কেট ওয়ার্ন : মেয়েদের গোয়েন্দাগিরির পথ দেখিয়েছিলেন যিনি
ব্যোমকেশের 'শজারুর কাঁটা'-র কেসে দীপা তার ভালোবাসার মানুষটির উপর একান্ত নির্ভর করে ছিল। সে ভেবেছিল একদিন ঘোড়ায় চড়ে আসবে সেই রাজকুমার, তাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু সেই আসার জন্য একাধিক নিরীহ মানুষের রক্ত হাতে মেখে নিতে যে তার বাধবে না, সে কথা বুঝতে পারেনি ঘরবন্দি মেয়েটি। আর এই না বুঝতে পারার 'অপরাধে' গল্পের শেষে মহামান্য সত্যান্বেষী বলেন, "হাজার হোক মেয়েমানুষের বুদ্ধি, বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন, 'কখনো অর্ধেক বৈ পুরা দেখিলাম না'।"
'মেয়েমানুষের বুদ্ধি!' অর্থাৎ, মেয়েদের ক্ষেত্রে বুদ্ধির পরিচয় দেওয়াটাই যেন একটা অসম্ভব কথা। তাহলে বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়েই যে কাজ হাসিল করতে হবে, সেই কাজে মেয়েদের জায়গা হবে কেমন করে? মুশকিল হল, বুদ্ধি কম বলেই মেয়েরা এই সহজ কথাটা মোটেই বুঝতে চায় না। আর তাই ব্যোমকেশ বক্সীর ভাবনার গণ্ডিকে সম্পূর্ণ ভেঙেচুরে দিয়ে গোয়েন্দাগিরির মতো সম্পূর্ণ বুদ্ধিনির্ভর কাজটিতেও দিব্যি যোগ দেয় তারা। আর কী আশ্চর্য, সকলকে অবাক করে দিয়ে রহস্যের জটও ছাড়িয়ে ফেলে অবলীলায়। মেয়েদের এই পথে চলার শুরু অবশ্য আরও অনেকটা আগে। বাস্তবের এক মেয়ের হাত ধরেই।
সময়টা ১৮৫৬ সাল। ঘটনাস্থল আমেরিকা হলেও তা আজকের দিনের চূড়ান্ত আধুনিক দেশটি নয়। বরং অনেকাংশে রক্ষণশীল, গোঁড়া আর পিতৃতান্ত্রিক ছিল সেদিনের আমেরিকা। আর সেখানেই এমন এক চাকরি করতে চাইছিলেন ওই বছর বাইশের তরুণীটি, যার গায়ে লেগে ছিল পুরুষের চাকরির তকমা। আর সেই কারণেই মেয়েটিকে চাকরি দিতে একান্তই নারাজ ছিলেন প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ। একে তো সেই সময়ে কর্মরতা মহিলার সংখ্যাই হাতেগোনা, তার উপরে মেয়েদের চাকরির একটা নির্দিষ্ট ধরন বেঁধে দেওয়া আছে। অফিসের চার দেওয়ালের ঘেরাটোপে বসে, কেরানি কিংবা সেক্রেটারির কাজ করে থাকে তারা। তার বদলে এই মেয়ে চায় কিনা রাজ্যের চোর ডাকাত অপরাধীদের পিছনে দৌড়োবার চাকরি? অবাক হবেন না রাগ করবেন, সেটাই বুঝে উঠতে পারছিলেন না পিংকারটন ন্যাশনাল ডিটেকটিভ এজেন্সির মালিক, অ্যালান পিংকারটন।
আরও পড়ুন : দেশে প্রথম মেয়েদের স্কুল, মেয়েদের ‘মানবাধিকার’-এর দাবিতে লড়েছিলেন সাবিত্রী / তোড়ি সেন
আসলে নিউইয়র্ক শহরে একটা ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলে বসেছিলেন অ্যালান পিংকারটন। প্রতিষ্ঠানের গালভরা নাম, পিংকারটন ন্যাশনাল ডিটেকটিভ এজেন্সি। তার জন্যই জনাকয়েক পেশাদার গোয়েন্দা এবং একজন মহিলা সেক্রেটারির প্রয়োজন পড়েছিল। খবরের কাগজে পিংকারটনের দেওয়া বিজ্ঞাপনের সূত্রে চাকরিপ্রার্থীদের আনাগোনা চলছিল অফিসে। যেমনভাবে এসেছিলেন সেদিনের সেই বছর বাইশের তরুণীও, যাঁর নাম কেট ওয়ার্ন। পিংকারটন ভেবেছিলেন, সেক্রেটারির পদের জন্য ইন্টারভিউ দিতে এসেছেন ওই তরুণী। কিন্তু কথা বলতে গিয়েই ভুল ভাঙল। সেক্রেটারি নয়, ডিটেকটিভ হতে চান তিনি। আর হাজারও তর্কবিতর্ক পেরিয়ে অবশেষে সেই চাকরিটি আদায় করেই ছাড়লেন কেট। ১৮৫৬ সালের ২৩ আগস্ট, চাকরিতে যোগ দিলেন তিনি।
