নিবন্ধ

জটায়ু: এলেন কোথা থেকে?

শুভদীপ অধিকারী Nov 7, 2020 at 5:05 am নিবন্ধ

[হিরে মানিক জ্বলে : চতুর্দশ কিস্তি]


বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তম রহস্য-রোমাঞ্চ কাহিনির লেখক কে? সবাই একবাক্যে সত্যজিৎ রায়ের কথাই বলবেন। কিন্তু সত্যজিতের এই জনপ্রিয়তার সঙ্গে একমাত্র টেক্কা দিতে পারেন তাঁরই সৃষ্ট চরিত্র লালমোহন গাঙ্গুলী অর্থাৎ জটায়ু। ফেলুদা আর তোপসের সঙ্গে জটায়ুর আলাপ আকস্মিকভাবে, ‘সোনার কেল্লা’র অভিযানের সময়। আগ্রা ফোর্ট থেকে বান্দিকুই যাবার পথে, ট্রেনে। দিনটা ১২ অক্টোবর, ১৯৭০। ফিল্মে অবিশ্যি কানপুর সেন্ট্রাল স্টেশন দেখানো হয়েছিল। মনে প্রশ্ন আসতেই পারে যে হঠাৎ জটায়ু চরিত্রটি সৃষ্টির প্রয়োজন হয়ে পড়ল কেন? ফেলুদা চরিত্রের বিপরীতধর্মী একটি চরিত্র সৃষ্টি করে সত্যজিৎ হয়তো ফেলুদার হিরোইজমকে আরও বেশি করে কিশোর পাঠক-পাঠিকাদের মনে এস্টাব্লিশ করতে চেয়েছিলেন। এর পাশাপাশি পাঠকদের কমিক রিলিফ দেবার একটা ভাবনাও নিশ্চয়ই ছিল। অন্তত প্রথম দিকে জটায়ুর চেহারা ও কার্যকলাপ বেশ হাসির উদ্রেক করে। জটায়ুর বর্ণনা দিতে গিয়েও সত্যজিৎ লিখেছেন যে তাঁকে প্রথমবার দেখে মনে হবে বাংলা ফিল্মে কিংবা থিয়েটারে হয়তো কমিক অভিনয় করেন। তোপসের জবানিতে সত্যজিৎ নিজেই জটায়ুকে নিয়ে তির্যক মন্তব্য করতে ছাড়েননি। তোপসে ভেবেছিল, যিনি প্রখর রুদ্রের মতন ডেয়ার-ডেভিল চরিত্রকে নিয়ে এমন সব গল্প লেখেন তাঁর চেহারা নিশ্চয়ই হবে একেবারে জেমস বন্ডের বাবা। কিন্তু বাস্তবে প্রথমবার জটায়ুকে দেখে তোপসে রীতিমতন হতাশ হয়, পেট থেকে ভসভসিয়য়ে সোডার মতন হাসি গলা অবধি উঠে আসে। যদিও আস্তে আস্তে জটায়ু চরিত্রের পুনর্নির্মাণ করেছিলেন সত্যজিৎ। তিনি ক্রমে সিরিয়াস হয়েছেন, ফেলুদা কাহিনির অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে‌ উঠেছেন। ফেলুদার মতন জটায়ুর মধ্যেও সত্যজিৎ নিজের বিভিন্ন শারীরিক এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের আরোপ করেছেন। নির্মাল্য কুমার ঘোষের লেখায় সেই সব তথ্য বিস্তারিতভাবে উঠে এসেছে। এই প্রবন্ধে সেইসব আলোচনা থাক। আমরা বরং খুঁজে দেখি অন্য কোনও চরিত্রের মধ্যে জটায়ুর ছায়া খুঁজে পাওয়া যায় কিনা।

