নীলকণ্ঠ নজরুল
১৯২২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর, অবিভক্ত বাংলাদেশের বিখ্যাত পত্রিকা ‘ধূমকেতু’-তে একটা কবিতা প্রকাশিত হয়। কবিতার নাম ‘আনন্দময়ীর আগমনে’। প্রকাশিত হবার কিছু দিনের মধ্যেই ইংরেজ সরকার রাজদ্রোহের অপরাধে গ্রেফতার করে কবিতাটির লেখক কাজী নজরুল ইসলামকে। পত্রিকাটির ওই সংখ্যাটিও বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। কলকাতার ব্যাঙ্কশাল কোর্টে তাঁর বিচার হয় এবং ১৯২৩ সালের ১৬ই জানুয়ারি বিচারক সুইন হো-র আদেশে নজরুলের এক বছরের কারাদণ্ড হয়।
কাজী নজরুল ইসলাম-এর কবি জীবনে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক আক্রমণ ছিল খুবই স্বাভাবিক ঘটনা।
বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ (২৪শে মে ১৮৯৯) জন্মগ্রহণ করেন নজরুল। দরিদ্র পরিবারে জন্মানো কবির ছোটবেলায় ‘দুখু মিঞা’ ডাক নাম যেন তাঁর ভবিষ্যৎ জীবনের কিছুটা রূপরেখা নির্দেশ করে। তবে অনেকে আদর করে তাঁকে ‘নজর আলি’ বলেও ডাকতেন। আর ‘তারা খ্যাপা’? যতদূর জানা যায়, ছোটোবেলায় নজরুলের ছন্নছাড়া জীবন, উদাসীন মনোভাবের জন্য কেউ কেউ এই নামে ডাকতেন তাঁকে।
এই লেখার বিষয়বস্তু নজরুলের জীবনকথা নয়, তাই সেই অভিমুখে কথা না বাড়িয়ে মূল আলোচ্যে আসা যাক।
পত্রিকার পাতায় নজরুল ইসলামের প্রথম প্রকাশিত কবিতার নাম ‘মুক্তি’। প্রকাশিত হয়েছিল ‘মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’ নামে একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকায়। মুক্তির প্রকাশকাল ১৩২৩ সালের শ্রাবণ মাস। নজরুল কবিতাটি লিখেছিলেন করাচির সেনানিবাসে বসে। প্রকাশিত হওয়ার পর কবিতাটি যেমন প্রশংসা পেয়েছিল, তেমনি নজরুলকে শুনতে হয়েছিল অনেক বিষময় উচ্চারণ। যেমন, ‘সাহিত্য’ নামের একটি পত্রিকায় লেখা হয়েছিল – “শ্রী কাজী নজরুল ইসলাম বঙ্গবাহিনীর একজন হাবিলদার। ইনি করাচীর সেনানিবাসের কর্ম-কোলাহলের মধ্যেও মাতৃভাষাকে স্মরণ করিয়াছেন, মাতৃভাষার অনুশীলন করিতেছেন। রবীন্দ্রনাথের পদ্য গল্পগুলি পড়িয়াছেন এবং তাহার অনুসরণে ‘মুক্তি’ লিখিয়াছেন।” এই বাক্য যে ইঙ্গিত বহন করে তা কারো বুঝতে কষ্ট হয় না। হাবিলদার সাহিত্য চর্চা করলে তথাকথিত বুদ্ধিজীবী সাহিত্যসেবকরা বিস্মিত হবেন, সেটাই স্বাভাবিক!
