নরেন্দ্রনাথ মিত্র : কবি হিসেবে অস্ফুট থেকে গেলেন যে অমর কথাসাহিত্যিক
১৯১৬ সালের ৩০শে জানুয়ারি ফরিদপুরে জন্ম তাঁর। সেখানেই ভঙ্গা হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন আর ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজ থেকে আই.এ পাস করেন এবং তারপরেই চলে আসেন কলকাতায়। এখানে বঙ্গবাসী কলেজ থেকে বি.এ পাস করেন। তিনি আর কেউ নন, প্রখ্যাত লেখক নরেন্দ্রনাথ মিত্র।
স্কুলে পড়ার সময় থেকেই তিনি লেখালিখি শুরু করেন। অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীন তিনি ডায়রিতে লিখেছিলেন তাঁর পারিবারিক ইতিবৃত্ত। নবম শ্রেণীতে সহপাঠীরা মিলে ‘আহ্বান’ নামে একটি পত্রিকা বের করতেন, যেখানে বেরিয়েছিল তাঁর একটি উপন্যাস ‘মুক্তার হার’। সেই শুরু, তারপর থেকে আর কখনও থেমে থাকেনি তাঁর কলম। দেশ পত্রিকাতেই মুদ্রিত হয় তাঁর প্রথম গল্প ‘মৃত্যু ও জীবন’।
রবীন্দ্র বলয়ের বাইরে গড়ে ওঠা কল্লোল যুগের আবহে নিজেকে লালন করেছেন নরেন্দ্রনাথ মিত্র। দুই বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী চরম সংকটময় সময়ের ছবি তুলে ধরেছেন তাঁর লেখনীতে। তাঁর লেখার তালিকাতে ছিল মোট ৩৮ টি উপন্যাস এবং ৫১ টি ছোটগল্প গ্রন্থ। তাঁর ছোটোগল্প মূলত দুটি ধারাকে কেন্দ্র করে বয়ে চলেছে। এক, প্রেম-প্রণয়মূলক এবং দুই, সামাজিক। তাঁর প্রণয়মূলক ছোটোগল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো সেখানে প্রাধান্য পেয়েছে একমাত্র মানব মনের একান্ত চাওয়া-পাওয়া। সেখানে স্থান পায়নি সমাজ নীতিতে বেঁধে দেওয়া ‘ভালবাসার নিয়ম কানুন’। আর তাঁর সমাজকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ছোটগল্পগুলির মধ্যে ফুটে উঠেছে সেই সময়কার দুই মহাযুদ্ধের ফলশ্রুতি হিসেবে সমাজের ক্ষোভ, অসহায়তা, হিংস্রতার মত বাস্তব চিত্র। ফুটে উঠেছে মধ্যবিত্ত ঘরের ডাল-ভাতের গল্প। সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সমাজে নারীদের যে পরিবর্তন তা ধরা পড়েছে তাঁর গল্পে। সমাজেরই তাগিদে সংসার চালানোর জন্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার আগল ভেঙে নারীর বহির্জগতে অনুপ্রবেশের আভাস স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাঁর ‘মহাশ্বেতা’, ‘সেতার’, ‘রস’, ‘ছোট দিদিমণি’, ‘অবতরণিকা’র মতো গল্পে।
তাঁর লেখার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, বাস্তব হতাশার দিকটা তুলে ধরেও তিনি থেমে থাকেননি সেখানে - দেখিয়েছেন উত্তরণের পথ। প্রদীপের তলার অন্ধকারটুকুই জীবনের সবটা নয়, ছড়িয়ে যাওয়া আলোই যে আসল কথা, তাঁর গল্পের পরতে পরতে উঠে এসেছে সেই দর্শন। তাঁর লেখাগুলির মধ্যে ‘পালঙ্ক’, ‘রস’, ‘অবতরণিকা’, ‘হেডমাস্টার’ ইত্যাদি গল্প-উপন্যাসগুলি নিয়ে পরবর্তীকালে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। ‘রস’ গল্পের চলচ্চিত্রায়ন ঘটেছে হিন্দিতে ‘সওদাগর’ নামে, অভিনয় করেছেন অমিতাভ বচ্চন। তাঁর ‘অবতরণিকা’ উপন্যাসকে কেন্দ্র করে ‘মহানগর’ সিনেমা বানিয়েছেন সত্যজিৎ রায়। এছাড়াও অন্যান্য অনেক ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর ছোটগল্প।