‘সোনার কেল্লা’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭১-এর দেশ শারদীয়ায়। ঠিক এক বছর আগের শারদীয়া ‘দেশ’-এ প্রকাশিত হয় ‘গ্যাংটকে গণ্ডগোল’। সেই উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র নিশিকান্ত সরকারকে অনেকেই জটায়ুর পূর্বসূরি হিসাবে ধরে নেন। নিশিকান্তবাবুর ব্যাপারেও এই সংখ্যায় আমরা আলোচনা করছি না। তার চেয়ে বরং আরো বছর দশেক পিছিয়ে যাই। সালটা ১৯৬১। সত্যজিৎ তাঁর বন্ধু সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে ‘সন্দেশ’ পত্রিকা নতুনভাবে প্রকাশ করলেন। সেই বছরেরই আশ্বিন-কার্তিক-অগ্রহায়ণ সংখ্যায় সত্যজিৎ গিরিডি-নিবাসী বৈজ্ঞানিক প্রোফেসর শঙ্কুকে প্রধান চরিত্র করে লিখলেন ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’। সেখানেই আমরা পরিচিত হই অবিনাশচন্দ্র মজুমদারের সঙ্গে, যিনি ছিলেন শঙ্কুর প্রতিবেশী। অবিনাশবাবু ছিলেন শঙ্কুর একদম বিপরীত মেরুর বাসিন্দা। তিনি বিজ্ঞানের ধারে কাছ দিয়ে যেতেন না। তাঁর মতন অবৈজ্ঞানিক মনোভাবাপন্ন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ভদ্রলোক প্রোফেসর শঙ্কুকে অযথা আজেবাজে প্রশ্ন করতেন, টিটকিরি দিতেন, ঠাট্টা করতেন, আর নানা বৈজ্ঞানিক গবেষণা ছেলেমানুষি কাজকর্ম করে পণ্ড করার চেষ্টা করতেন। এতেই ছিল অবিনাশবাবুর আনন্দ। মোটের উপর অবিনাশবাবুর চরিত্রটিও বেশ মজাদার। বেশ একটা কমিক রিলিফ পাওয়া যায়। যদিও তিনি প্রোফেসর শঙ্কুর সঙ্গে বেশ কয়েকবার দেশে-বিদেশে অভিযানে গেছেন। কখনও গোপালপুর, কখনও আফ্রিকা আবার কখনও তিব্বত। আবার কখনও মঙ্গলগ্রহে। সেইসব অভিযানে তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতেও দেখা যায়। এমনকি বেশ কয়েকবার প্রোফেসর শঙ্কুর প্রাণও বাঁচান তিনি। একইরকমভাবে জটায়ুকেও রহস্যের জট ছাড়ানোর সময় সাধারণত দর্শকের ভূমিকায় দেখা গেলেও কোনও কোনও সময় তিনি স্বয়ং রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হয়েছেন। কিছুক্ষেত্রে ফেলুদাকে প্রাণেও বাঁচিয়েছেন, অথবা এমন কিছু করেছেন যা সেই কেসের টার্নিং পয়েন্ট হয়ে দাঁড়ায়। দুজনকেই আপাতদৃষ্টিতে স্বভাবে ভীতু, নিতান্ত ছাপোষা মনে হলেও বিপদের মধ্যে পড়ে তাঁরা বুদ্ধিভ্রষ্ট হননি। বরং সাহস সঞ্চয় করে প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব দেখিয়েছেন।  



জটায়ুর মতন অবিনাশবাবুও ছিলেন অকৃতদার। সেই কারণে কোনও পিছুটানই ছিল না তাঁর। তাই প্রোফেসর শঙ্কুর সাথে বেরিয়ে পড়তেও দুবার ভাবতে হত না। প্রোফেসর শঙ্কু যখন অবিনাশবাবুকে প্রথম গোপালপুর যাবার কথা বলেন তখন উনি বলেছিলেন— “ঝুলে পড়ব নাকি আপনার সঙ্গে? ষাটের উপর বয়স হল— সমুদ্র দেখলুম না, মরুভূমি দেখলুম না, খাণ্ডলি পাহাড় ছাড়া পাহাড় দেখলুম না— শেষটায় মরবার সময় আপশোস করতে হবে নাকি?” ফিল্মের জটায়ু তো প্রথম আলাপেই সরাসরি ফেলুদাকে বলেছিলেন— “ঝুলে পড়ব নাকি আপনার সঙ্গে?” জটায়ুও দিল্লি-আগ্রা ট্যুরে বেরোবার আগে কোনোদিন একা বাড়ির বাইরে পা ফেলেননি। বাড়ির তিন মাইলের মধ্যে জৈন মন্দির, জন্ম থেকে নাম শুনে আসছেন, অথচ একবারও চোখে দেখেননি। ফেলুদাদের সঙ্গে রাজস্থান ঘুরেই তাঁর জ্ঞানচক্ষু খুলে যায়। তারপর থেকে একত্রে থ্রি মাস্কেটিয়ার্স হিসাবেই থেকে গেছেন, থুড়ি, ঘুরে গেছেন আজীবন। জটায়ুর ভাবনা ছিল “যত দেখব, তত প্লট আসবে মাথায়, তত বইয়ের সংখ্যা বাড়বে…।” প্রোফেসর শঙ্কু যখন তাঁর বন্ধু প্রাণিতত্ত্ববিদ জেমস ম্যাসিংহ্যামের খোঁজে আফ্রিকা যাবার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন অবিনাশবাবু বলেন— “যদ্দিন কূপমণ্ডূক হয়ে ছিলুম, বেশ ছিল। কিন্তু একবার ভ্রমণ এবং তার সঙ্গে সঙ্গে অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ পেয়েছি, আর কি মশাই চুপচাপ বসে থাকা যায়?... আর খরচের কথাই যদি বলেন তো সমুদ্রের তলা থেকে পাওয়া কিছু মোহর এখনও আছে আমার কাছে। আমার খরচ আমি নিজেই বেয়ার করব।” পাঠকেরা নিশ্চয়ই অবিনাশবাবুর সাথে জটায়ুর ভাবনার ও বক্তব্যের মিল খুঁজে পাচ্ছেন? 