অন্যদিকে মুজফফর আহমেদ লিখেছেন, “আমি কবি বা সাহিত্যিক নই... তবু নজরুল ইসলামের এই প্রথম কবিতাটির পাণ্ডুলিপি হাতে পেয়ে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিলাম।... তাঁর এই কবিতা এবং ‘হেনা’ ও ‘ব্যথার দান’ প্রভৃতি ছোটগল্প পড়ে আমার মনে হয়েছিল যে বঙ্গসাহিত্যে একজন শক্তিশালী কবি ও সাহিত্যিকের উদ্ভব হতে যাচ্ছে।”
এই সময় নজরুল যে খুব কবিখ্যাতি পেয়েছিলেন, তেমনটা নয়। কলকাতার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়, যেমন, ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু ১৯২০ সালের মার্চ মাসে কলকাতায় চলে আসার পর থেকে নজরুল জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকেন। এই সময়েই, ১৩২৭ বঙ্গাব্দে শুরু হয় ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকা। নজরুল এই পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতেই লিখেছেন ‘বাঁধন হারা’ নামে পত্রোপন্যাস। এছাড়াও তিনি কোরবানী, বোধন, মহরম, বিরহবিধুরা – প্রভৃতি কবিতা এবং ‘বাদল বরিষণে’ নামে একটা রূপক গল্প লিখেছেন এই ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায়। এর ফলে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে নজরুলের সম্মান আর পরিচিতি। আর এই সময় থেকেই শুরু হয় নজরুলকে ক্ষতবিক্ষত করার, তাঁর সাহিত্য সাধনায় বাধার সৃষ্টি করার চক্রান্ত। এই চক্রান্ত শুরু করেছিলেন ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকার সম্পাদক আফজালুল হক, নজরুলকে দেওঘরে পাঠিয়ে। এর ফলে নজরুলের লেখা অনেকটাই বিঘ্নিত হয়েছিল। ‘নবযুগ’ পত্রিকার সম্পাদক মুজফফর আহমেদ লিখেছেন -- “তাঁরা কেবলই তাঁকে বলেছিলেন যে, একজন কবি দৈনিক কাগজে কাজ করবেন এটা কেমন কথা? কিন্তু কবিকেও যে খেতে হয়, সেটা তাঁরা ভাবতেন না।” এই আফজালুল হক, নজরুলের পরম সুহৃদ মুজফফর আহমেদের সঙ্গে নজরুলের বিরোধ বাধাতেও সচেষ্ট হয়েছিলেন।
১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে ৩/৪ সি, তালতলা লেনের একতলায় ছোট্ট ঘরে, সেই রাতে ঘুমন্ত মুজফফর আহমেদের পাশে বসেই নজরুল লিখলেন ‘বিদ্রোহী’। ১৩৯ লাইনের এই কবিতাটি সাড়া ফেলে দিয়েছিল বাংলাদেশের জনমানসে। মুজফফর আহমেদের লেখায়, “সে কবিতাটি লিখেছিল রাত্রিতে। ... সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে এসে আমি বসেছি এমন সময় নজরুল বলল, সে একটা কবিতা লিখেছে। পুরো কবিতাটি সে আমায় পড়ে শোনাল। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার আমিই প্রথম শ্রোতা।” ‘বিদ্রোহী’ প্রথম প্রকাশিত হয় ‘বিজলী’ নামে একটি পত্রিকায়, ১৯২২ সালের ৬ই জানুয়ারি (বাংলার ২২শে পৌষ ১৩২৮ বঙ্গাব্দ)। এরপর ছাপা হয় মোসলেম ভারত ও প্রবাসী পত্রিকায়। এখান থেকেই নজরুলের প্রতি বিরূপ হয়ে ওঠেন মোহিতলাল মজুমদার। নজরুল মোহিতলালকে তাঁর সাহিত্যগুরু মানলেও মোহিতলাল কিন্তু নজরুলের সম্পর্কে আনলেন গুরুতর অভিযোগ। মোহিতলাল অভিযোগ করলেন, ‘বিদ্রোহী’ ছাপা হবার বছর সাতেক আগে ‘মানসী’ পত্রিকায় মোহিতলালের লেখা ‘আমি’ প্রবন্ধ থেকে চুরি করে নজরুল তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি লিখেছেন। মোহিতলালের এরকম মনে হবার কারণ, তিনি ‘আমি’ প্রবন্ধটি একবার নজরুলকে পড়ে শুনিয়েছিলেন। একদিন এক বড় সাহিত্য আসরে অনেক বিখ্যাত কবি, লেখকের সামনে মোহিতলাল তাঁর প্রবন্ধটি পড়ে শোনালেন এবং বললেন, “নজরুল একটা চোর। আমার এই ‘আমি’ প্রবন্ধ থেকে সে চুরি করেই ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি লিখেছে।” হতে পারে, ‘আমি’ আর ‘বিদ্রোহী’-র মধ্যে একটা ভাবগত সাদৃশ্য ছিল, কিন্তু মোহিতলালের মত একজন পণ্ডিত এবং স্বনামধন্য কবির এই কদর্য আক্রমণ কখনোই শোভনীয় নয়। তবে এই প্রসঙ্গে মুজফফর আহমেদ বলেছেন, “একবার মাত্র শুনে এত দীর্ঘকাল পরে সে (নজরুল) ‘আমি’-র ভাব সম্পদ নিয়ে বা চুরি করে তার ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনা করেছিল আমি তা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারিনে।... নজরুল ইসলাম যে তার আওতা হতে, তাঁর শাসন হতে বেরিয়ে গেল তার জন্য তিনি খানিকটা প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে উঠেছিলেন।”
