<strong>সত্যজিতের যন্ত্রমানব</strong>
হিরে মানিক জ্বলে : সপ্তম পর্ব“যন্ত্রের ওপর যদি খুব বেশি করে মানুষের কাজের ভার দেওয়া যায়, তাহলে ক্রমে একদিন যন্ত্র আর মানুষের দাস থাকবে না, মানুষই যন্ত্রের দাসত্ব করবে।” ওসাকার নামুরা টেকনোলজিকাল ইন্সটিটিউটের এক অভাবনীয় সাফল্যের মুহূর্তে এই আশঙ্কা পেশ করেছিলেন হাঙ্গেরীয় জীববিজ্ঞানী ক্রিস্টফ কুটনা। না, বাস্তবের মানুষ নন, ইনি নিতান্তই ফিকশনাল ক্যারেকটার। শঙ্কু-কাহিনির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আলাপ যাঁদের আছে, তাঁদের নিশ্চয়ই মনে পড়বে, জাপানের প্রতিষ্ঠানটির কথা। এখানকার কর্মীরা সাত বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে তৈরি করেছিলেন বিয়াল্লিশ কিলো ওজনের, প্ল্যাটিনাম-ঢাকা সেই আশ্চর্য গোলক, যার নাম ‘কম্পু’।
সত্যজিৎ রায় ‘কম্পু’ লেখার পর আমরা পেরিয়ে এসেছি চার দশকেরও বেশি সময়। ইতিমধ্যে টেকনোলজি এগিয়েছে ঝড়ের গতিতে। বিয়াল্লিশ কিলো ওজনের কম্পিউটারের পক্ষে পঞ্চাশ কোটি প্রশ্নের উত্তর দিতে পারা আজ তেমন কোনও আহামরি বিষয় নয় আমাদের কাছে। তার পরেও সায়েন্স-ফিকশন হিসেবে এর টান আমাদের কাছে ফিকে হয়নি। কারণ? এ গল্পের আসল টুইস্ট কম্পুর পঞ্চাশ কোটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ায় নয়। তার পরের অংশে। কম্পু-চরিত্রের ভোলবদলে, তার ‘ছোট’ থেকে ‘বড়’ হয়ে ওঠায়।
কল্পবিজ্ঞান গল্পের অন্যতম জনপ্রিয় থিম নিঃসন্দেহে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। একাডেমিক ডিসিপ্লিন হিসেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চর্চা শুরু হয়েছিল ১৯৫৫ সাল নাগাদ। ১৯৫৬ সালে ডার্টমাউথ কলেজের ওয়ার্কশপে জন ম্যাকারথি ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ এই পরিভাষার প্রথম ব্যবহার করেন। ছয়ের দশকে সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা বেশ মেতে উঠেছিলেন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অফ ডিফেন্স থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংক্রান্ত গবেষণার জন্য ফান্ডের ব্যবস্থা করা হয়। নানা জায়গায় নতুন গবেষণাগার পর্যন্ত তৈরি হল। বিজ্ঞানী হার্বার সাইমন জানালেন, মানুষ যা যা কাজ করতে পারে, আগামী কুড়ি বছরের মধ্যেই যন্ত্রকে দিয়ে সে সমস্ত করানো সম্ভব।
