ফিচার

রুপোলি পর্দায় দীর্ঘ চুম্বন ঠাকুরবাড়ির মেয়ের : নিয়ম ভাঙার আরেক নাম দেবিকা রানি

শিরিন বসু Sep 27, 2022 at 5:23 am ফিচার

সময়টা ১৯৩৩ সাল। ভারতীয় সিনেমার তখনও শৈশব কাটেনি। আজকের দিনে যাকে 'অ্যাডাল্ট সিন' বলা হয়, সেইসব সাহসী দৃশ্য পর্দায় দেখানোর কথা তখন ভাবতেও পারতেন না সিনে দুনিয়ার কলাকুশলীরা। অথচ সেই যুগেই একটি চুম্বনদৃশ্যে অভিনয় করেছিলেন দেবিকা রানি। বাস্তবে তিন মিনিট, না না, ঠিক চার মিনিট ধরে। বাস্তবের না-পারা নিয়ে স্বপ্ন দেখা তাঁর অভ্যেস ছিল না, বরং স্বপ্নগুলো বাস্তবে বদলে নেওয়াই ছিল তাঁর যাপন। সেই কারণেই নবাগত নায়ক আর প্রযোজকের স্ত্রী তথা সিনে দুনিয়ার অবিসংবাদিত নায়িকাকে নিয়ে লেখা এক উপন্যাসে দেখা যায়, জঙ্গলে আউটডোরে গিয়ে কাকচক্ষু সরোবর দেখেই বিদ্যুৎ খেলে যায় নায়িকার চোখে। ‘আমি স্নান করব। আপনি করবেন?... কাপড়চোপড় কিনারায় থাকবে।’— এই সপাট প্রস্তাবের সামনে পড়ে হকচকিয়ে যায় রুপোলি দুনিয়ায় সদ্য পা রাখা তরুণ।

স্বপ্নের মতো দৃশ্য? তবে ঘোর বাস্তব হওয়াই সম্ভব। কারণ একের পর এক সহজ ক্লু ছড়িয়ে এ উপন্যাসে দেবিকা রানিকে চিনিয়ে দিয়েছেন সত্যান্বেষী শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। কাজের সূত্রে হিমাংশু রায় আর দেবিকা রানির সঙ্গে যাঁর ছিল নিত্য ওঠাবসা।


হ্যাঁ, এমনই ছিলেন দেবিকা রানি। নিজের শর্তে নিজের জীবন বাঁচাটাই লক্ষ্য ছিল তাঁর। আর সেই পথে এগোনোর জন্য নিন্দেমন্দকে পাত্তা দেননি কখনোই। একদিকে ঠাকুরবাড়ির মেয়ে। আরেকদিকে ভারতীয় সিনে-পর্দার প্রথম সম্রাজ্ঞী। বম্বে টকিজের ফার্স্ট লেডি। নিয়মভাঙার এক নাম যেন দেবিকা রানি। পুরুষের দুনিয়ায় নিজের ছন্দে চলার সাহস দেখিয়েছিলেন এই ছকভাঙা নারী। লেডিকিলার বলে খ্যাত চলচ্চিত্রকার, বিবাহিত হিমাংশু রায়কে বিয়ে করাই হোক; আবার সহঅভিনেতার সঙ্গে ইলোপ করাই হোক, নিজের খেয়ালখুশিতে চলেছেন তিনি। যখন অভিনয় করাকে অত্যন্ত নিচু চোখে দেখা হত, সেই সময় উচ্চশিক্ষিতা দেবিকা রানি যোগ দিয়েছেন সিনে দুনিয়ায়। হেলায় দখল করেছেন সেরার আসন। প্রথম দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারের প্রাপকও তিনিই। এমনকি শোনা যায় মহাত্মা গান্ধীর দেখা একমাত্র সিনেমা নাকি ‘অচ্ছুৎ কন্যা’। যার নায়িকা সেই একজনই, দেবিকা রানি।

আরও পড়ুন : মুথুলক্ষ্মী রেড্ডি কোনো দেবদাসীর নাম নয় / রোহন রায়

ভারতের প্রথম শল্যচিকিৎসক কর্নেল মন্মথনাথ চৌধুরীর মেয়ে ছিলেন দেবিকা। বাবা ও মা, দুদিক থেকেই আত্মীয়তার যোগসূত্র ছিল খোদ ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে। স্বয়ং প্রমথ চৌধুরী তাঁর কাকা। পড়তে গিয়েছিলেন রবি ঠাকুরের শান্তিনিকেতনে। তাঁকে 'সূর্যমুখীর কুঁড়ি' বলেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, অভিভাবকদের বলেছিলেন তাঁর বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় যত্ন নিতে। সেই কথা মেনেই লন্ডনে পড়তে যান দেবিকা। আর সেখানেই হাতেখড়ি হল প্রথাগত অভিনয়ে। ভারতে তখন ভদ্রঘরের মেয়েরা অভিনয়ে ‘নামা’-র কথা ভাবতেও পারে না। যদিও পেশাদার অভিনেত্রী হওয়ার বদলে টেক্সটাইল ডিজাইনিং-এর কাজকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন দেবিকা। কিন্তু তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে গেল নায়ক-প্রযোজক হিমাংশু রায়ের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর। ফিল্মে নামা আর বিয়ের প্রস্তাব এল পরপর।

