্ষুদ্র দেশের এই ঘটনা জনস্বাস্থ্য বিপর্যয়ের এক জ্বলন্ত উদাহরণ। কোভিড মহামারির সঙ্গে লড়তে থাকা আজকের দুনিয়ায় উক্ত বিপর্যয়ের কারণগুলো এক একটি ‘রেডফ্ল্যাগ’, যার থেকে বাঁচতে ভ্যাকসিন গ্রহণ ও এই বিষয়ে প্রশাসন ও জনগণের যৌথ ও সচেতন প্রচার ও প্রয়াস-ই একমাত্র পথ।

#মহামারী #সামোয়া #জনস্বাস্থ্য #হাম #শিশুমৃত্যু #মিজলস

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

26

Unique Visitors

214989