১৯৬১ সালে নরেন্দ্রনাথ মিত্রকে আনন্দ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। ১৯৮৫ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর মৃত্যু হয় তাঁর। ‘গল্প লেখার গল্প’-র ভূমিকায় বলেছেন – “কিন্তু পিছন ফিরে তাকিয়ে বই না পড়ে যতদূর মনে পড়ে আমি দেখতে পাই ঘৃণা, বিদ্বেষ, ব্যঙ্গ বিদ্রূপ, বৈরিতা আমাকে লেখায় প্রবৃত্ত করেনি। বরং বিপরীত দিকের প্রীতি, প্রেম, সৌহার্দ্য, স্নেহ, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, পারিবারিক গণ্ডির ভিতরে ও বাইরে মানুষের সঙ্গে মানুষের বিচিত্র সম্পর্ক, একের সঙ্গে অন্যের মিলিত হওয়ার দুর্বার আকাঙ্ক্ষা বার বার আমার গল্পের বিষয় হয়ে উঠেছে। তাতে পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। তা জেনেও আমি আমার সীমার বাইরে যেতে পারিনি।” তাঁর ‘রস’ গল্পের শেষ কথা ছিল ‘নেভে নাই।’ আর এটাই ছিল তাঁর জীবনের মূল মন্ত্র। এক কঠিন কুৎসিত বাস্তবের চিত্র আঁকতে বসেও এক অফুরন্ত প্রাণশক্তি, সদর্থকতা, হ্যাপি এন্ডিং-এর গাঁথুনিতে বুনে গেছেন তাঁর গল্প। যার শেষ কথা হবে ‘নেভে নাই’।
কথাসাহিত্যিক হিসেবে পরিচিতি পেলেও কবিতা দিয়েই তাঁর প্রথম আত্মপ্রকাশ। দেশ পত্রিকাতে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কবিতা ‘মূক’। পরবর্তীকালে কলকাতায় তাঁর সঙ্গে একই মেসে থাকতেন বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য এবং নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। সেই সময় এই তিনজনেই নিজেদের সঞ্চিত অর্থ দিয়ে প্রকাশ করেছিলেন প্রথম কবিতার বই ‘জোনাকি’। এর কিছুকাল পর ‘নিরিবিলি’ নামে নরেন্দ্রনাথ মিত্রের একটি কাব্য সংকলন প্রকাশিত হয়।
আরও পড়ুন : নীলকণ্ঠ নজরুল / অনিন্দ্য পাল
তারপর সেই অর্থে তাঁর কবিতার বই না বেরোলেও কবি নরেন্দ্রনাথের কলম থেমে থাকেনি একেবারেই। নানা জায়গায় নানা পত্রিকায় রেখে গেছেন তাঁর কবিসত্তার প্রমাণ। কৃত্তিবাস, দেশ পত্রিকায় যেমন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তাঁর কবিতা, ঠিক তেমনি অনেক অচেনা মানুষের বইয়ের ভাঁজে থেকে গেছে তাঁরই কবিতার বহু ছত্র। কারণ উপহার হিসেবে কবিতা লিখে দেওয়াই ছিল তাঁর কাছে সবচেয়ে সাবলীল ব্যাপার। কলকাতায় বসে স্ত্রীকে লেখা বেশিরভাগ চিঠিতেই ভরে রয়েছে তাঁর কবিতা। এই সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কবিতার পাতাগুলো জড়ো করলে নরেন্দ্রনাথ মিত্রের সাহিত্যিক-সত্তার এক অচেনা দিক উন্মোচিত হতে পারত অনায়াসেই।
.......................................
[ছবি : ইন্টারনেট]