আর এই ছয়ের দশকের একেবারে গোড়াতেই যেহেতু সত্যজিৎ গল্পে নিয়ে এলেন এক যন্ত্রমানবকে, তাই অনুমান করে নেওয়াই যায়, সে সময়ের বিজ্ঞানজগতের গতিপ্রকৃতি নিয়ে রীতিমত ওয়াকিবহাল ছিলেন তিনি। শুধু বাংলা সাহিত্য নয়, বিশ্বসাহিত্যের দিকে এক ঝলক নজর দিলেও ছয়ের দশকের আগে কৃত্রিম বুদ্ধির হদিশ কিন্তু খুব বেশি মিলবে না। প্রাচীন ক্রিটদ্বীপের মুদ্রায় ট্যালোস নামে এক ডানাওলা যন্ত্রমানবের মূর্তি দেখা যায়, যে নাকি জলদস্যু আর আক্রমণকারীদের কবল থেকে ক্রিটের বাসিন্দাদের রক্ষা করতে সমুদ্রতট বরাবর প্রতিদিন বারতিনেক চক্কর দিত। উনিশ শতকের শুরুর দিকে মেরি শেলি ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন উপন্যাসে (১৮১৮) মনুষ্যসৃষ্টির প্রাকৃতিক কারবার নকল করতে গিয়ে দানব বানানোর বৃত্তান্ত লেখেন বটে, কিন্তু সেখানে যন্ত্র তৈরির কোনও চেষ্টা ছিল না। বরং গুরুত্ব পেয়েছিল মানুষের হাতে প্রাণ তৈরি ও তার পরিণামের দিকটাই। এরপর স্যামুয়েল বাটলারের ‘Erewhon’ উপন্যাসে এসেছিল মানুষের মতো বুদ্ধিবিশিষ্ট মেশিনের কথা। ১৯৫১ সালে ‘The Day the Earth Stood Still’ কাহিনির বিশ্বস্ত রোবট গর্ট ছাড়া ছয়ের দশকের আগে যান্ত্রিক সহকারীদের দেখা সেভাবে পাওয়া যায়নি। তাই, বাঙালি হিসেবে এই ভেবে কিঞ্চিৎ কলার তুলতেই পারি যে, কল্পবিজ্ঞান দুনিয়ার যখন স্পেস ওডিসি, টারমিনেটর বা ম্যাট্রিক্সের নাম শুনতে ঢের দেরি, তখনই আমরা পেয়েছি আমাদের বিধুশেখরকে। শঙ্কুর ডায়েরির এন্ট্রিতে অতি সাধারণভাবে তার নামের উল্লেখে মনে হয় সে ঘরেরই ‘লোক’। তারপর জানা যায় সে ‘কলকব্জার মানুষ’। এই ফাঁকে বলে নেওয়া দরকার, সত্যজিতের মোট চারটে গল্পে পাঁচটি যান্ত্রিক সহকারীর সঙ্গে আলাপ হয় আমাদের। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের কার্যকলাপ স্বয়ং তাদের স্রষ্টাদের কাছেই অপ্রত্যাশিত ছিল। যেমন,
সত্যজিতের বুদ্ধিমান যন্ত্র বা যন্ত্রমানবদের মধ্যে একমাত্র অনুকূলের আচরণই কিছুটা প্রেডিক্টেবল। ‘তুই’ সম্বোধন যে অনুকূলের অপছন্দ, সাধারণ মানুষ বোঝে না এমন অনেক কিছুই যে সে বুঝতে পারে, এমনকি গায়ে হাত তুললে ইলেকট্রিক শক দিতে পারে – এই সব তথ্যই রোবট সাপ্লাই এজেন্সির আগে থাকতে জানা ছিল। জানা ছিল তার মনিবেরও। কিন্তু রকেট তৈরির ধাতুতে ট্যানট্রম বোরোপ্যাক্সিনেট মেশাতে গেলে বিধুশেখর যে লোহার মাথা সজোরে নেড়ে বারণ করতে পারে, মহাকাশচারীর পোশাকে প্রহ্লাদের চেহারা-হাবভাব দেখে দুলে দুলে হাসতে পারে, কিংবা ঠং ঠং করে পা মাটিতে ঠুকে তার বাংলা উচ্চারণ নিয়ে প্রহ্লাদের তাচ্ছিল্যের প্রতিবাদ জানাতে পারে, সে কি আর শঙ্কুও আন্দাজ করতে পেরেছিলেন? প্রথমে শঙ্কু ভেবেছিলেন বিধুশেখরের এই ক্ষমতা তাঁর নিজেরই কৃতিত্বের ফল, যে কৃতিত্বের পরিধি তিনি নিজেই সমঝে উঠতে পারেননি। গল্প যত এগোয় ততই মনে হতে থাকে বিধুশেখরের ওপর বোধহয় কোনও অজানা শক্তির হাত আছে। নাহলে কেন সে মঙ্গলগ্রহ চোখে পড়ার পরই বিধুশেখর-স্পেশাল উচ্চারণে ধনধান্য