মুক্তগদ্য

ভয় (প্রথম কিস্তি)

শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী Mar 5, 2021 at 6:11 am মুক্তগদ্য

একটা আলকাতরার ড্রাম। দুমড়ে, পিটিয়ে সেটাকে তক্তার মতো করে দেওয়া হয়েছিল। তারপর কে যেন কোনোদিন এসে সেটার উপর ট্যাক্সির মতো হলুদ রং দিয়ে কাটাকুটির ঘর কেটে কেবল শূন্যগুলো বসিয়ে চলে গে'ছিল। শিলিগুড়িতে আমাদের কোয়ার্টারের পাম্পঘরের গায়ে পড়ে থাকতো সেই টিনের তক্তা। সন্ধের লো ভোল্টেজের হলুদ আলোয় তাকে গূঢ় কোনো সংকেত মনে হতো।

ছোটবেলার কোনো একটা ছড়ার বইতে বড় বড় কালো হরফে ছড়া ছাপা। আর পাতার উপরের দিকের আঁকাগুলো একটু ধ্যাবড়া তুলিতে, অদ্ভুত সবুজ একটা রঙে। টিয়াপাখি বৃষ্টিতে ভিজলে যেমন সবুজ হয়, তেমন। পাত পেড়ে ভারী গতরের এক গিন্নি বসে আছেন, তার গা সবুজ, শাড়ি সবুজ, বালা সবুজ, থালা সবুজ। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে শাড়ির পাড় আর কপালে-সিঁথিতে সিঁদুর টকটকে লাল রঙের। পরের পাতায় সেই মহিলা মুখ ঘুরিয়ে পাঠকের দিকে তাকিয়ে আছেন। সবুজ আর লালের মাঝে কুতকুতে কালো দুটো চোখ। আগের পাতা থেকে এই পাতায় এলে, আর এই পাতা থেকে আগের পাতায় ফিরে গেলে পুজোর লাইটিং-এর মতো লাগত। মহিলা এই মুখ ফিরিয়ে, এই তাকালেন, এই ফিরলেন।

    

বিকেলবেলা সমুদ্রের তীরে হাঁটছি, পিছন থেকে কেউ ডাকল। ফিরতে গিয়ে চোখে বর্শার ফলার মতো রোদ এসে বিঁধল। মনে পড়ল, চৈত্র মাসের শেষ দিকে ঠিক বিকেল সাড়ে চারটের সময়ে আমাদের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে উত্তর-পশ্চিমে তাকালে এই রোদ পাওয়া যায়। আকাশের মেঘের একটা রঙ থাকে সে সময়ে, বেশি জল মিশিয়ে ফেলা ফ্যাকাসে অরেঞ্জ সিরাপের মতো। একটা গন্ধও মনে পড়লো, কিসের বুঝতে পারলাম না। ঠিক এই মুহূর্তে প্রায় ২৯ বছর আগে দিদিমার সঙ্গে আমি কথা বলছিলাম।

আরও পড়ুন : সুন্দরকে লেখা চিঠি / বিপাশা ভট্টাচার্য 

একটা উঠোন, তারপর আরেকটা, তারপর আরেকটা। প্রত্যেকটা উঠোনই চারদিক দিয়ে ঘেরা ঘরে। একটা উঠোনে খটখটে ভাদ্র মাসের রোদ। বৃষ্টি হয়ে গেছে, তাই সিমেন্টের মেঝেটা ভেজা। পরের উঠোনের আকাশ মেঘলা, বৃষ্টি আসছে। এরকম গায়ে গায়ে উঠোনগুলোর একটায় মেঘ, একটায় বৃষ্টি। লোকজন কম। কিন্তু ভেতরের ঘরগুলোয় কিছু কাজ হয়েই চলেছে টানা। বাইরে থেকে বোঝা যায়, জানলা ছাড়া ঘরগুলোর সাদা চুনকাম করা দেওয়ালে কালি পড়ে যাওয়ার দাগ। বাইরে কিছু মাটির লম্বামুখো ঘট রাখা, অনাদরে। ঘটের ভিতর দেখলাম। মানুষের অস্থি রাখা, দাহের পর।


লীলা মজুমদারের 'সব ভূতুড়ে' রাখা থাকত খাটের পাশের একটা নিচু টেবিলে। তার পাশে থাকত ইমারজেন্সি লাইট। লোডশেডিং হলে হাত বাড়িয়ে সুইচ টিপতে হত। মনমরা আলো জ্বলে উঠত। সে আলোয় পড়া হত না। আলোর পাশে রাখা বইয়ের মলাটটা চোখে পড়ত। সেই মলাটেও একটা কুপি জ্বলছে। তাতে আলো হয় না, অন্ধকার বাড়ে। পাহাড়ি দেশে আজও সারারাত বাড়ির বাইরে এরকম নিভু-নিভু কুপি জ্বলে। পাহারায়। কিন্তু সবাই জানে, আসার কেউ নেই। যা আছে, যাওয়ার।

........................ 

[পোস্টার : অর্পণ দাস] 


#গদ্য #শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী #সিলি পয়েন্ট #মুক্তগদ্য #অর্পণ দাস

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

65

Unique Visitors

183263