ফিচার

বিস্মৃত অক্ষর: নাটককার ও ছোটোগল্পকার রবীন্দ্রনাথ মৈত্র

প্রতিষ্ঠা আচার্য Nov 21, 2021 at 4:49 am ফিচার

দিনের আলোর গভীরে যেমন লুকিয়ে থাকে রাতের সব তারা, তেমনি বাংলা সাহিত্যে ‘রবীন্দ্রনাথ’ নামের তীব্র ঔজ্জ্বল্যের কাছে ম্লান হয়ে গিয়েছে রবীন্দ্রনাথ মৈত্রের নাম। স্বল্পায়ু, সমকালে অত্যন্ত জনপ্রিয় এই সাহিত্যিক, যাঁর নাটকের চলচ্চিত্রায়ণে অভিনয় করেছেন কানন দেবী এমনকি স্বয়ং উত্তমকুমার - আমরা আজ তাঁকে ভুলতে বসেছি।

রবীন্দ্রনাথ মৈত্রের জন্ম, বেড়ে ওঠা অধুনা বাংলাদেশের রংপুরে। অথচ বাংলাদেশ সাহিত্য একাডেমির লেখক তালিকাতেও তাঁর নাম নেই। পেশায় সাংবাদিক রবীন্দ্রনাথ আনন্দবাজারে চাকরির পাশাপাশি ‘শনিবারের চিঠি’র সম্পাদনার কাজ করেছেন। সমাজসেবামূলক কাজে তাঁর প্যাশন ছিল ভয়ংকর। রংপুরের সাঁওতাল মজুরদের উন্নতিকল্পে নিয়েছেন একাধিক কর্মসূচী। রংপুরের বিস্তীর্ণ এলাকাকে ম্যালেরিয়ার প্রকোপমুক্ত করতে প্রচার ও সচেতনতামূলক নানা প্রকল্প বাস্তবায়িত করেন। মানুষের কাছাকাছি থেকেছেন, আর সেইসব প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে তাঁর গল্পে। বিষয়বস্তু যেমন প্রাণবন্ত বাস্তবঘেঁষা, লেখনশৈলীও একেবারেই অনাড়ম্বর। অলঙ্কারবাহুল্যহীন সহজ সরল ভাষা তাঁর গদ্যকে সমসময়ে দিয়েছে স্বাতন্ত্র‍্য। তাঁর সাহিত্যকর্মের ভাণ্ডারে রয়েছে দেড়খানি নাটক, একটি উপন্যাস, সাতটি গল্পগ্রন্থ, একটিমাত্র কাব্যগ্রন্থ এবং একটি শিশু কিশোর রচনা সংগ্রহ।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর একমাত্র পূর্ণাঙ্গ নাটক ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’ রচনা করে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছে যান। রোমান্টিক কমেডি এই নাটকটি সজনীকান্ত দাস সম্পাদিত ‘শনিবারের চিঠি’ পত্রিকার ১৩৩৯ বঙ্গাব্দ (১৯৩২সাল) আশ্বিন কার্তিক সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। শোনা যায় সম্পাদক সজনীকান্ত নাকি রবীন্দ্রনাথকে তালা বন্ধ করে ঘরে আটকে একদিনের মধ্যে নাটকটি লিখিয়ে নেন। প্রকাশের পর তুমুল জনপ্রিয়তায় সে বছরই ডিসেম্বর মাসে স্টার থিয়েটারে নাটকটি অভিনীত হয়। এরপর ১৯৩৫ সালে কানন দেবী ও জহর গাঙ্গুলী অভিনীত সিনেমা হয়। এই সিনেমায় অভিনয় করেই কানন দেবী প্রতিষ্ঠিত হন। ১৯৫৮ সালে আবারও উত্তমকুমার অরুন্ধতী রায়ের অভিনয়ে মানময়ী গার্লস স্কুলের চলচ্চিত্রায়ণ হয়। হিন্দিতে অনূদিত হয়েও মিস মেরী নামে সিনেমা হয় এই নাটক। অনূদিত হয়েছে তামিল, তেলেগু এমনকি ইংরেজি ভাষাতেও। নীহারিকা ও মানস নামের দুই বেকার গ্র‍্যাজুয়েট নাটকের মূল পাত্রপাত্রী। মানময়ী গার্লস স্কুলের জন্য দম্পতি গ্র‍্যাজুয়েট শিক্ষক চাই এই বিজ্ঞাপন দেখে তারা একরকম পেটের দায়ে স্বামী স্ত্রী সেজে চাকরির জন্য যায়। নকল দম্পতি হওয়ার নানা সমস্যা নাটকের নানা স্থানে নির্মল হাস্যরসের যোগান দিয়েছে। শেষে দুজনের মধ্যে যথার্থ প্রণয়ের সঞ্চারে মধুরেণ সমাপয়েৎ। রম্যমধুর রচনাটির সবচেয়ে জোরের জায়গা তার আটপৌরে সারল্য। শ্লেষোক্তি নয়, স্যাটায়ার নয়, নিষ্পাপ হাস্যরসে দর্শক-পাঠককে মাতিয়ে রাখে। নির্মল কৌতূকের একটি দৃষ্টান্ত নাটক থেকে তুলে দেওয়া যাক - 