আরও পড়ুন : দেশে প্রথম মেয়েদের স্কুল, মেয়েদের ‘মানবাধিকার’-এর দাবিতে লড়েছিলেন সাবিত্রী / তোড়ি সেন

হিমাংশু রায়কে বিয়ে করে ভারতে এলেন দেবিকা রানি। যদিও অসম বয়সের এই বিয়ে সুখের হয়নি বলেই শোনা যায়। এমনকি গার্হস্থ্য হিংসার অভিযোগও করেছেন সেকালের সেরা নায়িকা। কিন্তু কোনও কিছুই তাঁর জীবনকে, তাঁর নিজের চাওয়াপাওয়াকে থামিয়ে দিতে পারেনি। প্রযোজক স্বামীর অধীনে একের পর এক জনপ্রিয় সিনেমা উপহার দিয়েছেন তিনি। তাঁর সূত্রেই শিখেছেন সেট ডিজাইনিংয়ের কাজ। জার্মানির উফা স্টুডিও-র মতো তাবড় ফিল্ম স্টুডিওতে শিখেছেন কস্টিউম, মেকআপ, আর্ট ডিরেকশন, প্রোডাকশনের খুঁটিনাটি। যে জার্মানিতে দুজনের হানিমুন হওয়ার কথা ছিল নাকি, সেখানে দুই শিক্ষার্থী শুষে নিয়েছেন সিনেমাপাড়ার সবটুকু রস। যদিও পাশ্চাত্যের ছাঁচে অনেকখানি গড়া দেবিকাকে তারপরেই দেশে নিয়ে এসেছেন হিমাংশু। বলেছেন, যা শিখেছি তা নিজের দেশকে দেব। সেই কারণেই টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ফক্স দেবিকাকে বেশ কয়েক বছরের চুক্তিতে সই করাতে চাইলেও এককথায় সেই প্রস্তাব নাকচ করে দেন হিমাংশু।

আরও পড়ুন : পুরুষের ছদ্মবেশে প্রথম মহিলা বিশ্বভ্রমণকারী : জাঁ বারে / মন্দিরা চৌধুরী

কিন্তু হিমাংশু রায়ও তাঁর এই সুন্দরী স্ত্রীটিকে বোধহয় সম্পূর্ণ চিনে উঠতে পারেননি। প্রায় ষোলো বছরের বড় স্বামীকে দেবিকা খানিক ভয়ই পেতেন বলে জানিয়েছিলেন, তবে কারও অঙ্গুলিহেলনে চলার পাত্রী তিনি ছিলেন না। বাস্তবে হিমাংশু রায় কেন, কোনও পুরুষের নিয়ন্ত্রণেই ধরা দেননি তিনি। একদিকে ‘কর্ম’ ছবিতে হিমাংশু রায়ের সঙ্গে দীর্ঘ চার মিনিটের চুম্বনদৃশ্যে তিনি অদ্বিতীয়া, আরেকদিকে তাঁরই মাইনে করা নায়ক নজম-উল-হাসানের সঙ্গে কলকাতায় পালিয়ে যেতেও তাঁর দ্বিধা নেই। দেবিকা রানির সারাজীবন জুড়েই জারি ছিল এই জোর। তাই তিরিশের কোঠাতেই বিধবা হওয়ার পর হিমাংশু রায়ের হাতে গড়া ‘বম্বে টকিজ’-এর দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন তিনি। দিলীপ কুমার কিংবা মধুবালাকে দর্শকের কাছে তুলে ধরেছেন দেবিকারানিই। আবার একসময় নিজের ইচ্ছেতেই এই আলোর বৃত্ত ছেড়ে, খ্যাতনামা রুশ চিত্রকর নিকোলাস রোয়েরিখের ছেলে স্‌ভেতস্লাভকে বিয়ে করে চলে গিয়েছেন কুলুর প্রাসাদে। রানির মতোই।

বারবার সমালোচনার ঝড় উঠেছে তাঁকে ঘিরে। আর তার স্বাদ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছেন দেবিকা রানি। পুরুষের হাতে খেলার পুতুল তিনি হতে চাননি, বরং নিজের পুরুষদের নিজেই বেছে নিয়েছেন তিনি। নিজের জীবনের গল্প নিজের হাতেই লিখেছিলেন বম্বে টকিজের ফার্স্ট লেডি। আর সেই কারণেই তাঁকে অপছন্দ করা যেতে পারে হয়তো, কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই।

............................

সিরিজ-পোস্টার : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র 

#Devika Rani #actress #সিলি পয়েন্ট #নারীপক্ষ

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

21

Unique Visitors

219134