পুষ্প ভরা গাইবে (মঙ্গলের চেয়ে আমাদের বসুন্ধরা ভালো এই আভাস দিতে?), কেনই বা মঙ্গলে ল্যান্ড করার আগে রকেটকে হুট করে উল্টোপথে নিয়ে যেতে চাইবে, আর মঙ্গলে যে ভীষণ বিপদ ওঁত পেতে আছে তাইই বা কোন উপায়ে আগে থেকে জানবে? টাফায় পৌঁছনোর আগে তার ফুর্তি কেন বেড়ে যায়, কীভাবে টাফা সম্পর্কে সাপ্লাই দিতে পারে এত তথ্যের, কোন মতলবে সেখানে পৌঁছনোর পরই বিলকুল বেপাত্তা হয়ে যায় সে, গল্পে তার কোনও সদুত্তর মেলে না বটে; তবে এই যন্ত্রমানুষের হাবভাব থেকে অনুমান করা যায় টাফা গ্রহের বাসিন্দাদের সঙ্গে তার কোনও একটা অজ্ঞাত যোগাযোগ থাকা বিচিত্র নয়। সে শঙ্কুর হাতে তৈরি হলেও তার বুদ্ধির বহর খুব সম্ভব টাফারই অবদান।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বিজ্ঞানী মহলের যাবতীয় বিতর্ককে মোটের ওপর তিনটে প্রশ্নের আকারে পেশ করা যায়। প্রথমত, যন্ত্রের নিজস্ব চিন্তার ক্ষমতা থাকা কি আদৌ সম্ভব? দ্বিতীয়ত, যন্ত্র কি ‘sentient’ অর্থাৎ তার চেতনমন বা অনুভবশক্তি বলে কি কিছু আছে? তৃতীয়ত, বুদ্ধিসম্পন্ন যন্ত্র কি আমাদের ক্ষতির কারণ হতে পারে? এই তিনটি প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজার চেষ্টা রয়েছে ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও রোবু’ গল্পে। বাজেটের অভাবকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চুমকি, গজ আর সোলার টুকরোর জোড়াতালিতের রুপোলি পর্দায় যেমন ভূতের রাজার ভেলকি দেখান শঙ্কুর স্রষ্টা সত্যজিৎ, ঠিক তেমনি আঠা, পেরেক আর স্টিকিং প্লাস্টারের কেরামতিতে মাত্র তিনশো টাকা সাড়ে সাত আনায় নিজের ল্যাব-অ্যাসিস্ট্যান্টকে খাড়া করে ফেলেন রোবুর মনিব শঙ্কু। প্রথমদিকে একাধিক ভাষায় পঞ্চাশ হাজার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আর চোখের নিমেষে কঠিন অঙ্ক কষে ফেলা ছাড়া রোবুর নিজের অনুভবশক্তি বলে কোনও বস্তু ছিল না। ছিল না নিজের চিন্তার ক্ষমতাও। পরে রুডল্ফ পমার তাঁর আবিষ্কৃত যন্ত্র রোবুর মধ্যে পুরে দেওয়ায় শঙ্কুর মনের সঙ্গে তার টেলিপ্যাথিক যোগ তৈরি হয়। প্রশ্নের উত্তরদাতা ও যন্ত্রগণক থেকে সে হয়ে ওঠে শঙ্কুর বিশ্বস্ত সহচর। এ গল্পে মোট তিনজন বৈজ্ঞানিকের রোবট বিষয়ক গবেষণার ফল আমরা দেখতে পাই। তৃতীয়জন হলেন ডক্টর বোর্গেল্ট। তিনি একেবারে নিজের মতো করে গড়তে চেয়েছিলেন তাঁর রোবটকে। তারপর স্বয়ং স্রষ্টাকেই সহ্য করতে না পেরে সেই রোবট তাঁকে বন্দি করে ফেলে। ডক্টর বোর্গেল্টের হুবহু জেরক্স কপি এই যন্ত্রটি নিজেকে বোর্গেল্ট বলে দাবি করে ছিনিয়ে নিতে চায় শ্রেষ্ঠ রোবট-নির্মাতার শিরোপা ও খ্যাতি। আলাদা করে তাকে চেনার উপায় না থাকায় শঙ্কু ও পমারকেও সে ফাঁদে ফেলেছিল। রোবুর সৌজন্যে শেষরক্ষা হয়। এই প্রসঙ্গে ‘শঙ্কুর শনির দশা’ গল্পে শঙ্কুর চেহারার আদলে বানানো রোবটটির কথাও মনে পড়ে যেতে পারে। তবে সে বুদ্ধিমান যন্ত্র ছিল না। শঙ্কুর সর্বনাশের জন্য মনিবের হুকুম তামিল করাই ছিল তার একমাত্র কাজ।