এমন আরও কিছু সংলাপ উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরা যায়। গোপালপুরে জাপানি বিজ্ঞানী হামাকুরা ও তানাকার কাজকর্ম সন্দেহজনক মনে হওয়ায় অবিনাশবাবু যখন প্রোফেসর শঙ্কুর কানে ফিসফিস করে বলেন— “আপনার সঙ্গে আত্মরক্ষার জন্যে অস্ত্রশস্ত্র আছে আশা করি। আমার কিন্তু এদের ভাবগতিক ভাল লাগছে না মশাই। হয় এরা গুপ্তচর, নয় স্মাগলার— এ আমি বলে দিলাম।” ফেলুদার কোল্ট .৩২ রিভলবারের জায়গায় আন্যাইহিলিন পিস্তলের কথা ভেবে নিন। বেশ ভরসা পাবেন। আবার অবিনাশবাবুর কথা— “ষাট বছর বয়সে জঙ্গলে ঘুরে যা এডুকেশন হচ্ছে, ইস্কুলে কলেজে মানেবই মুখস্থ করে তার সিকি অংশও হয়নি” আর জটায়ুর কথা— “ট্রাভেল ব্রডন্স দি মাইন্ড”-এর খুব বেশি পার্থক্য আছে কি?  



অবিনাশবাবুর পুথিগত বা সাধারণ জ্ঞানের পরিধি ছিল খুবই কম। জটায়ুও ভূগোল আর ইতিহাসে রীতিমতন কাঁচা ছিলেন। অনেক ক্ষেত্রেই তার পরিচয় মেলে। অবিনাশবাবুর ইংরাজি বলার দৌড় ‘ইয়েস’, ‘নো’, ‘ভেরি গুড’ অবধি। এই প্রসঙ্গে অবিনাশবাবুর একটি চিরস্মরণীয় উক্তি আছে। যেটা উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারছি না— “আমাকে মশাই আপনার ওই সাহেব বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে বলবেন না। আপনি চৌষট্টিটা ভাষা জানতে পারেন, আমার বাংলা বই আর সম্বল নেই। সকাল সন্ধেয় গুড মর্নিং গুড ইভিনিংটা বলতে পারি, এমনকী ওনাদের কেউ খাদেটাদে পড়ে গেলে গুড বাইটাও মুখ থেকে বেরিয়ে যেতে পারে— তার বেশি আর কিছু পাবেন না।” জটায়ুর ভাষাজ্ঞানের ব্যাপারে লিখতে গেলে একটা গোটা কিস্তি লেগে যাবে। আপনারা সুযোগ পেলে এই অধমের ‘জয়তু জটায়ু!’ বইটা একবার দেখতে পারেন। এছাড়াও অবিনাশবাবু ছিলেন আদ্যোপান্ত ভোজনবিলাসী বাঙালি। মনের দিক থেকে নিপাট ভালোমানুষ। তাছাড়া ঈশ্বর, জ্যোতিষ ও কুসংস্কার সবেতেই তাঁর বিশ্বাস ছিল ষোলোআনা। এই সব বৈশিষ্ট্যের দিক থেকেও জটায়ু ছিলেন অবিনাশবাবুর যোগ্য পূর্বসূরি। দুই চরিত্রের মধ্যে এইসব মিল স্রষ্টার অবচেতন মনের ফল, নাকি ইচ্ছাকৃত তা অবিশ্যি বলা যায় না। তবে একথা অনস্বীকার্য যে অবিনাশবাবুর চরিত্রের বিভিন্ন দিক আরও খোলতাই হয়েছে জটায়ুর মধ্যে। আগেই বলেছি দুটি চরিত্র সৃষ্টি হয়েছে প্রায় এক দশক ব্যবধানে। একই উদ্দেশ্য নিয়ে দুটি চরিত্রের সৃষ্টি হলেও অবিনাশবাবু নেহাতই কিছু শঙ্কু কাহিনির পার্শ্বচরিত্র হিসাবেই থেকে গেছেন। ক্রমে জটায়ুর মতন অপরিহার্য হয়ে ওঠেননি। অবিনাশবাবু আর প্রোফেসর শঙ্কু দীর্ঘ প্রায় পঁচিশ বছরের প্রতিবেশী হয়েও জুটি হয়ে উঠতে পারেননি। কিন্তু ফেলুদা-তোপসে আর জটায়ু থ্রি মাস্কেটিয়ার্স। জটায়ুকে ছাড়া ফেলুদার অস্তিত্ব কল্পনা করাই কঠিন।   



[কভার ছবিতে সত্যজিৎ রায়ের বিভিন্ন সময়ে আঁকা ছবি ও অলংকরণ ব্যবহৃত হয়েছে। কভার ডিজাইন : অর্পণ দাস]



#সত্যজিৎ রায় #সিরিজ #হিরে মানিক জ্বলে #Series #জটায়ু #লালমোহনবাবু #অবিনাশবাবু #নিশিকান্তবাবু #ফেলুদা #প্রোফেসর শঙ্কু #Satyajit Ray #Special Series #Jatayu #Lalmohan Ganguly #Feluda #শুভদীপ অধিকারী #সিলি পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

17

Unique Visitors

219121