আরও পড়ুন : প্রথম এভারেস্টজয়ী মহিলা : জুনকো তাবেই / মন্দিরা চৌধুরী
কিন্তু চাকরি পেলে কী হবে, কর্তৃপক্ষের আস্থা অর্জন করতে রীতিমতো বেগ পেতে হল কেটকে। প্রথম কেস এল পাক্কা দুবছর পরে। তহবিল তছরুপের তদন্ত। মূল অভিযুক্তের ধারপাশ না মাড়িয়ে কেট সোজা হাজির হলেন তার স্ত্রীর কাছে। আর তার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে আস্তে আস্তে বের করে আনতে লাগলেন সব গোপন তথ্য। অপরাধীর ধরা পড়তে সময় লাগল না, উদ্ধার হল খোয়া যাওয়া টাকাপয়সাও। আর এই তদন্ত দিয়েই নিজেকে প্রমাণ করে দিলেন কেট ওয়ার্ন। যে মেয়েটিকে একসময় গোয়েন্দা হিসেবে বহাল করতেই চাননি কর্তৃপক্ষ, পরবর্তী কালে তাঁর কাজের প্রতি তাঁদের এতটাই আস্থা জন্মায় যে, খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনকে রক্ষা করার ভার বর্তায় কেটের উপরেই। সেসময় ক্রীতদাস প্রথা বন্ধ করার জন্য আইন করতে চলেছেন লিঙ্কন। তার জেরেই তাঁকে গুপ্তহত্যা করার চক্রান্ত করে বিরোধী পক্ষ। এই পরিস্থিতিতে, ১৮৬২ সালে ওয়াশিংটন সফরে বেরোলেন প্রেসিডেন্ট। যাত্রাপথে একাধিকবার ট্রেন বদল করতে হবে। সেখানে হামলার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। অতএব আগেভাগেই প্রেসিডেন্টের জন্য নির্ধারিত হোটেলে গিয়ে উঠলেন কেট। ছদ্মবেশে ভাব জমালেন শহরের অভিজাত ব্যক্তিদের সঙ্গে। আর সেই সূত্রেই পাওয়া টুকরো টুকরো খবর জুড়ে প্রেসিডেন্টকে হত্যার পুরো ছকটা স্পষ্ট সাজাতে পারলেন তিনি। ব্যস, অর্ধেক কাজ এখানেই সারা। এবার বাকি রইল প্রেসিডেন্টকে রক্ষা করার কাজ। তাঁকে নিজের বিকলাঙ্গ ভাই সাজিয়ে ট্রেনে উঠলেন কেট। পিস্তল হাতে সারারাত জেগে রইলেন সতর্ক প্রহরায়। কেটের দৌলতেই সেদিন নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে গিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন।
আরও পড়ুন : রুপোলি পর্দায় দীর্ঘ চুম্বন ঠাকুরবাড়ির মেয়ের : নিয়ম ভাঙার আরেক নাম দেবিকা রানি / শিরিন বসু
মেয়েরাও যে গোয়েন্দা হওয়ার মতো বুদ্ধি এবং সাহস অর্জন করতে পারে, মাত্র ৩৫ বছরের জীবনে তা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কেট ওয়ার্ন। আগেই বলেছি, মেয়ে মাত্রেই তার বুদ্ধি নেই, এমন একটা আশ্চর্য মিথ চালু রয়েছে আমাদের চারদিকে। আর সেই কথাটাকে ভুল প্রমাণ করার জেদেই বোধহয়, মেয়েরা জীবনের কোনও পথ ছেড়ে যাননি। তাঁদেরই একজন কেট ওয়ার্ন। পরবর্তীকালের পৃথিবী যাঁকে স্বীকৃতি দিয়েছে বিশ্বের প্রথম পেশাদার মেয়ে গোয়েন্দা বলে।
...........................
সিরিজ-পোস্টার : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র
#Kate Warne #first female detective #Pinkerton Detective Agency #নারীপক্ষ #silly পয়েন্ট