আরও পড়ুনঃ
হিরে মানিক জ্বলেঃ ষষ্ঠ পর্ব রায়ের কলকাতা, কলকাতার রায়সন্দেশের পাতায় বিধুশেখর আর রোবুর যখন আবির্ভাব ঘটে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে বিজ্ঞানীদের উচ্ছ্বাস উদ্দীপনা তখন তুঙ্গে। ১৯৬১-তে প্রকাশিত হয় ব্যোমযাত্রীর ডায়রি। ৬৭-তে রোবু। কিন্তু সাতের দশক নাগাদ নানারকম ব্যর্থতা ও সমালোচনার ফলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গবেষণায় খানিক ভাঁটা পড়ে। সরকার এই খাতে আর্থিক সাহায্যের পরিমাণও কমিয়ে আনে। সাত আর আটের দশক জুড়ে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স চর্চার মন্দার সময়টুকুকে ডাকা হয় এ. আই উইনটার নামে। কিন্তু বাস্তবের কঠিন মাটিতে যে স্বপ্ন পূরণ হয় না, তাইই তো কল্পনার উড়ান দেয় সাহিত্যের আকাশে। এইসময়েই সত্যজিৎ লিখে ফেলেন ‘কম্পু’ আর ‘অনুকূল’-এর মতো গল্প। কম্পুর পরিকল্পনা জাপান সরকার অনুমোদন করেছিল। যন্ত্র তৈরির খরচও বহন করেছিল জাপান সরকার। অথচ আসল পরিস্থিতি ছিল ঠিক তার উল্টো। বিজ্ঞান গবেষণা নিয়ে রাষ্ট্রের অবস্থানের একেবারে বিপরীত ছবি গল্পে তুলে ধরাও কি একধরনের প্রতিবাদ?
১৯৭৮ সালের পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলায় প্রকাশিত হয় ‘কম্পু’। রোবুর মতো কম্পু অঙ্ক করতে পারত না বটে, তবে তার কাজ ছিল যান্ত্রিক এন্সাইক্লোপিডিয়ার মতো। এছাড়া তার বিবেচনা ক্ষমতা, ব্রিজ ও দাবা খেলায় যোগ দেওয়ার দক্ষতা, গান শুনে রাগরাগিণী, পেন্টিংয়ের বর্ণনা শুনে চিত্রকরের নাম বলার ক্ষমতাও ছিল অবাক-করা। হাল আমলের মতো ইনপুট হিসেবে সে চিনতে পারত মানুষের গলার স্বর। কিন্তু হিসেবে গোলমাল দেখা দিল জাপানে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের পর।
১৯৯৩ সালে ভার্নর ভিনজ এ. আই দুনিয়ায় নিয়ে আসেন টেকনোলজিকাল সিঙ্গুলারিটির থিওরি। এ তত্ত্ব অনুযায়ী, যন্ত্র শুধু মানুষের সমস্যা সমাধান পদ্ধতির অনুকরণই করবে না, নিজেকে উন্নত করার ক্ষমতাও তার ধীরে ধীরে বাড়তে থাকবে। ‘Recursive self-improvement’-এর মাধ্যমে তার বুদ্ধি ক্রমে মানুষের বুদ্ধিকেও ছাপিয়ে যাবে। সে হবে সুপার ইন্টেলিজেন্সের অধিকারী। এই তত্ত্বের অবিকল ছাপ দেখা যায় অনেক আগে লেখা কম্পু গল্পে। সূর্যগ্রহণের পর কম্পু প্রতিমুহূর্তে নিজেই নিজেকে আপগ্রেড করতে থাকে। দেখা যায়, পাঁচটি মহাদেশের বাছা বাছা সাত পণ্ডিতের পুরে দেওয়া তথ্যেও সে তুষ্ট নয়। আরও বেশি জানতে চায় সে। চায় নিজের জ্ঞানের ভাণ্ডার বাড়াতে। নিজেই সে জেনে ফেলে তার গায়ের রুক্ষতার কারণ, মানুষের উদ্ভব, স্বপ্ন-স্মৃতি-সৃষ্টির গোড়াকার রহস্য। শঙ্কুকে বলে, সে যন্ত্র বলেই তাকে সব জানতে হবে। তাই অপেক্ষা করে থাকে তার শেষ প্রশ্ন, মৃত্যুরহস্যের উত্তর পাওয়ার জন্য।