আসলে ঘোরতর ব্রাহ্ম-বিদ্বেষী এবং সমকালের বাংলা কাব্য সাহিত্যের বৈচিত্র্যহীনতায় ক্লিষ্ট মোহিতলাল নজরুলের মৌলিক এবং স্বকীয় ধারার রচনায় মুগ্ধ হয়ে নজরুলের প্রতি অনুরক্ত হলেও যে মুহূর্তে নজরুল তাঁর সৎপরামর্শ না শুনে নিজের ব্যক্তিত্ব অনুসারে চলতে লাগলেন, তখনই মোহিতলাল নজরুলকে তাঁর শত্রু বানিয়ে ফেললেন। মোহিতলালের সঙ্গে সামিল হলেন আরও অনেকে, যেমন, ‘শনিবারের চিঠি’ পত্রিকার সম্পাদক সজনীকান্ত দাস। সজনীকান্ত নজরুলের বিদ্রোহী কবিতাকে ব্যঙ্গ করে লিখলেন, ‘ব্যাঙ’। নজরুল নিজেকে বলতেন, “শনিবারের চিঠির গালির গালিচার বাদশাহ।” আসলে ‘শনিবারের চিঠি’ জন্মলগ্ন থেকেই নজরুলকে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করে এসেছে।
রবীন্দ্রনাথের ভাষণের যে স্বলিখিত রূপ ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসের প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, সেখানে কবিগুরু লেখেন – “সেদিন কোন একজন বাঙালি হিন্দু কবির কাব্যে দেখলুম, তিনি রক্ত শব্দের জায়গায় ব্যবহার করেছেন ‘খুন’। পুরাতন ‘রক্ত’ শব্দে তাঁর কাব্যে রাঙা রঙ যদি না ধরে তাহলে বুঝবে, সেটাতে তাঁরই অকৃতিত্ব। তিনি রঙ লাগাতে পারেন না বলেই তাক লাগাতে চান”। কিন্তু এই অভিভাষণ যখন ‘শনিবারের চিঠি’ আর ‘বাঙ্গালার কথা’-র প্রতিবেদনে ছাপা হয়েছিল, সেখানে ‘হিন্দু’ শব্দটা ছিল না। ফলে নজরুলের প্রতি ইঙ্গিতটা স্পষ্ট হয়ে যায়। এর উদ্দেশ্য হতে পারে, নজরুলের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পর্কটা নষ্ট করা। তবে এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, ‘শনিবারের চিঠি’ আর ‘বাঙ্গালার কথা’-য় এই অভিভাষণ আগে ছাপা হয়, ‘প্রবাসী’-তে পরে। তাই অনেকে মনে করেন, রবীন্দ্রনাথ সেদিনের ভাষণে আদৌ ‘হিন্দু’ শব্দটি উচ্চারণ করেননি। পরে বিতর্ক প্রশমিত করার জন্য হয় সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, নাহলে রবীন্দ্রনাথ নিজেই ‘হিন্দু’ শব্দটি বসিয়ে দেন।
আবার এটাও সত্যি যে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যটি নজরুলকেই উৎসর্গ করেছিলেন।
আবার কন্যাসম্প্রদান করে নজরুলের লেখকসত্তাকে কিনে ঘরবন্দী করে রাখার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে বলেও শোনা যায়। অভিযোগের তির স্বয়ং প্রকাশক আলী আকবর খাঁ-র দিকে।
এরপর ১৯২৪ সালে নজরুল যখন বিয়ে করলেন প্রমীলা সেনগুপ্তকে, তখন তাঁর প্রতি প্রবাসী পত্রিকার আক্রমণ তীক্ষ্ণতর হয়ে উঠলো, এমনকি তাঁর লেখা ছাপানোও বন্ধ হয়ে গেল প্রবাসীতে। আবার সেই সময় রবীন্দ্রনাথ তাঁর পাশে ছিলেন, অন্য কেউ নয়।
নজরুলের কবিতার বিদ্রোহী চেতনা, প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর সবার পছন্দ হয়নি। অভিযোগ করা হয়েছে, তিনি কবিতায় অসির ঝনঝনা এনেছেন। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু প্রশ্রয় দিয়েছেন নজরুলকে। তাঁর কথায়, “কাব্যে অসির ঝনঝনা থাকতে পারবে না, এ-ও তোমাদের অদ্ভুত আব্দার বটে। সমগ্র জাতির অন্তর যে সুরে বাঁধা, অসির ঝনঝনায় যখন সেখানে ঝংকার তোলে, ঐকতান সৃষ্টি হয়, তখন কাব্যে তাকে প্রকাশ করতে হবে বৈকি! আমি যদি আজ তরুণ হতাম আমার কলমেও ওই সুর বাজত।” – এই চরম সত্যিটা সমসাময়িক অন্য কবিরা উপলব্ধি করতে পারেননি।
কাজী নজরুল ইসলাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরম ভক্ত হয়েও তাঁর অনুসরণ না করে নিজের পথ তৈরি করে নিতে পেরেছিলেন। বুদ্ধদেব বসু তাঁকে বলেছেন, “ঐতিহাসিক স্বভাবকবি”। শুধু তাই নয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর প্রথম মৌলিক বাঙালি কবি হিসেবে তিনি স্বীকৃতি দিয়েছেন নজরুলকেই।
জীবনে অসংখ্য ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও নজরুল যে সৃষ্টি বাংলা ভাষার জন্য দিয়ে গেছেন, আজও তা অমলিন। আর যে মানুষগুলোর বিষাক্ত দংশনে তিনি বারংবার নীলকণ্ঠ হয়ে উঠেছেন, তারা আজ বিস্মৃতির অতলে। এটাই বোধ হয় পোয়েটিক জাস্টিস।