“রাজেন।। উঃ গ্র‍্যাজুয়েট না হলে জীবনে যথার্থ শান্তি নেই। গ্র‍্যাজুয়েট হলে কি কথা ছিল আজ! ইয়া বুকের ছাতি ফুলিয়ে বলতে পারতাম, চপলাকে আমি চাই-

[দামোদর চৌধুরীর প্রবেশ]

দামো।। ও কি কচ্ছ রাজু!

রাজেন।।(চমকিত হইয়া) একটু ব্রিদিং এক্সারসাইজ করছিলাম -”


নাটকে রান্নার ক্লাসের প্রসঙ্গে বাঙালি হেঁসেলের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা রীতিমতো অবাক করে। নাটকের সঙ্গে একেবারে প্রসঙ্গহীন চিংড়িদীঘি পঙ্কোধার সমিতির ম্যালেরিয়া নিবারণের গান নাট্যকারেরই নিজস্ব সমাজ সচেতন মনের প্রতিবিম্ব। দুর্ভাগ্য এই ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে সক্রিয় কর্মী রবীন্দ্রনাথ ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়াতেই প্রাণ হারান।  

সাতটি গল্পগ্রন্থে প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি ছোটোগল্প লেখেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯২৫এ ‘বিজলী’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘থার্ডক্লাশ’ তাঁর প্রথম গল্প। গল্পটি ইংরেজিতে অনুবাদও করা হয়েছে। গল্পগুলো একেবারেই লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে উঠে এসেছে। ‘থার্ডক্লাশ’, ‘মনস্কাম’ কিংবা ‘দিদিমা’ গল্পে অসহায় বৃদ্ধার করুণ কাহিনি পুনরাবৃত্ত হয়েছে। ‘দিদিমা’ গল্পের প্লটে ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কারে’র ছায়া লক্ষ করা যায়। ‘মডার্ণ গৌরী’ আদ্যন্ত হাস্যরসে ভরপুর। গল্প ছাড়াও রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘মায়াজাল’ নামে একটি উপন্যাস ও কাব্যগ্রন্থ ‘সরিৎ সিন্ধু’।

আরও পড়ুন : নরেন্দ্রনাথ মিত্র : কবি হিসেবে অস্ফুট থেকে গেলেন যে অমর কথাসাহিত্যিক / সবর্ণা চট্টোপাধ্যায়

শিশুকিশোর সাহিত্যের ওপর তাঁর অমোঘ ঝোঁক ছিল। দেশ বিদেশের রূপকথা, নীতিমালার কাহিনিতে অনুপ্রাণিত হয়ে ‘মায়াবাঁশি’ নামে একটি শিশুসাহিত্য সংগ্রহ তিনি রচনা করেন। মায়াবাঁশিতে তিনটি গল্প আছে ‘মায়াবাঁশি’, ‘তপস্বী’, ‘কুলী’। গল্পগুলি যথাক্রমে ফরাসী ঔপন্যাসিক ডুমা, ভলটেয়ার এবং কোয়েত্রেলের গল্প অবলম্বনে রচিত। মায়াবাঁশি পড়লে হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালাকে মনে পড়বে। কুলী গল্পে কুলীর একে একে জমিদার-মিকাডো-সূর্য-মেঘ-পাহাড় ও পুনরায় কুলীতেই পরিণত হওয়া বাংলার প্রচলিত পুনর্মূষিক ভবঃ মনে করায়। নিপাট হাস্যরস এবং সারল্যের সন্ধানে রবীন্দ্রনাথ মৈত্রের স্বল্প সাহিত্য সম্ভার নিঃসন্দেহে ফিরে দেখার দাবি রাখে।

....................

 

#রবীন্দ্রনাথ #রবীন্দ্রনাথ মৈত্র #বাংলা সাহিত্য #মানময়ী গার্লস স্কুল #উত্তমকুমার #কাননদেবী #মিস মেরি #সিলি পয়েন্ট #ফিচার #প্রতিষ্ঠা আচার্য #বাংলা পোর্টাল #ওয়েবজিন #web portal

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

5

Unique Visitors

219107