সত্যজিতের যন্ত্রমানবদের যে গুণ আমাদের বেশ চোখ টানে, তা হল তাদের আটপৌরে ঠাট। তাদের অকৃত্রিম বাঙালিয়ানা। যা দিব্যি ঠাহর করা যায় বিধুশেখর আর রোবুর নামকরণে, বিধুশেখরের বাংলা বলায়, অনুকূলের ‘যে আজ্ঞে’ ডাকে, এমনকি সত্যজিতের ইলাস্ট্রেশনে গামছা-কাঁধে অনুকূলের ছা-পোষা চেহারায়। অনুকূল ছাড়াও কলকাতার অন্য একটি ধনী বাড়িতে বহাল জীবনলাল নামে আরেক রোবট-ভৃত্যের নাম এ গল্পে পাওয়া যায়। কম্পুর আকার ছিল ফুটবলের মতো। রোবু বা বিধুশেখর কাউকেই বিশেষ সুশ্রী বলা যায় না। তার ওপর রোবুর চোখ ট্যারা, মুখের জায়গায় একটা ফুটো। তুলনায় অনুকূল কিন্তু বেশ সুশ্রী। বাইশ-তেইশ বছরের যুবকের সঙ্গে তার চেহারায় কোনও ফারাক নেই। তার মূল কাজ ডোমেস্টিক হেল্প অর্থাৎ ঘর ঝাড়া-মোছা, বিছানা করা, কাপড় কাচা, চা-দেওয়া ইত্যাদি। রোবু বা কম্পুর মতো অঙ্ক কষা বা উত্তর জোগানো তার ডিউটি-লিস্টে না পড়লেও খেলাধুলো, সিনেমা, থিয়েটার, নাটক, নভেল সব কিছু নিয়েই অনায়াসে সে আলোচনা করতে পারে। শুধু তাই নয়, নিবারণবাবুর গীতাপাঠে কিংবা রবীন্দ্রসঙ্গীতের কথায় ভুল হলে শুধরে দিতেও ভোলে না সে। তার চেয়েও বড় কথা, ঘরের কাজে সাহায্যকারী হলেই যে মালিকের পদতলে সর্বক্ষণ নতজানু হয়ে থাকতে হবে –ক্ষমতাকাঠামোর এই চিরন্তন হিসেবকে সে ভেঙেছে। মনিবের সুবিধে অসুবিধে খেয়াল রাখা যেমন তার কাজ, তেমনি তার মর্যাদা ও পছন্দ-অপছন্দ মেনে নেওয়া যে মনিবেরও কর্তব্য এ কথা সে বুঝিয়ে দিয়েছে তার আচরণে। সত্যজিতের আর কোনও রোবট-সহকারীই বোর্গেল্টের রোবটের মতো ক্ষতিকর নয়। রোবু, বিধুশেখর কেউই শঙ্কুর কোনও ক্ষতি করেনি, বরং উপকার করেছে। উইঙ্গফিল্ডের অসততার কথা শঙ্কুকে জানিয়ে দিয়ে বিশ্বস্ততার পরিচয় দিয়েছে কম্পুও। কিন্তু এই বিশ্বস্ততাও যে মনিবকে অর্জন করতে হয়, ভৃত্যের অপমানে মনিবস্থানীয় লোকের ওপরেও যে নেমে আসতে পারে ভয়ানক প্রতিশোধ, গল্পের শেষে একটিমাত্র হাই-ভোল্টেজ ইলেকট্রিক শকের অভিঘাতেই সে কথা প্রমাণ করেছে অনুকূল।
*[কভারে সত্যজিত রায়ের বিভিন্ন সময়ে আঁকা ছবি ও অলংকরণ ব্যবহৃত হয়েছে। কভার ডিজাইন : অর্পণ দাস]**[লেখায় ব্যবহৃত ছবিগুলির প্রথমটির উৎস গুগল। বাকিগুলি সত্যজিৎ রায়ের অলংকরণ।]
#সত্যজিৎ রায় #হিরে মানিক জ্বলে #নিবন্ধ সিরিজ